ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংক খাতে তিন সঙ্কট

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ২০ জুলাই ২০১৮

ব্যাংক খাতে তিন সঙ্কট

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দেশের ব্যাংক খাতে এখন বিরাজ করছে তিন সঙ্কট। ঋণের তুলনায় আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার সঙ্কট চলছে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ডলারের সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। আর সুশাসন না থাকায় পুরো ব্যাংক খাতে দেখা দিয়েছে আস্থার সঙ্কট। এ প্রসঙ্গে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘ব্যাংক খাতে আস্থার সঙ্কট এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সব মিলিয়ে আস্থার সঙ্কট আমানতকারীদের ধীরে ধীরে ব্যাংক বিমুখ করছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে।’ তার মতে, ‘বেসরকারী ব্যাংকগুলো এখন নিজেদের ইচ্ছে মতো চলছে। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোন নিয়ম-নীতি মানছে না তারা।’ ব্যাংক খাত নিয়ে মানুষের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির। এই সন্দেহ ও অবিশ্বাসকে ব্যাংকের জন্য একটি অশনি সঙ্কেত বলেও মন্তব্য করেন তিনি। শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ’ শীর্ষক এক সম্মেলনে ফজলে কবির এমন মন্তব্য করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এই বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে ব্যাংক খাত থেকে প্রায় একহাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্যাংক খাতে জনগণের রাখা আমানতের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ২৬ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। তিন মাস পর অর্থাৎ মার্চ শেষে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ২৫ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা। এ প্রসঙ্গে বেসরকারী ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) প্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘ফারমার্স ব্যাংকের খারাপ অবস্থার কারণে সরকারী বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বেসরকারী ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছে। এর ফলে কিছু ব্যাংক নগদ টাকার সঙ্কটে পড়েছে।’ ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, একদিকে আমানত আসছে না, অন্যদিকে ঋণ ঠিকই বিতরণ করা হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংক খাতে নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য (এক্সেস লিক্যুইডিটি) ছিল ৯৭ হাজার ১২২ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের মার্চের শেষে তা কমে দাঁড়ায় ৭৬ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছরের প্রথম ছয় মাসে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতে আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি হয়েছে। আমদানি নির্ভর দ্রুত ঋণ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে রফতানি ও রেমিটেন্সের প্রবৃদ্ধির পার্থক্য বেশি হয়েছে। এতে স্থানীয় বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ও জোগানের মধ্যে অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়েছে। এর পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংকের আর্থিক অনিয়মের জন্য ব্যাংকিং খাতে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। জানা গেছে, গত বছরের শুরুতেও ব্যাংক খাতে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা অতিরিক্ত তারল্য ছিল। বিনিয়োগ করতে না পারায় ওই সময় ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার কমিয়ে দেয়। তখন অনেকে সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এতে ব্যাংকের আমানত কমতে থাকে। এরই মধ্যে ফারমার্স ব্যাংকের ঘটনায় আস্থা হারান আমানতকারীরা। এমনকি সরকারী, বেসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকে রাখা আমানত প্রত্যাহার করতে থাকে। ফলে ব্যাংকিং খাতে নগদ টাকার সঙ্কট হতে দেখা যায়। বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের টান পড়ায় ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি এ সঙ্কট মেটাতে ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহে মরিয়া হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবিবেচনামূলক আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে কিছু তফসিলী ব্যাংকে তারল্য চাপ সৃষ্টি হয়। এদিকে ব্যাংকগুলো তহবিলের ব্যবস্থা না করেই পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলেছে। এতে ব্যাপকভিত্তিতে বৈদেশিক মুদ্রার দায় সৃষ্টি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, গত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) আমদানির প্রবৃদ্ধি হয় ২৫ দশমিক ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ ১০ মাসে চার হাজার ৯০১ কোটি ডলার ব্যয় হয়। বিপরীতে গত অর্থবছরে (জুলাই-জুন) রফতানি প্রবৃদ্ধি হয় ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গত অর্থবছরে ২৩১ কোটি ১০ লাখ ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করা হয়েছে। এর বিপরীতে বাজার থেকে তুলে নেয়া হয়েছে ১৯ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। আমদানি বেড়ে যাওয়ায় দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলো ডলার কিংবা বিদেশী মুদ্রার তারল্য সঙ্কটে ভুগছে।
×