ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হিসাবমান লঙ্ঘন করে জাহিন স্পিনিংয়ের রাইটের টাকা সংগ্রহ

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ১৮ জুলাই ২০১৮

হিসাবমান লঙ্ঘন করে জাহিন স্পিনিংয়ের রাইটের টাকা সংগ্রহ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি জাহিন স্পিনিং এবার বাংলাদেশ হিসাবমান (বিএএস) লঙ্ঘন করে শেয়ারবাজার থেকে রাইট ইস্যুর মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করতে যাচ্ছে। এ ছাড়া কোম্পানিটি নিয়মিত বোনাস শেয়ার দেয়া সত্ত্বেও রাইট শেয়ার ইস্যু করতে যাচ্ছে। অথচ আইপিও এবং বোনাস শেয়ারে নিয়মিত মূলধন বৃদ্ধি সত্ত্বেও কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি মুনাফা (ইপিএস) ও বিক্রয় কমেছে। নতুন আইনে বিএসইসি অবশ্য বোনাস শেয়ার ঘোষণার আগে কোম্পানিগুলোকে যথাপোযুক্ত ব্যাখা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে। এতে নগদ লভ্যাংশ প্রদানের হার বাড়বে। বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, গত কয়েক বছর ধরে নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যেই রাইট শেয়ার ঘোষণার হার বেড়েছে। কমিশনও কোন অজানা কারণে এই কোম্পানিগুলোকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে রাইট শেয়ার অনুমোদন দিয়েছে। সাইফপাওয়ার টেক, আরামিট সিমেন্ট, জিপিএইচ ইস্পাত, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের রাইটে শেয়ার ছাড়ার পর মুনাফা ও শেয়ার দর বিশ্লেষণ করলেই তা স্পট হয়েছে। বাংলাদেশ হিসাবমান (বিএএস) ৩৩ এর ৬৪ অনুযায়ী, পূর্বের বছরের শেয়ার প্রতি মুনাফা নির্ণয় করতে হয় বর্তমান শেয়ার দিয়ে এবং হিসাবমানে রিস্টেড ইপিএস বলে কিছু নেই। কিন্তু জাহিন স্পিনিং কর্তৃপক্ষ ইপিএস গণনায় এই হিসাবমান অনুসরণ করেনি। রাইট অফার ডকুমেন্টসের ১৯ পৃষ্ঠায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ইপিএস গণনায় ২০১৭ সালের ৩০ জুনের শেয়ারকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। যাতে ০.৮৯ টাকার ইপিএসকে বাড়িয়ে ১.০৩ টাকা দেখানো হয়েছে। একইভাবে ৪৩ পৃষ্ঠায় ২০১২ সালে ২.১৯ টাকা, ২০১৩ সালে ০.৬৭ টাকা, ২০১৪ সালে ০.৫২ টাকা ও ২০১৫ সালে ০.২৪ ইপিএস টাকা বেশি দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৬ সালের প্রথমার্ধে ইপিএস ০.০৮ টাকা বেশি দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে হিসাবমানে এমন কিছু না থাকলেও জাহিন স্পিনিং কর্তৃপক্ষ ১৯ ও ৪৩ পৃষ্ঠায় রিস্টেড ইপিএস দেখিয়েছেন। ডিএসইর তথ্যানুসারে, আইপিওতে ১২ কোটি টাকা সংগ্রহের পরে ৬৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা মূলধনের জাহিন স্পিনিংয়ে পরিচালকদের মালিকানা দাঁড়ায় ৪৪.৩৮ শতাংশ। তবে এখন কমে এসেছে ৩১.১০ শতাংশে। এর মধ্যে পরিচালক সাদিয়া আমিন পদত্যাগ করেছেন। যার শেয়ার ধারণ ছিল ৩.৮৩ শতাংশ। এ হিসেবে বর্তমান পরিচালকেরা কোম্পানিটির ধারণকৃত ৯.৪৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রয় করে দিয়েছেন। চেয়ারম্যান ফরিদা খানমের আইপিও পরবর্তী জাহিন স্পিনিংয়ের শেয়ার ধারণ ছিল ৭.৫৯ শতাংশ। তবে তা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৫.৭৪ শতাংশে। এ ছাড়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএম বদরুজ্জামান খশরুর ১৮.০৩ শতাংশ থেকে কমে ১৩.৬৩ শতাংশে, পরিচালক মাহমুদুর রহমানের ১১.১১ শতাংশ থেকে কমে ৮.৪০ শতাংশে ও নুশরাত জাহানের ৩.৮৩ শতাংশ থেকে কমে ৩.৩৩ দাঁড়িয়েছে শতাংশে। পরিচালক ফরিদা খানম ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ৭.৩৮ লাখ শেয়ার তার ছেলে মাহবুবুর রহমানের খানের কাছে হস্তান্তর করে। একইদিনে বদরুজ্জামান খশরু ১৭.৫২ লাখ শেয়ার তার মেয়ে মাসুমা খানের কাছে ও মাহমুদুর রহমান তার বোন মাসুমা খানের কাছে ১০.৮০ লাখ শেয়ার হস্তান্তর করে। কোম্পানিটি এবারও ব্যবসায় সম্প্রসারণের নামে ১টি সাধারণ শেয়ারের বিপরীতে ১টি রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ৯৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা সংগ্রহ করতে চায়। যা দিয়ে এবারও ব্যবসায় সম্প্রসারণ করবে বলে জাহিন স্পিনিংয়ের দাবি। এ ছাড়া চলতি মূলধন ও ঋণ পরিশোধের কাজে ব্যবহার করা হবে। ব্যবসায় উন্নতি করার লক্ষ্যে নিয়মিত বোনাস শেয়ার প্রদান করলেও তা সম্ভব হয়নি। বরং মুনাফা কমেছে। যাতে শেয়ারহোল্ডাররা লাভবান হতে পারেনি। এ ছাড়া কোম্পানিটির শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের চাহিদা কম থাকার কারণে বাজার দরও কমে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা আশাহত। শেয়ারবাজারে আসার সময় কোম্পানিটির ২০১৪ সালের প্রথমার্ধে ইপিএস হয়েছিল ১.০১ টাকা। তবে কোম্পানিটির ২০১৬-১৭ এর পুরো অর্থবছরে হয়েছে ১.৩৯ টাকা। আর চলতি বছরের ৯ মাসে হয়েছে ১.০৬ টাকা। অর্থাৎ কোম্পানিটির ইপিএসে উন্নতির পরিবর্তে পতন হয়েছে। এ দিকে ব্যবসায় সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আইপিও এবং বোনাস শেয়ারের মাধ্যমে ইক্যুইটি বা নিট সম্পদের পরিমাণ দ্বিগুণ করা হলেও তার কোন প্রতিফলন নেই। কোম্পানিটির আইপিওকালীন ইক্যুইটির পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি টাকা। যা দিয়ে ২০১৪ সালের প্রথমার্ধে বা ৬ মাসে বিক্রয় বা আয় হয়েছিল ৪৪ কোটি টাকার। তবে সেই ইক্যুইটি ১২১ কোটি টাকায় উন্নীত হলেও ২০১৬-১৭ পুরো অর্থবছরে বা ১২ মাসে বিক্রয় হয়েছে ৮৭ কোটি টাকার। এ ক্ষেত্রে সময়ের হিসাবে বরং ১ কোটি টাকার বিক্রয় কমেছে। এ দিকে কোম্পানিটির চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে ইপিএস কমেছে ৯ শতাংশ। এ অর্থবছরের ৯ মাসে ইপিএস হয়েছে ১.০৬ টাকা। যার পরিমাণ আগের অর্থবছরের ৯ মাসে হয়েছিল ১.১৭ টাকা। এ ছাড়া কোম্পানিটির চলতি অর্থবছরের ৩ মাসে ইপিএস হয়েছে ০.২৬ টাকা। যার পরিমাণ আগের অর্থবছরের ৩ মাসে হয়েছিল ০.৩০ টাকা। এ হিসেবে ইপিএস কমেছে ০.০৪ টাকা বা ১৩ শতাংশ। ২০১৪ সালে নতুন ক্রয় করা ইলেক্ট্রিক্যাল ইক্যুইপমেন্টের ওপর অবচয় চার্জ না করে জাহিন স্পিনিং কর্তৃপক্ষ ‘বিএএস-১৬’ লঙ্ঘন করে। যেখানে যোগ হওয়া সম্পদের ওপর অবচয় চার্জ না করে ৪৮৪২৬ টাকার মুনাফা বেশি দেখানো হয়। আর একই পরিমাণ সম্পদ বেশি দেখানো হয়েছে। শ্রম আইন পালন না করেও প্রসপেক্টাসে ৩২ লাখ ৬৫ হাজার টাকার মুনাফা বেশি দেখায়। এর মাধ্যমে কোম্পানিটি শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা ও আইনের প্রতি অবজ্ঞা করে।
×