ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১৯ জুলাই ২০১৮

নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে...। এই গানের বাণীর মতই না থেকেও সৃষ্টির আলোয় উজ্জ্বল তিনি। শরীরী অস্তিত্ব না থাকলেও বেঁচে আছেন আপন শিল্প ও সাহিত্যের ভুবনে। সরল রেখার মতই সহজ লেখায় মোহাবিষ্ট করেছিলেন পাঠক, দর্শককে। একই সঙ্গে সাহিত্য ও শিল্পকে ধারণ করে হেঁটেছেন বর্ণময় পথে। সমৃদ্ধ করেছেন এ দেশের সৃজনশীল প্রকাশনাশিল্পকে। তাঁর গল্প বা উপন্যাসের উদ্দীপক কিংবা রহস্যময় বুনটে বিভোর করে রেখেছিলেন পাঠককে। বিচিত্র বিষয়ের নাটক কিংবা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শিল্প রসিককে দিয়েছেন অফুরন্ত আনন্দ। এভাবেই ক্রমাগত সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশে সবচেয়ে জননন্দিত সাহিত্যিক হয়ে উঠেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। আজ বৃহস্পতিবার বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এই জনপ্রিয় লেখক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকারের ষষ্ঠ প্রয়াণবার্ষিকী। ২০১২ সালে ১৯ জুলাই বর্ষণসিক্ত রাতে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাড়ি জমান অদেখার ভুবনে। পাঠক, ভক্ত, পরিবার-পরিজন ও শুভানুধ্যায়ীদের অশ্রুধারায় সিক্ত হয়ে বিদায় জানান প্রিয় পৃথিবীকে। বৃষ্টি ও জ্যোৎস্নাপ্রিয় এই সাহিত্যস্রষ্টা নিজ হাতে গড়া নন্দনকানন নুহাশ পল্লীর লিচুতলার ছায়ায় শায়িত হন চিরনিদ্রায়। আজ লেখকের মৃত্যুদিবসে গাজীপুরের নুহাশপল্লীর লিচুতলায় তাঁর সমাধিক্ষেত্র ভরে উঠবে ফুলে ফুলে। ভক্ত ও অনুরাগীরা শুভেচ্ছা ও দোয়া কামনার মাধ্যমে লেখকের প্রতি জানাবেন তাদের অকৃত্রিম ভালবাসা। প্রতিটি জাতীয় পত্রিকায় তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে ছাপা হয়েছে প্রতিবেদন। লেখকের প্রয়াণবার্ষিকীতে টিভি চ্যানেলগুলো নাটকসহ নানা আয়োজনে জানাবে ভালবাসা ও শ্রদ্ধা। আত্মজৈবনিক গ্রন্থে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেনÑ ‘কল্পনায় দেখছি নুহাশ পল্লীর সবুজের মধ্যে শে^তপাথরের কবর- তার গায়ে লেখা- ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে’। সে কথাগুলো কাচের এপিটাফ করে তার সহধর্মিণী মেহের আফরোজ শাওন নিজের নক্সায় সাজিয়েছেন স্বামীর কবর। সেখানে আজ শাওন ও তার দুই শিশু পুত্র নিনিত ও নিষাদের ফুলের ছোঁয়া পাবেন তিনি। জনকণ্ঠকে শাওন জানান, মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নুহাশ পল্লীর পাশর্^বর্তী এতিমখানার অনাথ শিশুদের খাওয়ানো হবে হুমায়ূন আহমেদের পছন্দের খাবার। থাকবে কোরান তেলাওয়াত ও দোয়া প্রার্থনার আয়োজন। হুমায়ূন আহমেদের অনুজ লেখক ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবিব জানান, আজ সকালে তিনি ও তার বড় বোন সুফিয়া খাতুন নুহাশ পল্লীতে গিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন। বরাবরের মতো হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের প্রকাশনা সংস্থা অন্যপ্রকাশসহ কয়েকটি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারীরা লেখকের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানাবেন বলে জানান অন্যপ্রকাশের প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম। এর বাইরে হাজারও মানুষ নুহাশ পল্লীর লিচুতলায় বিনম্র শ্রদ্ধা জানাবেন প্রিয় লেখককে। হুমায়ূন ভক্তদের গড়া হিমু পরিবহন নামের সংগঠনের পক্ষ থেকে লেখকের প্রয়াণবার্ষিকীতে নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচী। পাঠক বিবেচনায় হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। উপন্যাসে নিজের প্রতিভার বিস্তার ঘটলেও তার শুরুটা ছিল কবিতা দিয়ে। এরপর নাটক, শিশুসাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, চলচ্চিত্র পরিচালনা থেকে শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর। লিখেছেন বেশ কিছু জনপ্রিয় গান। আর সাহিত্যের যে ক্ষেত্রেই নিজের পদচিহ্ন এঁকেছেন প্রত্যেকটিতেই দেখা পেয়েছেন সাফল্যের। বাংলা সাহিত্যে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর জনকও হুমায়ূন আহমেদ । ১৯৭২ সালে প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশের পরই ছড়িয়ে পড়ে তাঁর খ্যাতি । উপন্যাসে ও নাটকে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো বিশেষ করে ‘হিমু’, ‘মিসির আলী’, ‘শুভ্র’ তরুণ-তরুণীদের কাছে হয়ে ওঠে অনুকরণীয়। বলা হয়, তাঁর লেখা পছন্দ করেন না এমন মানুষও তাঁর নতুন লেখাটি ‘গোপনে’ পড়ে ফেলেন। দেশে এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়, যারা তাঁর অন্তত একটি নাটক বা চলচ্চিত্র দেখেননি কিংবা তাঁর কোন বই পড়েননি। জনপ্রিয়তার জগতে এখনও তিনি একক ও অনন্য। হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নবেম্বর নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। ডাক নাম কাজল। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজের প্রথম সন্তান তিনি। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা, আর মা ছিলেন গৃহিণী। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। খ্যাতিমান কম্পিউটার বিজ্ঞানী, শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর ভাই। সবার ছোট ভাই আহসান হাবীবও খ্যাতিমান কার্টুনিস্ট ও রম্যলেখক। ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রী গ্রহণ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। নব্বই দশকের মাঝামাঝি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করে লেখালেখিতে পুরোপুরি মনোযোগ দেন। হুমায়ুন আহমেদের লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে নন্দিত নরকে, লীলাবতী, কবি, শঙ্খনীল কারাগার, গৌরীপুর জংশন, নৃপতি, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি, দারুচিনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমনি, শ্রাবণ মেঘের দিন, জোছনা ও জননীর গল্প প্রভৃতি। তার পরিচালিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে আগুনের পরশমনি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, নয় নম্বর বিপদ সংকেত ও ঘেটুপুত্র কমলা। যেগুলো জয় করেছে দর্শক ও সমালোচকদের মন। টিভি নাট্যকার হিসেবেও হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন সমান জনপ্রিয়। আশির দশকের মাঝামাঝি তাঁর প্রথম টিভি নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ তাঁকে এনে দেয় তুমুল জনপ্রিয়তা। তাঁর হাসির নাটক ‘বহুব্রীহি’ এবং ঐতিহাসিক নাটক ‘অয়োময়’ বাংলা টিভি নাটকের ইতিহাসে অনন্য সংযোজন। নাগরিক ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’ এর চরিত্র বাকের ভাই যেন বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছিল টিভি দর্শকদের কাছে। বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৯৪ সালে অর্জন করেন দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘একুশে পদক’। আরও পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বহু পদক ও সম্মাননা। দেশের বাইরেও তাকে নিয়ে রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। তার প্রমাণ জাপান টেলিভিশন ‘এনএইচকে’ তাকে নিয়ে নির্মাণ করেছে পনেরো মিনিটের তথ্যচিত্র ‘হু ইস হু ইন এশিয়া’। ১৯৭৩ সালে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর নাতনি গুলতেকিন খানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন এবং গুলতেকিন দম্পতির চার ছেলে-মেয়ে। তিন মেয়ে নোভা, শীলা ও বিপাশা আহমেদ এবং ছেলে নুহাশ হুমায়ূন। দীর্ঘ ৩২ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটিয়ে ২০০৫ সালে বিবাহ বিচ্ছেদের মাধ্যমে তাঁরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এরপর তিনি অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন। এই পরিবারে জন্ম নেয় দুই সন্তান নিষাদ ও নিনিত হুমায়ূন। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে মরণব্যাধি ক্যান্সার ধরা পড়ে হুমায়ূন আহমেদের শরীরে। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে যান। সেখানে ২০১২ সালের ১৬ জুলাই তিনি চলে যান লাইফ সাপোর্টে। এর পরের ঘটনা শুধুই বেদনা। দুই বছর আগে আজকের এই দিনে বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে এগারোটায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। আকাশচুম্বী জনপ্রিয় এ লেখকের মৃত্যুতে পুরো দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। নিউইয়র্ক থেকে ২৩ জুলাই দেশে ফিরিয়ে আনা হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ। বিমানবন্দর থেকে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে। সেখানে লাখো মানুষের অশ্রুসিক্ত ভালবাসায় সিক্ত হন তিনি। এর পরদিন তাকে সমাহিত করা হয় তাঁর গড়ে তোলা নন্দনকানন নুহাশ পল্লীর লিচুতলায়। স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর থেকে জানান, দিনটি উপলক্ষে গাজীপুরের পিরুজালী এলাকার নুহাশ পল্লীতে কোরানখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলসহ নানা কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়েছে। নুহাশ পল্লীর আশপাশের মাদ্রাসা ও এতিমখানার ছাত্র, পরিবারের সদস্য এবং হুমায়ুন আহমেদের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন লেখকসহ প্রায় ৬শ’ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এ মিলাদ ও দোয়া মাহফিলে। নুহাশ পল্লীর ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বুলবুল জানান, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আশপাশের কয়েকটি মাদ্রাসা ও এতিমখানার ছাত্ররা নুহাশ পল্লীতে কোরান তেলাওয়াত করবে। পরে তারা কবর জিয়ারত ও দোয়ায় অংশ নেবে। ওই দিনের কর্মসূচীতে অংশ নিতে হুমায়ূন আহমেদের দুই সন্তান নিষাদ ও নিনিতসহ স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন বৃহস্পতিবার সকালে নুহাশ পল্লীতে পৌঁছাবেন। এ ছাড়া কথা সাহিত্যিকের পরিবারের লোকজন, ভক্ত, বন্ধুরা কবর জিয়ারত ও মিলাদে যোগ দেবেন। এ দিনে হিমু পরিবহনের কমপক্ষে ৬০ সদস্যের একটি দল হুমায়ূন আহমেদকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নুহাশ পল্লীতে আসবে। ইতোমধ্যে প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের কবর জিয়ারত ও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থী নুহাশ পল্লীতে আসছেন। বিশেষ করে হুমায়ূন ভক্ত তরুণ প্রজন্মের অনেক শিক্ষার্থীরা নুহাশপল্লীতে ভিড় করছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন শ্রেণী পেশার লোকও আসছেন নুহাশ পল্লীতে। হুমায়ুন আহমেদের এবারের মৃত্যুবার্ষিকীর আমন্ত্রণে অতিথিদের জন্য নুহাশ পল্লীতে প্যান্ডেল নির্মাণের কাজ করা হচ্ছে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পিরুজালী এলাকার বিভিন্ন মাদ্রাসা ও এতিমখানা থেকে দুই শতাধিক শিশু কোরান থেকে তেলাওয়াত করবেন। ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বুলবুল বলেন, মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের জন্য আপ্যায়নের আয়োজন চলছে। এতিম শিশু ছাড়াও বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত অতিথি, এলাকার লোকজন ও হুমায়ুন স্যারের পরিবারের লোকজন থাকবেন। বৃহস্পতিবার ভোরে হুমায়ুন স্যারের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন নুহাশ ও তার সন্তানরা নুহাশ পল্লীতে আসবেন। দিনটি ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হবে। ব্যবস্থাপক আরও জানান, নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় হুমায়ূন আহমেদের হাতেগড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠেও অনুরূপ কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। এ দিন বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বিদ্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন, প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, কোরান খতম, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলে অংশগ্রহণ করবেন।
×