ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশালে বিএনপির ভোট ভাগ হয়ে যেতে পারে

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১৯ জুলাই ২০১৮

বরিশালে বিএনপির ভোট ভাগ হয়ে যেতে পারে

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ বিএনপির মনোনয়ন বঞ্চিত প্রভাবশালী এক নেতা ও তার সমর্থকদের সঙ্গে ধানের শীষ প্রতীক পাওয়া মেয়র প্রার্থীর চলমান বিরোধের কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিশেষ সুবিধা নেয়ার কথা থাকলেও উল্টো নির্বাচনী পরিবেশ বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন নৌকা মার্কার প্রার্থী ও তার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির নেতৃবৃন্দরা। জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রইচ সেরনিয়াবাত জানান, অতীত নির্বাচনে বিএনপির প্রাপ্ত ভোট এবারই কেবল দুইভাগে ভাগ হতে যাচ্ছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত প্রার্থীর শক্ত অবস্থানের কারণে। পাশাপাশি ৩০ জুলাইয়ের নির্বাচন সামনে রেখে নৌকার পক্ষে গণজোয়ারের সৃষ্টি হওয়ায় বিরোধী প্রার্থীরা অপপ্রচার চালিয়ে সাধারণ ভোটারদের প্রভাবিত করে নির্বাচনী পরিবেশ বিঘেœর চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর মুখপাত্র মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলাল বলেন, নির্বাচনে সকল দলের প্রার্থীরা অংশগ্রহণ করায় পুরো নগরীজুড়ে যে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে বিএনপি প্রার্থী ও তাদের দলের কতিপয় কেন্দ্রীয় নেতা গণসংযোগে নেমে তা নষ্ট করে পুরো নগরীকে থমথমে করে তোলার চেষ্টা করছে। নৌকার গণজোয়ার দেখে তারা তাদের প্রার্থীর নিশ্চিত পরাজয় যেনে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশের ধুয়া তুলে ভোটের দিন সাধারণ ভোটাররা যাতে কেন্দ্রে না আসে সেই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তিনি আরও বলেন, সিটি কর্পোরেশনে একাধিকবার নির্বাচিত বিএনপির অসংখ্য কাউন্সিলররা নৌকার গণজোয়ার দেখে অতিসম্প্রতি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওয়ার্ড ভিত্তিক তাদের সমর্থকদের ভোট নৌকা প্রতীকে দেয়ার অঙ্গিকার করেছেন। বিষয়টি জানতে পেরে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর সমর্থকরা ওইসব কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিচ্ছে বলে শুনেছি। এটি সংঘাতে রূপ নিলে অত্যন্ত দুঃখজনক হবে। তাদের (বিএনপি) কারণে আমরা নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে আশঙ্কার মধ্যে রয়েছি। নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসন যেন এ দিকে নজর রাখেন। শতাধিক নেতাকর্মীর আওয়ামী লীগে যোগদান ॥ মহানগর ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মিজানুর রহমান মামুন মোল্লা ও যুবদল নেতা মোস্তাফিজুর রহমান সোয়েবের নেতৃত্বে যুব ও ছাত্রদলের শতাধিক নেতাকর্মীরা মহানগর আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। নগরীর ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকায় মঙ্গলবার বিকেলে নৌকা মার্কার সমর্থনে উঠান বৈঠক শেষে সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর হাতে ফুলের তোড়া উপহার দিয়ে যুব ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলাল, বঙ্গবন্ধু পরিষদের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা মাহবুব উদ্দিন আহম্মেদ বীর বিক্রম, মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু, এ্যাডভোকেট আফজালুল করিম প্রমুখ। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের অভিযোগ ॥ গণসংযোগে নেমেই বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বরিশাল সিটি নির্বাচনে ধানের শীষ মার্কার প্রধান সমন্বয়কারী মীর্জা আব্বাস বলেন, আমাদের নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রচারে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে। খুলনা ও গাজীপুরের মতো এখানেও তারা একই ইতিহাস সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। মঙ্গলবার বিকেলে ধানের শীষের প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ারকে সঙ্গে নিয়ে গণসংযোগকালে গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করে মীর্জা আব্বাস আরও বলেন, তারা শহরে গাড়িতে করে প্রচার চালিয়ে গেলেও আমাদের গাড়িতে লাগানো পোস্টার খুলে নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করার কথা বলতে হবে কেন। বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হচ্ছে সেভাবে নির্বাচন করতে হবে। বিএনপি মনোনীত ধানের শীষ মার্কার প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, ৩০ জুলাইয়ের নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে মানুষ হতাশায় ভুগছে তারা ভোট দিতে পারবে কী না। তিনি আরও বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীদের প্রচারে বাঁধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ অবস্থায় ভোট সুষ্ঠু হবে কী না তা নিয়ে শঙ্কা বিরাজ করছে। বিএনপি প্রার্থীর ২৮ দফা ইশতেহার ঘোষণা ॥ ৩০ জুলাই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী ও কেন্দ্রীয় বিএনপি নির্বাহী কমিটি যুগ্ম মহাসচিব এ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার বুধবার বেলা সাড়ে এগারোটায় তার নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। ২৮ দফা নির্বাচনী ইশতেহারে তিনি বলেন, নগরবাসী তাদের মূল্যবান ভোট দিয়ে আমাকে নির্বাচিত করলে আমি বরিশালের সর্বস্তরের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সন্ত্রাস ও মাদক মুক্ত করব। এ ছাড়া নগরীর নদী-খাল সচল রেখে উন্নয়ন সচল, শহর রক্ষাবাঁধ নির্মাণ দ্রুত সম্পন্ন, নগরীর খালগুলো দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধার, নগরীতে শিশু ও নবীনদের জন্য বিনোদন পার্ক স্থাপন, মুক্তিযোদ্ধা এবং ইমামদের বিশেষ সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে নগরী পরিচালনা করব। জেলা ও মহানগর বিএনপি দলীয় কার্যালয়ে ধানের শীষের প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার নিজেই ইশতেহার পাঠ করেন। জাপা প্রার্থীর গণসংযোগ ॥ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনীত লাঙ্গল প্রতীকের মেয়র প্রার্থী বিশিষ্ট শিল্পপতি ও শিক্ষানুরাগী ইকবাল হোসেন তাপস প্রচারে নবমদিনে বুধবার দুপুরে গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, আমি বরিশাল নগরবাসীকে কোন ধরনের মিথ্যা ফুলঝুরির আশ্বাস দিয়ে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে চাই না। ৩০ জুলাইয়ের নির্বাচনে নগরবাসী আমাকে তাদের মূল্যবান ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলে আমি প্রথমেই নগরভবনকে সেবক ভবনে রূপান্তরিত করব। নগরীর সদর রোড, জেনারেল হাসপাতাল সড়ক, অমৃত লাল দে কলেজ, নতুন বাজারসহ নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জাপা প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপসের গণসংযোগে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তার নির্বাচনের প্রধান সমন্বয়ক ও পার্টির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক মহসিন-উল ইসলাম হাবুলসহ দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকেরা। মাঠে নেই মেয়র কামাল ॥ এখনও বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী মাঠে দেখা যায়নি মনোনয়ন বঞ্চিত বর্তমান সিটি কর্পোরেশনের বিএনপি দলীয় মেয়র আহসান হাবিব কামাল ও তার সমর্থকদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কামালপন্থী একাধিক নেতা বলেন, দল থেকে মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী না হলেও সরোয়ারকে তারা প্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে পারছে না। কারণ হিসেবে তারা বলেন, সব আলোচিত নির্বাচনে একজনই অংশ নেবেন, এভাবে অন্যদের বঞ্চিত করবেন তা তো হতে পারে না। সূত্রমতে, গত ২৮ জুন সরোয়ার যখন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তখন মনোনয়ন বঞ্চিত এবায়দুল হক চাঁন, বিলকিস আক্তার জাহান শিরিন ও বর্তমান মেয়র আহসান হাবিব কামালের অনুপস্থিতি নিয়ে কথা উঠে বিএনপিতে। এরপর চাঁন ও শিরিনকে কাছে টানার চেষ্টা করে সফল হন সরোয়ার। দল থেকে পুনরায় মনোনয়ন চেয়ে না পাওয়ার ব্যর্থতা নিয়ে মনোনয়ন জামাদান পরবর্তী প্রচারসহ ঘরোয়া কোন বৈঠকেও অংশগ্রহণ করেননি। এমনকি কামালের অনুসারীরাও রয়েছেন নীরব। এ নিয়ে দলীয় ফোরামের পাশাপাশি নগরী জুড়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। উৎসবের নগরী ॥ বুধবার নগরী ঘুরে দেখা গেছে, প্রচার মুখর গোটা বরিশাল নগরী। পোস্টারে ছেয়ে গেছে অলিগলি। রাত পর্যন্ত মাইকে বাজছে প্রার্থীদের নিয়ে বানানো গান। এ নিয়ে বিরক্তও অনেকে। তবে সাময়িক অসুবিধা হলেও বেশির ভাগ নাগরিক বলছেন, এই সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। পাঁচ বছরে এই সময়টাই শুধু সাধারণ জনতার মূল্যায়ন করা হয়। নেতারা ছুটে আসেন আমাদের ঘরে। নগরীর প্রত্যন্ত বর্ধিত এলাকায় বুধবার সকালে গণসংযোগ করেছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কার মেয়র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। তিনি (সাদিক) জনকণ্ঠকে বলেন, সিটি নির্বাচনে সুষ্ঠু ও নিরপক্ষভাবে জনগণ যাকে খুশি তাকে ভোট দেবে। ৩০ জুলাই জনগণের ভোট উৎসব হবে। বরিশালের জনগণ উৎসবমুখর পরিবেশে উন্নয়নের বিবেচনা করে যাকে খুশি তাকে ভোট দিবেন। মেয়র ও কাউন্সিলর পদে তিন ভাই-বোন ॥ প্রার্থীদের প্রচারে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী মাঠ এখন সরগরম। যে যার মতো করে ভোটারদের কাছে গিয়ে দিচ্ছেন নানান প্রতিশ্রুতি। চাচ্ছেন নিজের ও পছন্দের মেয়র প্রার্থীর জন্য ভোট। তবে এরই মধ্যে চারজন কাউন্সিলর প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ীও হয়ে গেছেন। এর মধ্যে তিনজন সাধারণ ও একজন সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। সংরক্ষিত ৪ নম্বর (১০, ১১ ও ১২) ওয়ার্ডে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী আয়শা তৌহিদ লুনা তার পিতার পরিবার থেকে এবারের সিটি নির্বাচনে একাই অংশগ্রহণ করেননি। তার বয়সের দুই বছরের বড় ভাই বশীর আহমেদ ঝুনু জাপার বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে হরিণ প্রতীক নিয়ে মেয়র পদে এবং ছোট ভাই মারুফ আহমেদ জিয়া ঠেলাগাড়ি প্রতীক নিয়ে ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাদের সবার ছোট বোন তাসমিমা আহম্মেদ সংরক্ষিত ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তিনি তার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করায় আয়শা তৌহিদ লুনা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। নগরীর ১১ নম্বর ওয়ার্ডের শহীদ আলতাফ স্কুল সড়কের বাসিন্দা আহমেদ আলী ও ফিরোজা বেগম দম্পতির সন্তান তারা। তিন ভাই- বোন একই বাড়িতে থাকলেও রাজনৈতিক জীবনে আয়শা তৌহিদ লুনা মহানগর বিএনপির মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও মারুফ আহমেদ জিয়া বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বশীর আহমেদ ঝুনু জাতীয় পার্টির (জাপা এরশাদ) সদর উপজেলার সভাপতি ও জেলা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক।
×