ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মেক্সিকো ॥ দিন বদলের নির্বাচন

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ১৮ জুলাই ২০১৮

মেক্সিকো ॥ দিন বদলের নির্বাচন

মেক্সিকোর প্রচলিত রাজনীতির বৃত্ত ভেঙ্গে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০১৮-এর বিজয়ী বামপন্থী রাজনীতিবিদ এন্ড্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাডর। ভক্ত, অনুসারীদের প্রিয় ‘অ্যামলো’। ৫৩ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে তার এই ভূমিধস বিজয় বিস্ময়ের সৃষ্টি করলেও, বিষয়টি প্রত্যাশিতই ছিল। পরিবর্তনের হাওয়া বইছিল মেক্সিকোজুড়ে। নির্বাচনপূর্ব জরিপেও মিলছিল পরিবর্তনের ইঙ্গিত। বিস্ময়ের কারণ হতে পারে প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে তার প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান। নিকটতম প্রতিপক্ষ রিকার্ডো এ্যানাইয়ার প্রাপ্ত ভোট তার অর্ধেকেরও কম। ভোটের এই ব্যবধান গত ৮৯ বছর ধরে মেক্সিকোর রাজনৈতিক মানচিত্রের নিয়ন্ত্রক, শাসকদল পিআরআইয়ের জন্য একটি বড় আঘাত বলেই গণ্য হচ্ছে। অন্য অর্থে এ্যামলোর এই বিজয়কে মেক্সিকোর প্রচলিত ধারার রাজনীতির জন্যও সতর্ক সঙ্কেত বলা যায়। মেক্সিকো থেকে, ‘জড়সুদ্ধ দুর্নীতি উৎখাতের’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অ্যামলো। ভোটাররা আস্থা রেখেছেন তার প্রতিশ্রুতিতে। মেক্সিকো নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কট্টর অবস্থান সত্ত্বেও অ্যামলো কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার কথা বলেছেন বার বার। অ্যামলোর কাছে ভোটারদের প্রত্যাশা ছিল তিনিও ট্রাম্প তথা যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে কঠোর অবস্থান নেবেন। অ্যামলো সে পথে হাঁটেননি। বোঝা যায় তিনি আর দশটা রাজনীতিবিদের মতো নন। বরং বিজয়ের পর তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন- শুরু হলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন যাত্রা। যে সম্পর্ক হবে পারস্পরিক মর্যাদার ভিত্তিতে। মেক্সিকান অভিবাসীরা সেখানে বাস করবেন মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিয়ে। বিষয়টি যতটা না প্রয়োজনের তার চেয়ে বেশি পছন্দের। পাশাপাশি প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন, আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারকে শক্তিশালী করতে চাই, উৎপাদন বাড়াতে চাই; কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে চাই যাতে করে মেক্সিকানরা যে দেশে জন্মেছে সেখানেই সুখে-শান্তিতে বাস করতে পারে। সন্ত্রাস ও দুর্নীতির মুলোৎপাটনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অ্যামলো সেগুলোকে চিহ্নিত করেছেন দীর্ঘদিনের পচে যাওয়া রাজনীতির ফল বলে। তার স্পষ্ট উচ্চারণ; আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক অসাম্যের মূল কারণ দুর্নীতি। সন্ত্রাসের এই বিস্তারের মূলেও সেই দুর্নীতি। তিনি একটি শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে চান। হত্যাকা- কমিয়ে আনতে মানবাধিকার, ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে কাজ করার কথা বলেছেন। যা তার পূর্বসূরি পেনা নিয়েটোর সময় ভয়াবহ বিস্তার লাভ করেছে। অ্যামলো নির্বাচনের পুরোটা পথ নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছেনÑ আর ভোটাররাও তাকে ফিরিয়ে দেয়নি। ফলাফল ঘোষণার দু’ঘণ্টার মধ্যেই তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বীরা। রীতিমতো ভাসছেন অভিনন্দনের বন্যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইটারে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘আমি আপনার সঙ্গে কাজ করার জন্য মুখিয়ে আছি। আমাদের দু’দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে এমন অনেক কিছুই করার আছে।’ কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো জানান, আপনার নেতৃত্বে আমাদের দু’দেশের মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক আরও নিবিড় হবে। প্রতিটি মানুষের জন্য কাজের ব্যবস্থা, সাম্য ও মানবাধিকারের জন্য আমরা একসঙ্গে কাজ করব। তবে অ্যামলোর কাছে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বার্তাটি এসেছে তার দীর্ঘদিনের বামপন্থী ইউরোপীয় মিত্র যুক্তরাজ্যের লেবার নেতা জেরেমি করবিনের কাছ থেকে। করবিন বলেন, ‘আজকের দিনটি মেক্সিকোর জন্য নিয়ে এলো পরিবর্তনের বার্তা, শুরু হলো নতুন যাত্রা। আমি নিশ্চিত তিনি হবেন সবার প্রেসিডেন্ট।’ এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায় অ্যামলোর বিজয়ে কেবল মেক্সিকোতে নয়, বামপন্থী রাজনীতির পালে হাওয়া লাগবে ইউরোপসহ অন্যত্রও। স্প্যানিশ অভিবাসী পরিবারের সন্তান অ্যামলোর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার চল্লিশ বছরেরও বেশি। ১৯৭৬-এ পিআরআইতে যোগ দিয়ে নেতৃত্বের কাতারে আসেন নব্বইয়ের দশকে। এবারের নির্বাচনে অংশ নেন নবগঠিত মোরেনা পার্টির হয়ে। সন্ত্রাসের থাবা ছুয়ে গেছে তার পরিবারকেও, বড় ভাই হোসে র‌্যামোনকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে ১৯৬৯-এ। রাজনীতিতে পা রাখার আগে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও জনপ্রশাসনে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন মেক্সিকো সিটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসেন জুলাই ২, ২০০০-এ মেক্সিকো সিটির মেয়র নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে। ছয় বছর চেয়ারে থাকাকালীন অপরাধ বিষয়ে জিরো টলারেন্স, উন্নয়নমূলক সামাজিক কর্মকা- বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নিয়ে দৃষ্টি কাড়েন। জরিপে ৮৪% শতাংশ জনসমর্থন থাকার পরও সবাইকে অবাক করে দিয়ে মেয়র পদে আর দাঁড়াননি। পরবর্তীতে ২০০৬ ও ২০১২তে প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়িয়ে পরাজিত হন। এবারের নির্বাচন ৮ কোটি ৯০ লাখ মেক্সিকান ভোটারের জন্য ছিল রাজনৈতিক এলিট ও তাদের প্রবর্তিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্ন। পূর্বের দুটো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজয়ের পরও তৃতীয়বার তাকে সমর্থনের কারণ জানাতে গিয়ে মারিয়া কারমেন বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরেই তার সমর্থক, আমি তাকে বিশ্বাস করি আর আমাদের সরকার পচে গেছে। আমি বৃদ্ধ হয়েছি কিন্তু আমাদের তরুণদের সামনে এমন কাউকে চাই যাকে তারা বিশ্বাস করতে পারে। ভরসা রাখতে পারে।’ তরুণ প্রজন্ম যারা বেড়ে উঠেছে দুর্নীতি আর মাদক সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে এবারের নির্বাচীন পালাবদলে রেখেছে বড় ভূমিকা। ১৮-২৩ বছর বয়সী ১ কোটি ৩০ লাখ ভোটার এবার ব্যাপক সাড়া দিয়েছেন অ্যামলোর আহ্বানে, তাদের এই সাড়া ছিল সুচিন্তিত। মেক্সিকো সিটি মেয়র হিসেবে অ্যামলোর রেকর্ড তারা বিবেচনায় রেখেছেন। তরুণ ম্যানুয়েল লোপেজ বলেন, ‘অ্যামলোই প্রথম সকল সিনিয়র সিটিজেনের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা করেছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্কুল করে দিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ মনে হলেও এমন অনেক কিছুই তিনি করেছেন যা বদলে দিয়েছে আমাদের জীবন।’ অ্যামলো জানেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনেক মতপার্থক্য আর বিভেদের পাশাপাশি তাকে মোকাবেলা করতে হবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সীমান্ত দেয়াল বা নাফটা চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি। ভোটারদের কাছে অ্যামলোর দাবি ছিলÑ ট্রাম্পের হুমকি মোকাবেলায় তিনিই সঠিক ব্যক্তি। তার লেখা একটি বইয়ের শিরোনামও,‘ওয়ে ট্রাম্প’ বা ‘শোন ট্রাম্প।’ পপুলিস্ট প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে তিনি গুঁড়িয়ে দিতে চান মাফিয়ার ক্ষমতার দূর্গ। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সরকারী উচ্চপদে বেতন কমিয়ে ছোট কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির। অ্যামলো পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন তার সময়ে রাষ্ট্রপতি বাসভবন উন্মুক্ত থাকবে জনগণের জন্য। ব্যক্তি ইমেজ, রাজনৈতিক সততা, নীতির প্রশ্নে অবিচল অবস্থান ১৯৮০-এর পর কোন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অ্যামলোকে করেছে সর্বোচ্চ ব্যবধানে বিজয়ী। ৬৪ বছর বয়সী অ্যামলো, আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন এ বছরের ১ ডিসেম্বর। ফলাফল ঘোষণার পর মধ্যরাতে মেক্সিকো সিটির জোকালো সিটি সেন্টারে সমবেত সমর্থকদের অ্যামলো বলেন, ‘আমি স্বৈরশাসক হব না। একটি কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য আমাদের যাত্রা আজ শুরু হলো। আমি ইতিহাসে একজন ভাল প্রেসিডেন্ট হয়ে বেঁচে থাকতে চাই।’ এখন দেখার অপেক্ষা, সন্ত্রাস-দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত মেক্সিকোর সমাজ ব্যবস্থায়, হাজারো বিপরীতমুখী রাজনৈতিক সমীকরণের সমন্বয় ও খুদে স¤্রাট ‘ড্রাগ লর্ড’দের মোকাবেলা করে ‘অ্যামলো’ ইতিহাসে কীভাবে ঠাঁই করে নেন। সূত্র: সিএনএন
×