ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

পাকিস্তানে নির্বাচন ॥ নাক গলাচ্ছে সেনাবাহিনী

প্রকাশিত: ০৭:২০, ১৮ জুলাই ২০১৮

পাকিস্তানে নির্বাচন ॥ নাক গলাচ্ছে সেনাবাহিনী

পাকিস্তানে জোর গুজব আগামী ২৫ জুলাই সে দেশে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সেনাবাহিনী সেটিতে নাক গলাবে এবং এর ফলাফল নির্ধারণের চেষ্টা করবে। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র জেনারেল আসিফ গফুর কঠোর ভাষায় এমন গুজব অস্বীকার করলেও পাহাড়সম তথ্য প্রমাণ আছে যা ঠিক এর উল্টোটাই বলে যে সেনাবাহিনী নানা ছদ্মাবরণে নাক গলাচ্ছে। সেনাবাহিনীর এমন ভূমিকা এবারই প্রথম নয়। ১৯৯০ সালে সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সরকারবিরোধীদের ক্যাশ টাকা যুগিয়ে পিপিপির পরাজয় ঘটিয়েছিল। দৃষ্টান্ত আরও আছে। এবারের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর নাক গলানোর টার্গেট নওয়াজ শরীফ যিনি গত বছর আদালতের রায়ে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারান। তবে তার দল পিএমএল (নওয়াজ) এখনও ক্ষমতায় আছে। নওয়াজের সঙ্গে আর্মির সম্পর্কটা একটু জটিল। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে সেনা সমর্থনে পিপিপি সরকারের পতন ঘটিয়েছিলেন নওয়াজ। ক্ষমতায় বসার কিছুদিন পরই সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার বিরোধ বাধে। পরিণতিতে ১৯৯৩ সালে সেনাবাহিনীর চাপে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন। পরের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দ্বিতীয়বার তিনি ক্ষমতায় এলেও ১৯৯৯ সালে সেনা অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। ২০১৩ সালে নওয়াজ আবার নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন এবং প্রথমদিকে না হলেও এক পর্যায়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার আবার বিরোধ বাধে। বরাবরের মতো বিরোধের বিষয় হচ্ছে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতির ওপর সিভিলিয়ানদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে কি থাকবে না। বলাবাহুল্য সেনাবাহিনী এই দুটি বিষয়কে নিজের একচ্ছত্র এলাকা বলে মনে করে। ফলে এই ইস্যুতে টানাপোড়েন চলে দুই পক্ষের মধ্যে। নওয়াজকে উৎখাতের লক্ষ্যে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের দল পিটিআইকে দিয়ে মাসাধিককাল ধরে রাজপথে বিক্ষোভ চালানো হয়। অন্য একদল বিক্ষোভকারীকে দিয়ে গত বছর এক কর্মব্যস্ত চৌরাস্তা অবরুদ্ধ করা হয়। সে সময় এক ছবিতে দেখা গেছে জনৈক জেনারেল বিক্ষোভকারীদের মধ্যে টাকা ছড়াচ্ছেন। শেষে গত বছর সুপ্রীমকোর্ট অসাধুতার অভিযোগে নওয়াজকে প্রধানমন্ত্রী পদের অযোগ্য ঘোষণা করে। তিনি ক্ষমতা হারান। সবশেষ রায়ে তার ১০ বছর জেল হয়েছে। সুপ্রীমকোর্টকে ওই পথে চালিত করার পেছনে সেনাবাহিনীর অদৃশ্য হাত যে কাজ করেছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নওয়াজ শরীফ আসন্ন নির্বাচনকে তাঁর প্রতি জেনারেলদের আচরণের ওপর একটা গণভোটে পরিণত করার চেষ্টা করছিলেন। গত মাসে তিনি খোলাখুলি অভিযোগ করেন যে সেনাবাহিনী ২০০৮ সালে ভারতে সন্ত্রাসী হামলায় সহযোগিতা করেছিল। সেনাবাহিনী তার সুবিধাজনক অবস্থানকে এবারের মতো বিপন্ন আর কখনও বোধ করেনি। এমন মন্তব্য করেছেন একজন জেনারেল। সেনাবাহিনী সিভিলিয়ান সরকারের পতনে কিভাবে কাজ করে তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ এ বছরের প্রথমদিকে সিনেটর নির্বাচন। নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে বেলুচিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের বেশ কয়েকজন পিএমএলএন দলীয় সদস্য স্বপক্ষ ত্যাগ করে সেনাপন্থী বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বিএপি) গঠন করে এবং পার্টি এরপর সিনেটে বেলুচিস্তানের বেশকিছু আসন দখল করে নেয়। তাদের বিদ্রোহে সরাসরি ইন্ধন যুগিয়েছিল আইএসআই। নতুন সিনেটররা যাদের সঙ্গে কখনই জোট হওয়ার কথা নয় তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পিএমএলের বিরুদ্ধে অনেক অঘটন ঘটিয়েছিল। পিটিআই নেতা ইমরান খান রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের কথা অস্বীকার করেন না। তিনি বলেন এই সমস্যার সমাধান শক্তিশালী সিভিলিয়ান সরকার যা কিনা তারই নেতৃত্বে হতে পারে বলে তিনি দাবি করেন। পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাবে নওয়াজের মুসলিম লীগ থেকে দলত্যাগের এক জোয়ার সৃষ্টি হলে তা থেকে ফায়দা লুটেছিল ইমরানের দল। অনেক রাজনীতিক ঘরোয়াভাবে স্বীকার করেছেন যে পিএমএলএন পরিত্যাগ করার জন্য তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ আনার হুমকি দেয়া হয়েছিল। ২০১৩ সালের নির্বাচনে পাঞ্জাবের ১৪৮টি আসনের মধ্যে পিএমএলএন ১১৬টিতে জিতেছিল। এবারের নির্বাচনে পিটিআই পাঞ্জাবে ভাল আসন পেলে ইমরানের কোয়ালিশন সরকারের নেতা হওয়ার উত্তম সম্ভাবনা আছে। এমন এক সরকার সেনাবাহিনীর কাছে অধিকতর বাঞ্ছনীয় হবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। এসব ব্যাপার নিয়ে যেসব মিডিয়া আউটলেট উচ্চবাচ্য করে থাকে তারা হয় বাণিজ্যিক সঙ্কটের শিকার। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি কেন্দ্র ‘জিও’কে রহস্যময়ভাবে বয়কট করেছিল কেবল কোম্পানিগুলো কারণ ‘জিও’ বিচার বিভাগের সমালোচনা করছিল ও নওয়াজের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করছিল। পিএমএলএনএর সমর্থক এক সাংবাদিক জুল বোখারিকে সম্প্রতি অপহরণ করে বেশ কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। উদারপন্থী সংবাদপত্র ‘ডন’-এর দেশব্যাপী বিতরণ ব্যবস্থায় বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এক সাংবাদিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছেন, ‘আমাদের মুক ১১০ ভাগ বন্ধ করে রাখা হয়েছে।’ সেনাবাহিনীর পরিকল্পনার পথে একমাত্র বাধা নওয়াজের প্রতি ভোটারদের বাহ্যত সমর্থন। তার সভা সমাবেশগুলোতে বিপুল লোকসমাগম হচ্ছিল। এক জরিপে দেখা যায় পিএমএলএন জাতীয় পর্যায়ে পিটিআইয়ের চেয়ে ১৩ পয়েন্ট এবং পাঞ্জাবে ২০ পয়েন্ট এগিয়ে। বস্তুতপক্ষে অনেক পাকিস্তানীই এখন সেনাবাহিনীর সমালোচনায় মুখর হয়েছে যা আগে শোনা যায়নি। নাগরিক অধিকার সংগঠনগুলো নির্বাচনে নাক গলানো বন্ধ করে সেনাবাহিনীকে এ ধরনের অপকর্ম থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানিয়েছে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×