ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বৃদ্ধাশ্রম, শোবিজ মিডিয়ার আড়ালে সংঘবদ্ধ চক্রের ব্ল্যাকমেলিং

বনানীর মধুকুঞ্জে যেভাবে খুন হন পুলিশ ইন্সপেক্টর মামুন

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৮ জুলাই ২০১৮

বনানীর মধুকুঞ্জে যেভাবে খুন হন পুলিশ ইন্সপেক্টর মামুন

শংকর কুমার দে ॥ মায়ের আঁচল বৃদ্ধাশ্রম, শোবিজ মিডিয়া, বায়িং হাউস ইত্যাদি নামের আড়ালে রাজধানীর বনানীর ভাড়া করার ফ্ল্যাটটিকে বানানো হয় অসামাজিক কার্যকলাপ চালানোর এক মধুকুঞ্জ। এই মধুকুঞ্জে চলত নিয়মিত মদ্যপান, ইয়াবা সেবন, নাচ গানের জলসা। ওই জলসা ঘরের আকর্ষণ ছিল কথিত মডেল ও অভিনেত্রী নামের এক শ্রেণীর নারী। প্রলোভনের টোপে ফেলে ওই জলসা ঘরে নিয়মিত আনা হতো ধনাঢ্য ব্যক্তিদের। এরপর ব্ল্যাকমেল করে বিরাট অঙ্কের টাকা আদায় করত একটি চক্র। এই চক্রের হোতা ছিল শেখ হৃদয়। এক অভিনেত্রীর জন্মদিন পালন করা হবে এমন কথা বলে ওই জলসা ঘরে এনে নির্দয় ও নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর মামুন ইমরান খানকে। একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর হত্যাকা-ের তদন্ত করতে গিয়ে রাজধানীতে কিভাবে অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপ চালানো হচ্ছে তার নেপথ্যের কাহিনী বের হয়ে আসছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর বনানীর ২/৩ সড়কের ৫ নম্বর ভবনের এ-২ ফ্ল্যাটটিকে ৪৫ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়ে মধুকুঞ্জ বানানোর চক্রের প্রধান হোতা ছিল শেখ হৃদয়। ওই বাসায় শেখ হৃদয়ের স্ত্রী পরিচয় দিয়ে এক নারীসহ আরও কয়েকজন নারী নিয়মিত যাতায়াত করত। তার নেতৃত্বে দীর্ঘদিন ধরে তৎপর ছিল একটি প্রতারক গ্রুপ। তারা অভিজাত এলাকার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে কথিত মডেল, অভিনেত্রীদের দিয়ে ওই ফ্ল্যাটে অসামাজিক কার্যকলাপ চালাত। পুলিশ ইন্সপেক্টর মামুন হত্যাকা-ের তদন্ত করতে গিয়ে বের হয়ে আসে ফাঁদ পেতে নিয়মিত অর্থ আদায় চক্রের কথিত মডেল ও অভিনেত্রীসহ ১০-১২ জনের এই সংঘবদ্ধ সদস্য। এই চক্রটি ফাঁদ পেতে বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে অর্থ আদায় করত। নজরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি এই চক্রের মূলহোতা। চলতি বছরের মে মাসে বনানীর ২/৩ সড়কের ৫ নম্বর ভবনের এ-২ ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেয় নজরুল। সেখানে বায়িং হাউস ও মায়ের আঁচল নামে একটি বৃদ্ধাশ্রমের প্রধান কার্যালয় ও শোবিজ মিডিয়ার কার্যালয় হিসেবে ব্যবহারের কথা বলে শেখ হৃদয় ওরফে আপন ওরফে রবিউলকে এই কার্যালয় চালানোর দায়িত্ব দেয়া হয়। শেখ হৃদয় এই বাসায় নিয়মিত মদ-জুয়ার আসর বসাত। এসব আসরে থাকত কথিত অভিনেত্রী ও মডেল শেখ আন্নাফি ওরফে মেহেরুন নেছা ওরফে আফরিন, ফারিয়া বিনতে মিম ওরফে মাইশা ও সুরাইয়া আক্তার কেয়া। স্বপন, মিজান ও আতিক মিলে একটি সংঘবদ্ধ চক্র তৈরি করে। তারা মদ-জুয়ার আসরের আড়ালে কৌশলে এসব অভিনেত্রী ও মডেলদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছবি তুলে ব্ল্যাকমেল করত। এছাড়া অর্থের বিনিময়ে নিয়মিত দেহ ব্যবসাও চলতো এই বাসায়। ওই বাসাটি তালাবদ্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সূত্র জানায়, গত মে মাস থেকে ৪৫ হাজার টাকায় নজরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি বাসাটি ভাড়া নেয়। মিডিয়া হাউসের নামে বাসাটি ভাড়া নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৬০০ বর্গফুটের বাসাটিতে মাত্র একটি টেবিল, তিনটি চেয়ার ও অন্য কক্ষে একটি তোষক বিছানো হয়েছিল। এই মাসে তারা ইন্টেরিয়র ডিজাইন করবে বলে জানিয়েছিল। কিন্তু নিয়মিত ভাড়া না দেয়ায় তাদের বাসা ছেড়ে দিতে বলা হয়। ওই বাসায় শেখ হৃদয়ের স্ত্রী পরিচয় দিয়ে এক নারীসহ আরও কয়েকজন নারী নিয়মিত যাতায়াত করত। কথিত অভিনেত্রী ও মডেল আফরিন, ফারিয়া বিনতে মিম ওরফে মাইশা ও সুরাইয়া আক্তার কেয়া আগত ব্যক্তিদের সঙ্গ দিত মিডিয়া কার্যালয়ের আড়ালে। মিডিয়ার কার্যালয় বলে এলাকার লোকজন এসব বিষয়কে কিছু মনে করতেন না। সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হয়েছিল তাদের। কিন্তু এখানে একজনকে হত্যার পর সেই লাশ পুড়ে গুম করার চেষ্টা করা হতে পারে এমন বিষয় কল্পনাতেও ছিল না এলাকাবাসীর। শোবিজ মিডিয়ায় মাঝে মধ্যে অভিনয় করার সুবাদে রহমত উল্লাহর সঙ্গে পরিচয় ছিল মামুনের। রহমত উল্লাহ পেশায় প্রকৌশলী হলেও শোবিজ মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত। খুনের ঘটনার দিন রহমতের সঙ্গে ফোনে কথা হয় মামুনের। এ সময় রহমত তাকে মডেল ও অভিনেত্রী মেহেরুন নেছা আফরিন ওরফে আন্নাফি আফরিনের জন্মদিনের পার্টি আছে বলে জানায়। মোটরবাইক নিয়ে মামুন যায় বনানীর ২/৩ সড়কে। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করা রহমত তাকে নিয়ে যায় ওই সড়কের ৫ নম্বর বাসার এ-২ ফ্ল্যাটে। ওই ফ্ল্যাটেই আন্নাফি আফরিনসহ স্বপন, মিজান, আতিক, শেখ হৃদয় ওরফে আপন ওরফে রবিউল, সুরাইয়া আক্তার কেয়া, ফারিয়া বিনতে মীম ওরফে মাইশা অপেক্ষা করছিল। আগে থেকেই তারা একসঙ্গে ইয়াবা সেবন করেছিল। সেখানে মামুন ও রহমত যাওয়ার পর পূর্ব-পরিকল্পনা মতো অশ্লীল ছবি তুলে মামুনকে আটকে রেখে ব্যাকমেল করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করে সংঘবদ্ধ এই চক্র। কিন্তু মামুন নিজেকে পুলিশ পরিচয় দেন। এ সময় আগে থেকেই ইয়াবা সেবন করা সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্যরা তাকে বেদম মারধর করে। এতে অচেতন হয়ে যান মামুন। পরে রাতভর লাশের সামনে বসেই লাশ গুমের পরিকল্পনা করে এই চক্রের সদস্যরা। গাজীপুরের কালীগঞ্জের একটি জঙ্গলে মামুন ইমরান খানের বস্তাবন্দী লাশ ফেলে তাতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে আবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়ে গা-ঢাকা দেয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ ইন্সপেক্টর মামুন হত্যাকা-ের তদন্ত করতে গিয়ে হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় নানা ধরনের সাইনবোর্ড দিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপ চালানোর চক্রের সন্ধান পাওয়া যায়। এই চক্রের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে কথিত মডেল, অভিনেত্রী, শোবিজের অনেকের নাম। কথিত মডেল, অভিনেত্রী, শোবিজের আড়ালে অসামাজিক কার্যকলাপ গড়ে তোলার আখড়াগুলোতে মদ্যপান, ইয়াবা সেবন, নাচ গানের জলসা বসানো হয়, যাতে রাতের আঁধারের ওই জলসা ঘরের মধ্যমণি হয়ে আসেন সমাজের একশ্রেণীর মুখোশধারী ধনাঢ্য ব্যক্তি।
×