ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রবৃদ্ধির হার ১১৫ শতাংশ

আস্থার সঙ্কট না থাকায় ভারতে সব ধরনের পণ্য রফতানি বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ১৯ জুলাই ২০১৮

আস্থার সঙ্কট না থাকায় ভারতে সব ধরনের পণ্য রফতানি বাড়ছে

এম শাহজাহান ॥ আস্থার সঙ্কট দূর হওয়ায় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সব ধরনের পণ্য রফতানি বাড়ছে। সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরের শেষ সময়ে রেকর্ড পরিমাণ গার্মেন্টস পণ্য রফতানি হয়েছে ভারতে। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হার ১১৫ শতাংশ পর্যন্ত, যা এ যাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। দেশটিতে রফতানি বাড়ার পেছনে পাঁচটি বিষয় সবচেয়ে বেশি কাজ করছে বলে মনে করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে-দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সরকার টু সরকারের ধারাবাহিক বৈঠক ও সমস্যা সমাধানে দু’দেশের আন্তরিকতা, লেনদেনে আস্থার সঙ্কট দূর হওয়া, শুল্ক-অশুল্কজনিত জটিলতার অবসান, নতুন উদ্যোক্তাদের রফতানিতে আগ্রহ তৈরি হওয়া, বড় ব্র্যান্ডগুলোর ভারতে নতুন নতুন শোরুম চালু করা। এছাড়া উৎপাদিত পণ্যের গুনগতমান উন্নত হওয়ায় রফতানিতে ইতিবাচক ধারা তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। সূত্রমতে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। মূল লক্ষ্য, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ব্যবধান কমিয়ে আনা। এজন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ভারতের বাজারে রফতানি বাড়াতে বিভিন্ন তৎপরতা শুরু করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে কয়েকবার ভারত সফর করেছেন। একইভাবে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। এছাড়া সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল ও ব্যবসায়ী সমাজ নিয়মিত ভারতের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এসব কারণে অন্যান্য পণ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের পোশাকের চাহিদা বেড়েছে। ভারতের ক্রেতারা বাংলাদেশের প্রতিই বেশি আগ্রহী। কারণ, ভারতে পোশাক নেয়ার ক্ষেত্রে লিড টাইমের বিষয়টি অনেক সুবিধাজনক। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রধান পণ্য তৈরি পোশাকের রফতানি বেড়েছে ১১৫ শতাংশ। এ সময়ে বিশ্ববাজারে পোশাক রফতানি বেড়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। শুধু পোশাক নয়, ভারতে সব ধরনের পণ্য রফতানি বেড়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ পর্যন্ত। বাংলাদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি নিয়ে উচ্চাকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে ৬০ বিলিয়ন ডলার রফতানি করতে হবে। এ লক্ষ্যে ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের রফতানি বাণিজ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য আরও বাড়ানো প্রয়োজন। বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশটির সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়েছে। রফতানি বাড়ার পাশাপাশি ভারতের বিনিয়োগও আসা শুরু হয়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং বিজিএমইএর ডাটা বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত অর্থবছরে ভারতে পোশাক রফতানি থেকে আয় এসেছে ২৮ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১৩ কোটি ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যা ছিল ১৪ কোটি ডলার। দেশটিতে নিট (গেঞ্জি জাতীয়) পোশাকের তুলনায় ওভেনের (শার্ট, প্যান্ট) চাহিদা দ্বিগুণেরও বেশি। আলোচ্য সময়ে ওভেন রফতানি থেকে এসেছে ২১ কোটি ডলার। বাকি ৭ কোটি ডলারের কিছু বেশি আয় এসেছে নিট রফতানি থেকে। উদ্যোক্তাদের মতে, পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা লিডটাইম। সাধারণত রফতানি আদেশ পাওয়ার পর কাঁচামাল আমদানি, উৎপাদন এবং সরবরাহ করে থাকেন উদ্যোক্তারা। এতে অনেক বেশি সময়ক্ষেপণ হয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে লিডটাইম তিন মাসের মতো। অথচ চাইলে তিনদিনের মধ্যে ভারতে পণ্য পৌঁছানো সম্ভব। এ বিবেচনায় ভারতে আরও বেশি পরিমাণে পোশাক রফতানি করা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী জনকণ্ঠকে বলেন, ভারতে রফতানি বাড়ানোর উদ্যোগ বেশ আগের। রফতানিতে জিএসপি সুবিধা থাকলেও এতদিন সেভাবে হয়নি। এখন আস্থার সঙ্কট দূর হওয়ার পাশাপাশি শুল্ক-অশুল্কজনিত সমস্যাগুলো মিটে যাওয়ায় রফতানি বাড়ছে। তিনি বলেন, ভারত একটি বড় বাজার হতে পারে। সেখানে সব ধরনের ভোক্তা শ্রেণী রয়েছে। বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলোর শো-রুম খোলা হচ্ছে ভারতে। এ কারণে দেশটিতে রফতানি আরও বাড়বে। তবে এজন্য সব ধরনের নীতিগত সহায়তা দেয়া প্রয়োজন। আস্থার সঙ্কট দূর হচ্ছে ॥ গত ২০১০ সালে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি শুরু করে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান লিলিপুট। নয়া দিল্লীস্থ এ প্রতিষ্ঠানটি বছরে প্রায় ২০ মিলিয়ন পিস তৈরি পোশাক আমদানি করে বাংলাদেশের ২৪টি কারখানা থেকে। কিন্তু দীর্ঘদিনে ৪ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেনি এ প্রতিষ্ঠানটি। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে একটি কার্য বিবরণী সই হয় দিল্লীতে। তাতে লিলিপুট কিডসওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ৬ কিস্তিতে টাকা পরিশোধের অঙ্গীকার করেন। কিন্তু কোন টাকা পরিশোধ না হওয়ায় এক সময় আস্থার সঙ্কট বাড়তে থাকে। উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ থেকেও এ সঙ্কট সমাধানে উদ্যোগ নেয়া হয়। জানা গেছে, দীর্ঘদিনের এ সঙ্কট এখন দূর হয়েছে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থা ফেরাতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ভারতে তৈরি পোশাকসহ ৬৬ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধার কারণেই রফতানিতে গতি আসে। ভারতীয় বাজারে পোশাক রফতানি বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, বড় বাজার বিবেচনায় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো ভারতে শোরুম খুলেছে। এছাড়া ভারতে পোশাক নেয়ার ক্ষেত্রে লিডটাইমের বিষয়টি অনেক সুবিধাজনক। অন্য কারণের মধ্যে দেশটির রাজ্য থেকে রাজ্যে শুল্ক নিয়ে যে জটিলতা ছিল, তা সমন্বয় করা হয়েছে। ফলে এতদিনের রাজ্যভিত্তিক শুল্ক বাধা আর নেই। এসব কারণে ভারতের বাজারে রফতানি বাড়ছে। জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়তে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় গত নয় বছরে প্রথম ও দ্বিতীয় লাইন অব ক্রেডিট বা এলওসি চুক্তির আওতায় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি করে বাংলাদেশ। এছাড়া তৃতীয় এলওসির আওতায় আরও সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ভারত থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ হিসেবে পাওয়া যাবে। ১ শতাংশ সুদে আগামী ২০ বছরে ঋণের টাকা পরিশোধের সুযোগ পাচ্ছে বাংলাদেশ। এতে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকে ইতোমধ্যে ভারতীয় এই ঋণের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা হয়েছে।
×