ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমরা সকলেই কি কর্পোরেট ম্যাডনেসে ভুগছি?

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ১৮ জুলাই ২০১৮

আমরা সকলেই কি কর্পোরেট ম্যাডনেসে ভুগছি?

বর্তমান বিশ্বে নানা রকম ঘটনা ঘটছে। বৈচিত্র্যে তার তুলনা নেই। তা নিয়ে দর্শক হিসেবে মাঝে মাঝে কিছু লিখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমার সম্পাদক ও পাঠকদের তাড়ার ফলে লিখতে পারি না। তারা বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে লিখুন। প্রতি সপ্তাহেই তো বাংলাদেশ নিয়ে লিখছি। আর কত লিখবো? কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটা কবিতার কথা মনে পড়ে- ‘আর কতোকাল কলম কলম ঠেলতে বলো, আর কতোকাল লেখা লেখা খেলা খেলতে বলো! লিখে কী হয়? আমাদের আগে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবুল মনসুর আহমদ, কাজী মোহাম্মদ ইদরিস, জহুর হোসেনের মতো শক্তিশালী কলামিস্টরা আজীবন অজস্র লেখা লিখে গেছেন। তাতে কি সমাজ পাল্টেছে, দেশ বদলেছে? অবশ্যই বদলেছে। কিন্তু তার বর্তমান পরিণতি কি? মধ্যযুগীয় অন্ধকার যুগে ফিরে আসা কি? আমাদের বর্তমান প্রজন্মের কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবীদের লেখা আরও বেশি শাণিত, যুক্তি নির্ভর। তারা জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিশ্লেষণ শক্তিতে আরও বেশি এগিয়ে। কিন্তু দেশকে অন্ধকার থেকে আলোর দিক-নির্দেশনা দেয়ার ব্যাপারে তাদের অনেকের দৃষ্টি ঘোলাটে। মনে হয় তারা নিজেরাই অন্ধ। কিন্তু ‘অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?’ বাংলাদেশেও এই প্রলয় বন্ধ থাকেনি। প্রাকৃতিক প্রলয়, রাজনৈতিক প্রলয়, সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রলয় কোনটাই বন্ধ থাকেনি। চার্চিল বলেছিলেন, “কোন কোন সময় কোন কোন জাতিকে ‘কর্পোরেট ম্যাডনেসে’ পেয়ে বসে।” বাংলাদেশের মানুষকে তাই আজ পেয়ে বসেছে কি? নইলে রাজনীতিতে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে এক দল লোক এত পানি ঘোলা করেন কিভাবে? আর আমাদের একশ্রেণীর কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবী তাতে বাহবা দেন কি করে? প্রায় অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে আমেরিকায়। সে দেশের একশ্রেণীর শীর্ষ কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবী প্রকাশ্যে বর্ণবিদ্বেষী না হলেও অবচেতন মনে বির্ণবিদ্বেষী ছিলেন তা হয়তো নিজেরাও বুঝতে পারেননি। তারা ব্লাক প্রেসিডেন্ট ওবামা যে হোয়াইট মার্কিন এস্টাবলিশমেন্টের প্রচ- বাধার মুখেও দুই বুশের যুদ্ধবাদী নীতি ও অদূরদর্শিতার জন্য দেশটি যেভাবে ধ্বংসের মুখোমুখি হয়ে ছিল, তা থেকে দেশকে উদ্ধারের লক্ষ্যে কখনো লড়াই ও কখনো আপোসের নীতি গ্রহণ করেছেন তা হয়তো বুঝতে পারেনি। অথচ ইচ্ছে করে বুঝতে চাননি। তাদের বিভ্রান্তি থেকেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা দখল অনেকটা সম্ভব হয়েছে। এখন তাদের অনেকে বলছেন, আমেরিকা একটি শীর্ষ উন্নত দেশে। সে দেশে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ‘বুল ইন চায়না শপের’ ক্ষমতায় বসা সম্ভব হলো কি করে? তাহলে কি গোটা মার্কিন জাতি কর্পোরেট ম্যাডনেসে ভুগছে? এই প্রথম একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের ব্রিটেন সফরের সময় একমাত্র রানী এলিজাবেথ ছাড়া ব্রিটিশ রাজ পরিবারের কেউ তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে রাজি হননি। উপমহাদেশের দেশ ও রাজ্যগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই প্রথম সমাজ ও সাংস্কৃতিতে জাতীয় রেনেসাঁ ঘটে। রাজা রামমোহন রায় থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত অনেক মনীষার আবির্ভাব ঘটে। রাজনীতিতে চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষ চন্দ্র, ফজলুল হক, শেখ মুজিবের মতো কালজয়ী নেতাদের জন্ম নিতে দেখা যায়। বাংলাদেশ হাজার বছরের ঐতিহ্য সমৃদ্ধ ধর্ম সমন্বয়ের দেশ, জাতি মিশ্রণের দেশ। যে বাংলা সম্পর্কে বলা হয়, ‘বাংলা আজ যা ভাবে, ভারত তা পরের দিন ভাবে।’ যে বাংলাদেশে পাকিস্তান আমলেও ছিল প্রগতিমুখী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ঢেউ, সে দেশ অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তার ভিত্তিতে স্বাধীন হওয়ার পর সাম্প্রদায়িকতা ও অন্ধকার যুগের হিংস্র মৌলবাদ মাথা তুলতে পারে, এটা ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। আজ ভয়াবহ কুক্লাক্স ক্লানের ভেতর থেকে উঠে আসা ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে বসা দেখে আমেরিকার মুক্তমনা, প্রগতিশীল কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশে ’৭১ এর যুদ্ধাপরাধী ও ঘাতকদের স্বাধীন বাংলাদেশে বিএনপির কৃপায় শাসন ক্ষমতায় বসা এবং তাদের গাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়তে দেখে আমাদের বামপন্থী ও প্রগতিশীলদের একটা বড় অংশের মধ্যে সেই উদ্বেগ ও শঙ্কা জাগতে দেখা যায়নি বরং ঘাতকদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে পুনর্বাসন তারা মেনে নিয়েছেন। প্রগতিশীল মার্কিন বুদ্ধিজীবীদের মতো তাদের চৈতনোদয় হয়নি। হয়তো হবে। যদি বাংলাদেশে এই মৌলবাদীদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই সাবেক বামপন্থী ও এখন নিরপেক্ষতায় ভেকধারী কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবীদের প্রাণভয়ে দেশ ত্যাগ করে পালাতে হয়। বর্তমান হাসিনা সরকারের যত দোষত্রুটি থাকে, তাদের সম্পর্কে সবচাইতে বড় কথা এই সরকার বাংলাদেশে বর্বর অতীতাশ্রয়ী তালেবানতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আশঙ্কা বোধ করেছেন, ইসলামী জিহাদিস্টদের ভয়াবহ সন্ত্রাসী তা-ব থেকে দেশকে রক্ষা করেছেন। ভারতের মতো বিশাল গণতান্ত্রিক দেশে কংগ্রেস, কম্যুনিস্টসহ ডান-বামের সকল অসাম্প্রদায়িক দল যেখানে সঙ্ঘ পরিবার ও কট্টর হিন্দুত্ববাদের উত্থান ও ক্ষমতা দখল প্রতিহত করতে পারেনি, সেখানে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বাম গণতান্ত্রিক দলগুলো তা পেরেছে। হিংস্র মৌলবাদী শক্তির উত্থান (পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায়) সারা মধ্যপ্রাচ্যে রক্তের প্লাবন বইয়ে দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এসে তারা তা পারেনি। তার কারণ, হাসিনা সরকার তা ঠেকিয়ে দিয়েছে। এই একটি মাত্র কারণে এই সরকারকে এখনও সমর্থন করি। বাংলাদেশের কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবীদের নিরপেক্ষতার ভেকধারী একটা বড় অংশ হয় এখনও বিভ্রান্তির ধূম্রজালে অন্ধ আছেন অথবা কোন উদ্দেশ্যে অন্ধ সেজেছেন। তারা আওয়ামী লীগকে ঢালাও সমর্থন দেবেন এ কথা বলি না। আওয়ামী লীগ ও হাসিনা সরকারের বড় ভুল-ভ্রান্তিগুলোকে কঠোর সমালোচনা অবশ্যই করবেন। কিন্তু তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী একটি প্রকৃত রাজনৈতিক দল ও স্বাধীনতার শত্রুদের জোটকে একই দাঁড়িপাল্লায় বসিয়ে নিজেদের নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে পারেন কি? জার্মানির ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পার্টির সঙ্গে নাৎসি পার্টিকে একই দাঁড়িপাল্লায় তুলে নিজেদের তথাকথিত নিরপেক্ষতায় প্রমাণ কেউ দেবেন কি? দুটি প্রতিবন্ধী গণতান্ত্রিক দলকে সমান দৃষ্টিতে দেখা যায়। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক জোট ও ফ্যাসিবাদী জোটকে (যে জোটে রয়েছে ’৭১ এর ঘাতক ও স্বাধীনতায় শত্রুরা) সমান দৃষ্টিতে দেখা যায় কি? ভারতেও বহুসম্পাদক ও বুদ্ধিজীবী বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন অথবা বিজেপিকে সমর্থন দিচ্ছেন। তাদের যুক্তি কংগ্রেস গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়েছে। আমার কথা, কংগ্রেস হয়তো গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়েছে, কিন্তু অন্ধ হিন্দুত্ববাদী দল হয়ে যায়নি। এক কালের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও সংবাদপত্র সম্পাদকেরা বিজেপিতে যোগ দিয়ে গণতন্ত্র ও মানবতার শত্রু অন্ধ হিন্দুত্ববাদীদের কি গণতান্ত্রিক ভারতে গণতন্ত্র হত্যায় সুযোগ করে দেননি? এখন তারা হয়তো গান গাইছেন ‘নাক দিয়ে নরুন পেলাম, তাক ডুমাডুম ডুম।’ বাংলাদেশে রাজনীতির বর্তমান অনিশ্চিত অবস্থা এবং আগামী নির্বাচনে মহাজোট জয়ী হতে না পারলে দেশে কী ধরনের মৌলবাদী তা-ব দেখা দেবে তা হয়তো এই বুদ্ধিজীবীরা আঁচ করতে পারছেন না। তাই বিএনপি-জামায়াত জোটের সঙ্গে প্রচ্ছন্নভাবে কণ্ঠ মিলিয়ে তাদের অন্যায় দাবি-দাওয়াও মেনে নেয়ার জন্য সরকারের উপর চাপ দিচ্ছেন। হাসিনা সরকারের সামান্য তিল পরিমাণ দোষ পেলেও তাকে তাল করে প্রচার চালাচ্ছেন। প্রসঙ্গত বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কোটা পদ্ধতি বাতিলের আন্দোলনের কথাও আলোচনাযোগ্য। হাসিনা সরকার আন্দোলনের দাবি মেনে সঙ্গে সঙ্গে কোটা প্রথা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন। আমিও কোটা প্রথা বাতিলের বিরোধী। তবে সংশোধনের পক্ষে। সরকার সম্ভবত এই ব্যাপারে একটু ভেবে চিন্তে কাজ করার জন্য সময় নিচ্ছেন। আন্দোলনকারী ছাত্ররা সরকারকে এই সময় দিতে অনিচ্ছুক। তারা আবার আন্দোলনে নেমেছিলেন। এই আন্দোলনকারীদের উপর ছাত্রলীগের কর্মীদের হামলা নিন্দনীয়। কিন্তু ব্যাপারটি সামগ্রিকভাবে না দেখেই আমাদের একশ্রেণীর সংবাদপত্র এই হামলার খবরকেই ফলাও করে প্রচার করে সরকারবিরোধী জন-অসন্তোষ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। কিন্তু সেই সঙ্গে একটা ব্যাপার বিবেচনায় আনছে না যে, সাম্প্রতিককালের অনেক আন্দোলনে দেখা গেছে জামায়াত-শিবিরের দুষ্কৃতিরা সাধারণ ছাত্র সেজে অনুপ্রবেশ করে এবং লাঠালাঠির ব্যাপারটি তারাই ঘটায়। কোটা পদ্ধতি রোধ একটি নির্দোষ আন্দোলন এবং বেশিরভাগ ছাত্রই শান্তিপ্রিয়। কিন্তু তাদের ভেতর অনুপ্রবেশ করে ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরের লোকেরা যে সন্ত্রাসী ভূমিকা গ্রহণ করে উস্কানি দেয় ছাত্রলীগের অনেক সদস্য তার ফাঁদে পা দেয়। ছাত্রলীগের নতুন কর্মকর্তারা দায়িত্ব পেলে তাদের প্রথম কর্তব্য হবে জামায়াত-শিবিরের উস্কানিতে যাতে ছাত্রলীগ পা না দেয় তার কঠোর ব্যবস্থা করা। আগেই বলেছি, ‘অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ হয় না।’ আমাদের এলিট ক্লাশ, কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ তাদের বিভ্রান্তি অথবা সুযোগ সন্ধানী মনোভাব থেকে নিজেদের মুক্ত করুন এবং দেশবাসীরও বিভ্রান্ত অংশকে মুক্ত করার পদক্ষেপ নিন। নইলে মনে হবে, আমরা সকলেই বুঝি কর্পোরেট ম্যাডনেসে ভুগছি। [লন্ডন, ১৭ জুলাই মঙ্গলবার, ২০১৮]
×