ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মূল্যায়নের ধাক্কা ॥ এইচএসসিতে পাসের হার, জিপিএ-৫ দুটিই কমেছে

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ২০ জুলাই ২০১৮

মূল্যায়নের ধাক্কা ॥ এইচএসসিতে পাসের হার, জিপিএ-৫ দুটিই কমেছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশ এক্সামিনেশন ডেভেলপমেন্ট ইউনিট বা বেদুর নতুন কঠোর খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতির ধাক্কা লাগল এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলেও! কঠোর ও যথাযথ খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতির ফলে এসএসসির মতো এইচএসসির সাফল্যেও কিছুটা ছেদ পড়েছে। মানবিকে পাসের হার কমায় প্রভাব ফেলেছে পরীক্ষার ফলে। ২০০৩ সালে গ্রেডিং পদ্ধতি চালুর পর প্রায় প্রতিবছরই পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে এবার পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটোই কমেছে। এক বছরে পাসের হার ২ দশমিক ২৭ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৬৪ দশমিক ৬৮ শতাংশে। জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা আট হাজার ৭০৭ কমে হয়েছে ২৯ হাজার ২৬২। বেড়েছে শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠান, কমেছে শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানও। ফল বিশ্লেষণে জানা গেছে, গত ১০ বছরের মধ্যে এবারই পাসের হার সবচেয়ে কম। এই সময়ে দুই-এক বছর বাদ দিলে প্রায় প্রতিবছর পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। কোন কোন বছর পাসের হার কিছুটা কমলেও বেড়েছে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এবার ফলের প্রতিটি সূচকেই কিছুটা ছেদ পড়েছে সাফল্যে। তবে পাসের হার ও জিপিএ-৫ সহ অন্যান্য সূচকের এ ফলকে ইতিবাচক বলে দেখছেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে পাতাগুনে নম্বর দেয়ার মতো একটি প্রবণতা তৈরি হয়েছিল। যথাযথভাবে খাতা মূল্যায়ন হয়নি। প্রশ্ন ও পরীক্ষা পদ্ধতিতেও হয়ে পড়েছিল মানহীন। শিক্ষার মানে অগ্রগতি না হলেও খাতা মূল্যায়নে দুর্বলতার কারণে বছরের পর বছর ধরে অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে পাসের হার ও জিপিএ-৫। এ অবস্থায় সঠিকভাবে খাতামূল্যায়নে নতুন পদ্ধতি চালু ও কঠোরতা অবলম্বন করলে ফলাফলে তার প্রভাব পড়বে বলেই ধারণা ছিল সবার। এখন নতুন একটি সঠিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে পাবলিক পরীক্ষা। এতে পাসের হার ও জিপিএ-৫ সামান্য কমলেও এই মূল্যায়নটিই সঠিক। এ প্রক্রিয়াকে ধরে রাখার তাগিদ দিয়ে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকরা বলছেন, নতুন প্রক্রিয়ায় একটি ‘ট্রানজিট পিরিয়ড’ চলছে। কয়েক বছর পাস ও জিপিএ-৫ কমতে পারে। তবে এই ফলই পজিটিভ। একটির স্থিতিশীল অবস্থায় চলে আসবে ফল। এরপর শীঘ্রই আবার আস্তে আস্তে সাফল্য আসবে পাসের হার ও জিপিএ-৫সহ অন্যান্য সূচকেও। পরীক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তনের কারণে সূচক খানিকটা কমলেও এ পরিবর্তনকে সময়োপযোগী বলে উল্লেখ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। বলেছেন, মাধ্যমিকের মতো উচ্চ মাধ্যমিকেও সঠিক খাতামূল্যায়ন জরুরী হয়ে পড়েছিল। যুগের পর যুগ ধরে একটি ত্রুটিপূর্ণ খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি ছিল যার পরিবর্তনের ফলে এখন পরীক্ষার সঠিক ফল পাওয়া গেছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সব শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে সঙ্গে নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ফলের সারসংক্ষেপ হস্তান্তর করেন। পরে দুপুর একটায় সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ফলের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন মন্ত্রী। এরপর শিক্ষার্থীরা শিক্ষা বোর্ডগুলোর ওয়েবসাইট (িি.িবফঁপধঃরড়হনড়ধৎফৎবংঁষঃং.মড়া.নফ) এবং নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও যে কোন মোবাইল থেকে এসএমএস করে ফল জানতে পারছেন। গত ২ এপ্রিল থেকে ১৩ মে এইচএসসি ও সমমানের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত। এরপর ১৪ থেকে ২৩ মে নেয়া হয় ব্যবহারিক পরীক্ষা। সারাদেশে দুই হাজার ৫৪১ কেন্দ্রে এবার ১৩ লাখ ১১ হাজার ৪৫৭ শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেয়। বেশ কয়েক বছর ধরে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠলেও এবার প্রশ্ন ফাঁসের কোন ধরনের অভিযোগ উঠেনি। সবকটি পরীক্ষায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলী, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর মাহবুবুর রহমান, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি প্রফেসর জিয়াউল হক প্রমুখ। সারাদেশের বোর্ডওয়ারী ফল ॥ আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি, মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে আলিম ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি ভোকেশনাল/ বিএম/ ডিপ্লোমা ইন কমার্স পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১২ লাখ ৮৮ হাজার ৭৫৭ শিক্ষার্থী। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৬৩ হাজার ৩৭০ জন। এবার উত্তীর্ণ হয়েছে আট লাখ ৫৮ হাজার ৮০১ শিক্ষার্থী, গত বছর যা ছিল আট লাখ এক হাজার ৭১১ জন। দশ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এবার মোট আট হাজার ৯৪৫টি প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার্থী এই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল, গত বছর এই প্রতিষ্ঠান ছিল আট হাজার ৭৭১টি। দেশে মোট দুই হাজার ৫৪০ কেন্দ্রে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এবার পাস করেছে ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। জিপিএ-৫ পেয়েছে মোট ২৯ হাজার ২৬২ শিক্ষার্থী। আর গত বছর এ পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৬৮ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৩৭ হাজার ৭২৬ জন। এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার কমেছে ২ দশমিক ২৭ শতাংশ পয়েন্ট। আর পূর্ণাঙ্গ জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে আট হাজার ৭০৭ জন। ২০১৬ সালে এই পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৫৮ হাজার ২৭৬ জন এবং গড় পাসের হার ছিল ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। এবার আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল দশ লাখ ৭২ হাজার শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করেছে ছয় লাখ ৯১ হাজার ৯৫৮ জন। গড় পাসের হার ৬৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গত বছর যা ছিল ৬৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ। আট বোর্ডে এবার পাসের হার কমেছে ২ দশমিক ২৯ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে মোট ২৫ হাজার ৫৬২ জন, গত বছর যা ছিল ৩৩ হাজার ২৪২ জন। এ বছর জিপিএ-৫ কমেছে সাত হাজার ৬৮০টি। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৬৬ দশমিক ১৩ শতাংশ, গত বছর যা ছিল ৬৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১২ হাজার ৯৩৮ জন, গত বছর যা ছিল ১৮ হাজার ৯৩০ জন। রাজশাহী বোর্ডে পাসের হার ৬৬ দশমিক ৫১ শতাংশ, গত বছর যা ছিল ৭১ দশমিক ৩০ শতাংশ। এ বোর্ডে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে চার হাজার ১৩৮ জন, গত বছর যা পেয়েছিল পাঁচ হাজার ২৯৪ জন। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৬৫ দশমিক ৪২ শতাংশ, গত বছর যা ছিল ৪৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। কুমিল্লা বোর্ডে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯৪৪ জন, গত বছর যা ছিল ৬৭৮ জন। যশোর বোর্ডে পাসের হার ৬০ দশমিক ৪০ শতাংশ, গত বছর যা ছিল ৭০ দশমিক ০২ শতাংশ। যশোরে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে দুই হাজার ৮৯ জন, গত বছর যা ছিল দুই হাজার ৪৪৭ জন। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৬২ দশমিক ৭৩ শতাংশ, গত বছর যা ছিল ৬১ দশমিক ০৯ শতাংশ। চট্টগ্রামে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে এক হাজার ৬১৩ জন, গত বছর যা পেয়েছিল এক হাজার ৩৯১ জন। বরিশাল বোর্ডে পাসের হার ৭০ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গত বছর যা ছিল ৭০ দশমিক ২৮ শতাংশ। বরিশাল বোর্ডে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬৭০ জন, গত বছর যা পেয়েছিল ৮১৫ জন। সিলেট শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৬২ দশমিক ১১ শতাংশ, গত বছর যা ছিল ৭২ শতাংশ। সিলেট বোর্ডে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ৮৭৩ শিক্ষার্থী, গত বছর যা ছিল ৭০০ জন। দিনাজপুরে শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৬০ দশমিক ২১ শতাংশ, গত বছর যা ছিল ৬৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। দিনাজপুরে জিপিএ-৫ পেয়েছে দুই হাজার ২৯৭ জন, গত বছর যা পেয়েছিল দুই হাজার ৯৮৭ জন। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৭৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ, গত বছর যা ছিল ৭৪ দশমিক ০২ শতাংশ। আলিম পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে এক হাজার ২৪৪ জন, গত বছর যা পেয়েছিল এক হাজার ৮১৫। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি (ভোকেশনাল/ বিএম/ ডিপ্লোমা ইন কমার্স) পরীক্ষায় পাসের হার ৭৫ দশমিক ৫০ শতাংশ, গত বছর যা ছিল ৮১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। কারিগরিতে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে দুই হাজার ৪৫৬ শিক্ষার্থী, গত বছর যা ছিল দুই হাজার ৬৬৯ জন। এছাড়া এইচএসসি ও সমানের পরীক্ষায় দেশের এবার বাইরের ৭ কেন্দ্রে ২৮৫ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল। এর মধ্যে পাস করেছে ২৬৩ জন। গড় পাসের হার ৯২ দশমিক ২৮ শতাংশ। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৬ জন। শিক্ষামন্ত্রীর ফল মূল্যায়ন ॥ পাসের হার কমার কারণ অনুসন্ধান করে পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, কম পাস করলেও সমালোচনা, বেশি পাস করলেও সমালোচনা হয়। বেশি পাস করলেও দোষ, আবার কম পাস করলেও দোষ। তবে আমরা পাসের হার কমা ও অন্যান্য সূচকে যে ফল হয়েছে তার কারণগুলো খুঁজে বের করব। প্রায় ৩৪ শতাংশ ফেল করায় আগামীতে কি পদক্ষেপ নেয়া হবে- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, আমাদের সবাইকেই পাস করাতে হবে সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে। একটা সময় আসুক যেন সবাই পাস করে যায়। কিন্তু সেই অবস্থাটা আমাদের এখনও হয় নাই। আগে সময় ছিল যেখানে ৪৯-৫০ শতাংশ পাস করেছে। এটা আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যখন বেশি পাস করেছে সবাই বিস্মিত হয়েছেন, আমরা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছি বেশি পাস করাই দিতেছি এজন্যতো। তিনি আরও জানান, প্রকল্পের মাধ্যমে ইংরেজী ও গণিতে প্রশিক্ষণ দিয়ে ক্লাস নেয়ার কারণে পাসের হার বেড়েছে। মানবিকের ফল খারাপ হওয়া প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, যারা তুলনামূলক মেধাবী তারা বিজ্ঞানে ভর্তি হচ্ছেন। এটা একটা বিষয় বটে। তাদের প্রতি জোর দিচ্ছি এ কারণে, আমাদের প্রধানমন্ত্রীও নির্দেশ দিয়েছিলেন, আমাদের জাতিরও সেটা আকাক্সক্ষা হবে যে ভবিষতের ছেলেমেয়েরা সেই শিক্ষা লাভ করুক যে শিক্ষাটা বাস্তব কর্মজীবনে প্রয়োগ করা যাবে। সেটা করতে গেলে বিজ্ঞান ব্যাকগ্রাউন্ড অতি জরুরী। সেজন্য ওই দিকে জোর দেয়াটা যুক্তিযুক্ত। পাশাপাশি অন্য বিষয়গুলোও গুরুত্বপূর্ণ, ওখান থেকেও ভাল ছাত্র বের করে নিয়ে আসতে হবে, সেটা আমরা গুরুত্ব দেব। গত বছরের তুলনায় কুমিল্লায় প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি এবং যশোর ও সিলেট বোর্ডে পাসের হার প্রায় ১০ শতাংশ কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, যা বাস্তব তা ফল বেরিয়ে এসেছে। কেউ কেউ বলতেন আমরা নম্বর বাড়িয়ে দিতে বলি, আমরা বাড়িয়ে দিতে বলি না, কমিয়ে দিতেও বলি না। আমরা সবাইকে বাধ্য করতেছি সব শিক্ষক সঠিকভাবে মূল্যায়ন করেন। আমরা এগুলো দেখব, ওই বোর্ডগুলোও নিজেরা বিশ্লেষণ করে দেখবেন, কেন কুমিল্লা বোর্ডের ভাল হলো, সিলেট ও যশোরে কেন খারাপ হল? আমরা দেখে ত্রুটি বের করব এবং সমাধান করব। মন্ত্রী বলেন, সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এখন মান বৃদ্ধির দিকে জোর দিচ্ছি। সেটা আমাদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ না। আমরা সেই পর্যায়ে পৌঁছে গেছি, যেখানে মান বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে, আমরা দিচ্ছি। মান বৃদ্ধি পাচ্ছেও। এবার গণিত অলিম্পিয়াডে দু’জন গোল্ড মেডেল পেয়েছে। এটা একটা অবিশ্বাসী সাফল্য। অনেক দেশকে পেছনে ফেলে গোল্ড মেডেল নিয়ে এসেছে। অনেকে হয়তো বলেন, ভাবটা এমন যারা আয়োজন করেন, যেন তারাই এসব তৈরি করেছেন! এটা তো আমাদের শিক্ষকরাই পড়াইছেন, আমাদের শিক্ষার্থীরাই হয়েছেন। সবাই সমান মেধাবী হবে না। আমরা গুণগত মান বাড়িয়ে এমন জায়গায় যাব, যাতে সবাই এই শিক্ষাটা অর্জন করে পাস করে একটা যোগ্য স্থানে যায়। তার মধ্যে অনেক মেধাবী যারা, সৃজনশীল যারা, কিছু করতে পারে যারা, তাদের জন্য আমাদের উন্মুক্ত করতে হবে। ফলের পেছনে বেদু, ইতিবাচক বলছেন বিশেষজ্ঞরা ॥ কেবল শিক্ষামন্ত্রী নন, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশ এক্সামিনেশন ডেভেলপমেন্ট ইউনিট বা বেদুর নতুন কঠোর খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতির ধাক্কা লেগেছে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলেও। কঠোর ও যথাযথ খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতির ফলে এসএসসির মতো এইচএসসির সাফল্যেও কিছুটা ছেদ পড়েছে। মানবিকে পাসের হার কমায় প্রভাব ফেলেছে ফলাফলে। এতে উদ্বেগের কিছু নেই। বরং এখন সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে এটাই ভাল খবর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরের পর বছর পরীক্ষার খাতামূল্যায়নে লাগামহীন উদারতার কারণে ফলাফলে রীতিমতো সাফল্যের বিস্ফোরণ ঘটেছিল। শিক্ষার মানে অগ্রগতি না হলেও অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে পাসের হার ও জিপিএ-৫। এ অবস্থায় সঠিকভাবে খাতামূল্যায়নে নতুন পদ্ধতি চালু ও কঠোরতা অবলম্বন করলে ফলাফলে তার প্রভাব পড়বে বলেই ধারণা ছিল সকলের। খাতামূল্যায়নে নতুন উদ্যোগ কার্যকর করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সেসিপ প্রকল্পের একটি ইউনিট। বেদুর উদ্যোগে বাস্তবায়িত নতুন পদ্ধতিতে খাতা যথাযথভাবে মূল্যায়ন হওয়ায় পরীক্ষায় পাসের হার কমেছে। কমেছে বেশ কিছু সূচক। নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি কার্যকর করার জন্য আগামী আরও দু‘এক বছর পাসের হার কমবে বলেও ধারণা করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, ফলাফল কিছুটা আগের তুলনায় খারাপ হলেও সঠিক খাতামূল্যায়ন জরুরী হয়ে পড়েছিল। যুগের পর যুগ ধরে একটি ত্রুটিপূর্ণ খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি ছিল যার পরিবর্তনের ফলে পরীক্ষার সঠিক ফল পাওয়া গেছে। ভবিষ্যতে আরও কঠোরভাবে উদ্যোগ কার্যকর হবে বলেও জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ এক্সামিনেশন ডেভেলপমেন্ট ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন পদ্ধতিতে একটি পরীক্ষা পর্যালোচনা পর্ষদ করে সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার ব্যবস্থা হয়। একই খাতা ২০টি ফটোকপি করে দেয়া হয় দেশের ২০ জন সেরা পরীক্ষককে। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে আলাদাভাবে নম্বর নেয়া হয়। দেখা যায়, ২০ জনই ২০ ধরনের নম্বর দিয়েছেন। একজন ছাত্র ৪ পাচ্ছে, আরেকজন ছাত্র এখানে সাত পেয়ে যাচ্ছে। তাহলে কত পার্থক্য হয়ে যাচ্ছে। কর্মকর্তারা বলেছেন, আগেই আমরা বলেছি, যিনি প্রধান পরীক্ষক, তিনি আসলে খাতা দেখেন না। একটা রিপোর্ট দিয়ে দেন। আবার যিনি খাতা দেখেন, তিনিও ভাল করে দেখেন না। বোঝা যায়, অনেক সময় তিনি এটা ওজন করে দিয়ে দিলেন, কত পাতা লিখেছে সেই পরিমাণে। এটা হলে তো সত্যিকার অর্থে আমাদের ছেলেমেয়েদের মূল্যায়ন সঠিকভাবে হচ্ছে না। এতে সে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কিংবা সে একটা বাড়তি সুযোগও পেয়ে যেতে পারে। এসব চিন্তা মাথায় রেখেই নতুন পদ্ধতি। জানা গেছে, বিভিন্ন মানের সাড়ে ১২ শতাংশ খাতা বিভিন্ন জনকে দেখানো হয়েছে। খাতা দেখার পরে মিলিয়ে দেখা হয়েছে যে ঠিক হচ্ছে কি হচ্ছে না। প্রধান পরীক্ষকের খাতা দেখার জন্য শিক্ষক ও শিক্ষাবিদদের রাখা হয় যারা এটা মূল্যায়ন করবেন। যাতে দেখা যায় তারা (প্রধান পরীক্ষক) ঠিকমতো খাতা দেখেছেন কিনা। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক শেষ একরামূল কবির ফলাফলকে দেখছেন অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে। তিনি বলছিলেন, বছরের পর বছর ধরে পাতাগুনে নম্বর দেয়ার মতো একটি প্রবণতা তৈরি হয়েছিল। খাতা মূল্যায়ন হয়নি যথাযথভাবে। প্রশ্ন ও পরীক্ষা পদ্ধতিতেও হয়ে পড়েছিল মানহীন। শিক্ষার মানে অগ্রগতি না হলেও খাতা মূল্যায়নে দুর্বলতার কারণে বছরের পর বছর ধরে অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে পাসের হার ও জিপিএ-৫। এ অবস্থায় সঠিকভাবে খাতামূল্যায়নে নতুন পদ্ধতি চালু ও কঠোরতা অবলম্বন করলে ফলাফলে তার প্রভাব পড়বে বলেই ধারণা ছিল সকলের। এখন নতুন একটি সঠিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে পাবলিক পরীক্ষা। এতে পাসের হার ও জিপিএ-৫ সামান্য কমলেও এই মূল্যায়নটিই সঠিক। এ প্রক্রিয়াকে ধরে রাখার তাগিদ দিয়ে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক এ মহাপরিচালক বলছিলেন, নতুন প্রক্রিয়ার কারণে একটি ‘ট্রানজিট পিরিয়ড’ চলছে। কয়েক বছর পাস ও জিপিএ-৫ কমতে পারে। তবে এই ফলই পজিটিভ। একটির স্থিতিশীল অবস্থায় চলে আসবে ফল। এরপর শীঘ্রই আবার আস্তে আস্তে সাফল্য আসবে পাসের হার ও জিপিএ-৫সহ অন্যান্য সূচকেও। পরীক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তনের কারণে সূচক খানিকটা কমলেও এ পরিবর্তনকে সময়োপযোগী বলে উল্লেখ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। বলেছেন, মাধ্যমিকের মতো উচ্চ মাধ্যমিকেও সঠিক খাতা মূল্যায়ন জরুরী হয়ে পড়েছিল। যুগের পর যুগ ধরে একটি ত্রুটিপূর্ণ খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি ছিল যার পরিবর্তনের ফলে এখন পরীক্ষার সঠিক ফল পাওয়া গেছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার বলছিলেন, নতুন পদ্ধতিতে পরীক্ষক চাপের মধ্যে থাকেন, কারণ তার খাতা আবার দেখা হতে পারে। এজন্য তাকে কঠোর পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে। খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কোন পরীক্ষকের ফাঁকি দেয়ার সুযোগ থাকে না। শতভাগ হয়ে গেছে এটা আমি বলছি না। সেই দিক থেকে বলা যায় বিরাট পরিবর্তন এখানে এসেছে। নতুন পদ্ধতিতে একই ধারায় নম্বর দেয়ার কারণে তুলনামূলকভাবে অন্য বছরের চেয়ে বেশি ফেল করেছে। তবে এ বিষয়টি আমাদের কাছে কাম্য ছিল। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ফলাফল নিয়ে কথা বলছিলেন বাংলাদেশ বেসরকারী কারিগরি শিক্ষক সসিতি ফেডারেশনের সভাপতি ও শ্যামলী আইডিয়াল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ এম এ সাত্তার। তিনি বলছিলেন, মাধ্যমিকের মতো উচ্চ মাধ্যমিকেও তার প্রতিষ্ঠানে ফল খুবই ভাল। তবে সরকারের নেয়া নতুন খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি ছাড়াও কেন্দ্রে পরীক্ষা গ্রহণে কঠোরতা অবলম্বন ও প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার কারণে সারাদেশে পাসের হার কিছুটা কমেছে। নতুন এ উদ্যোগ দেশের শিক্ষার জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলে মত তার। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ছায়েফ উল্লাহ বলছিলেন, পাসের হার কমেছে তবে আমরা খাতা মূল্যায়নে সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করেছি। এটা শিক্ষার জন্য খুবই ভাল একটা উদ্যোগ। এদিকে মাধ্যমিকের মতো উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলেও কিছুটা প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে মানবিক বিভাগের ফল। ইংরেজী ও গণিতও কিছুটা প্রভাব পড়েছে। বেশ কয়েকটি বোর্ডে এবার এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পাসের হার কমে যাওয়ায় কমেছে মোট পাসের হার কিছুটা কমেছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, যে বছর গণিত ও ইংরেজীতে শিক্ষার্থীরা ভাল করছে সে বছর মোট পাসের হারও বেড়েছে। খারাপ করলে কমে যাচ্ছে পাসের হার।
×