ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

২০৩০ সালের মধ্যে ৭৪ লাখ কোটি টাকা প্রয়োজন

উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে বাজেট বাস্তবায়ন শুরু

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ১৮ জুলাই ২০১৮

উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে বাজেট বাস্তবায়ন শুরু

এম শাহজাহান স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নতুন অর্থবছরের যাত্রা শুরু হয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে দেশকে সম্পূর্ণ দারিদ্র্যমুক্ত ও ব্যাপক কর্মসংস্থানে বিনিয়োগবান্ধব কর্মসূচী বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে নতুন বাজেটে। বিনিয়োগ বাড়াতে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হয়েছে। এসডিজি অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে ৭৪ লাখ কোটি টাকার বাড়তি প্রয়োজন হবে। এই অর্থের জোগানে সহযোগী দেশ ও উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি আঞ্চলিক বাণিজ্য জোটগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার এবং ব্যক্তি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার উদ্যোগ রয়েছে নতুন বাজেটে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, এসডিজি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চলতি বাজেটে বিশেষ কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। বাজেটে এসডিজি সম্পর্কিত খাতগুলোতে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়ার পাশাপাশি এডিপি বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ নজর দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও এসডিজি বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার রূপকল্প-২১ ঘোষণা করেছে। রূপকল্প-২১ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এসডিজি অর্জনের সব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস (এসডিজি) অর্জনে আগামী ২০২৪ সালের মধ্যে দেশকে পুরোপুরি দারিদ্র্যমুক্ত করতে চায় সরকার। এছাড়া বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়িয়ে রূপকল্প-২১ সালের মধ্যেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। এজন্য এসডিজির লক্ষ্যসমূহ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েই বাজেট বাস্তবায়ন করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি সচিবালয়ে এক বৈঠক শেষে জানান, এসডিজি বাস্তবায়নে অর্থায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অর্থের জোগানে সহযোগী দেশ ও উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রম বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, এসডিজি বাস্তবায়নে ব্যক্তি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য এবারের বাজেটে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলো সুদের হার নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়ে বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু করেছে। তিনি বলেন, দেশের দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সাল নির্ধারণ করা হলেও ২০২৪ সালের মধ্যেই দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব হবে। জানা গেছে, এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের বাড়তি প্রয়োজন হবে ৯২ হাজার ৮৪৮ কোটি ডলার বা টাকার অংকে প্রায় ৭৪ লাখ ২৭ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এসডিজির অর্থায়ন নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থায়নের জন্য ৮৫ দশমিক ১১ ভাগ বা প্রায় ৬৩ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করতে হবে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। অর্থায়নের জন্য সরকারী খাতের চেয়ে বেসরকারী খাতের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। এজন্য বছরে গড়ে ৬ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই আসতে হবে বাংলাদেশে যা বর্তমানে আসছে মাত্র গড়ে ২ বিলিয়ন ডলার। এ প্রসঙ্গে জিইডি সদস্য ড. শামসুল আলম জানিয়েছেন, এসডিজি বাস্তবায়নে বিভিন্ন খাতে কি পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন হবে তার একটি ধারণা দেয়া হয়েছে। সরকারীভাবে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় যে ব্যয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে সেটি অব্যাহত থাকলেও ৯২৮ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার বেশি ব্যয় করতে হবে ২০১৭ সাল থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত এই ১৩ বছরে। প্রসঙ্গত, এমডিজি অর্জনে সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদশে। চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নির্মূলসহ স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতে প্রশংসনীয় অর্জন করেছে। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমানো, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতে প্রতিবেশী দেশগুলো হতেও ভাল অর্জন করেছে। ২০১৫ সালের এমডিজি মেয়াদ শেষ হবার পর শুরু হয়েছে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠ বা এসডিজি। এর মূল লক্ষ্য হলো, এমডিজির লক্ষ্যগুলোকে টেকসই করা। এসডিজির ১৭টি উন্নয়ন অভীষ্টের জন্য ১৬৯টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনে সর্বমোট ২৪১টি নির্দেশক বা ইন্ডিকেটর রয়েছে। ইতোমধ্যে পাঁচটি খাত থেকে এসডিজির এই অর্থ জোগাড় করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হলো সরকারী ও বেসরকারী খাতের অংশগ্রহণ, সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্ব (পিপিপি), প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই), বৈদেশিক সহায়তা এবং এনজিও খাতের অর্থায়ন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪২ দশমিক ০৯ শতাংশ অর্থায়ন আসতে হবে বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ থেকে। এ ছাড়া সরকারী খাত থেকে ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ যোগান দিতে হবে। এদিকে, এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধামুক্তি, সুস্বাস্থ্য, মানসম্মত শিক্ষা, জেন্ডার সমতা, বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন, ব্যয়সাধ্য ও টেকসই জ্বালানি, সবার জন্য কর্মসংস্থান, উদ্ভাবন ও উন্নত অবকাঠামো, বৈষম্য হ্রাসকরণ, টেকসই শহর ও সম্প্রদায়, সম্পদের দায়িত্বশীল ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ, সমুদ্রের সুরক্ষা, ভূমির সুরক্ষা, শান্তি ও ন্যায়বিচার এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য অংশীদারিত্ব। এই ১৭টি লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করার জন্য বিশ্বের প্রায় সকল দেশ একমত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ জনকণ্ঠকে বলেন, এসডিজি অর্জন করতে হলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। গত ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর এমডিজি শেষ হয়েছে। এমডিজি ছিল সহায়তানির্ভর। সে জন্য বাংলাদেশ ছাড়া অনেক দেশই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। তবে এবারের লক্ষ্যমাত্রাগুলো খুব দর্শনভিত্তিক। এর মধ্যে বলা আছে মানুষের স্বাধীনতা, সাম্য ও মানবাধিকারের কথা। এতে দেশ ও দেশের অভ্যন্তরে মানুষে মানুষে সাম্য, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন ও সহমর্মিতার কথা বলা আছে। কাউকে বাদ না দিয়ে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে এগিয়ে যেতে হবে। দারিদ্র্য শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হবে ॥ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বতর্মান সরকারের লক্ষ্য আগামী ২০২৪ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা। যদিও আগামী ২০২১ সাল নাগাদ দারিদ্র্যের অনুপাত ১৩ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাংলাদেশের বিশেষ ভূমিকার স্বীকৃতি প্রদান করছে ফুড এ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন (এফএও। ইতোমধ্যে ৩৮টি দেশ ক্ষুধার বিরুদ্ধে যুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারণ করা মানদ- অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও জাতিসংঘের অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এমডিজি-৩ অর্জনে সফলতা পেয়েছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনেও সফল হবে। এছাড়া চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটেও দারিদ্র কমাতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ লক্ষ্যে বয়স্ক ভাতা, বিধাব ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, এতিম শিশু কল্যাণ তহবিল, প্রতিবন্ধী জরিপ, অটিজম রিসোর্স সেন্টার স্থাপন, ভিক্ষুক পুনর্বাসন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন, অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান, গৃহায়ন তহবিল, কাবিখা, আশ্রয়ণ, একটি বাড়ি একটি খামার, ঘরে ফেরা, বেকার যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান ব্যাংক, চর জীবিকায়ন কর্মসূচী, ক্ষুদ্রঋণ, প্রতিবন্ধী উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এসব কর্মসূচী গ্রহণ করার ফলে দারিদ্র্য মানুষের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।
×