ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দলিল উদ্দিন দুলাল

অভিমত ॥ আমার চোখে আগামীর বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ১৮ জুলাই ২০১৮

অভিমত ॥ আমার চোখে আগামীর বাংলাদেশ

লেখালেখি করা অনেকটা কষ্টকর হয়ে পড়েছে, নানা অসুখ দেহের মধ্যে বাসা বাঁধছে। অনেক কিছুই মনে থাকে না। কয়েকদিন আগে আমার বন্ধু এসেছিল। এসেই আমাকে নাম ধরে ডাক দিল। আমি তাকে ভাল চিনি। কিন্তু অসুখে সব ভুলিয়ে দেয়। কিন্তু তার নাম মনে করার চেষ্টা করলেও কোন ফল হচ্ছে না। লোকটার নাম মনে করতে পারছি না। যা হোক, তার সাথে কিছুক্ষণ আলাপের পর মনে পড়ে গেল নাম শহিদ। তাকে বিদায় দেয়ার পর নাটোরের বিস্মিত স্মৃতি চোখে ভেসে উঠলো। দোলা দিল ১৯৭১-এর ফেলে আসা স্মৃতিগুলো। স্বাধীনতার কত বাধা, কত বিঘœ, অতিক্রম করতে হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ঝরতে হয়েছে তরতাজা রক্ত কত সজীব তরুণ প্রাণ, জীবনের জয়গান গেয়ে উৎসর্গিত হয়েছে। নবীন প্রবীণ কত মুক্তিযোদ্ধা তাদের বুকের রক্তে রাজপথ হয়েছে রঞ্জিত, মুক্তির তৃষ্ণায় এ দেশে কত মা বোন ইজ্জত হারিয়েছেন। কত দুঃসহ যন্ত্রণা আর লাঞ্ছনা মর্মবেদনা। কিছু কিছু মনে পড়ছে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর। বঙ্গবন্ধু পুরানা পল্টনের ভাঙ্গা ঘরে দাঁড়িয়ে সে দিন বলেছিলÑ তোরা এক সঙ্গে এত মুক্তিযোদ্ধা এক হয়ে সংগঠন করেছিস। আমি তোদের সঙ্গে থাকব। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের আজকের সিম্বুল হাতে নিয়ে উঁচিয়ে ধরলে, সকল মুক্তিযোদ্ধা জয়বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু বলে স্লোগানে পুরানা পল্টন কাঁপিয়েছিল। আজ যারা বেঁচে আছেন তাদের মধ্যে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম, সাদেক হোসেন খোকা আরও কয়েকজন নাম মনে করতে পারছি না। ঐ দিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তোরা আমার সূর্য সন্তান। সেদিন আবদুল আজিজ বীর প্রতীক সেক্রেটারি, সভাপতি মাহমুদ হাসান, কমিটি করেদিয়েছিলেন। এর আগে অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদ নামে একটা সংগঠন করেছিলেন। পরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ হলে আহাদ চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা সংসদে জড়িত হন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর দেখা গেল মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ওপর নেমে আসল সেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়। ইতিহাস বিকৃত, ধিকৃত করে, শেখাতে লাগল, লেখা শুরু করল। সেটা হলো একজন বীর উত্তমের মাধ্যমে। বীর উত্তম ক্ষমতা নেবার পর নানা সময়ে সেক্টর কমান্ডার, সাব সেক্টর কমান্ডারসহ বহু মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসি দিল। অনেককে রাতের আঁধারে খুন করল। দেখে শুনে বুঝে পরে মুক্তিযোদ্ধারা আবার সুসংগঠিত হতে শুরু করল। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ খ- বিখ-িত হয়ে পড়ল। ১৯ বছর পর মুক্তিযোদ্ধারা আবার একত্রিত হলো। ধানমণ্ডির শংকরের সিটি নার্সিং হোমে প্রথম সভা হয়। সেখানে অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সে দিন দেখলাম মুক্তিযোদ্ধা স্লোগান দিল- ‘অস্ত্র জমা দিয়েছি ট্রেনিং জমা দেইনি।’ আমি ঐ মিটিংকে স্লোগান দিয়েছি। ১৯৯৫ সালের ২৯ নবেম্বর শাপলা চত্বরে আহাদ চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধাদের মহাসমাবেশের ডাক দিলেন। মঞ্চ বানানোর জন্য আগের দিন বাঁশ খুঁটি হাজির। পরের দিন সিটি কর্পোরেশনের কয়েক ডজন পুলিশ প্রশাসনের লোক এসে মিটিং করতে দেবে না বলে জানিয়ে দিল। কয়েকজন ভয়ে দূরে দূরে থাকতে লাগল দেখা গেল সকাল থেকে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা এসে গেছে শাপলা চত্বরে। আমি সোনালী ব্যাংকের মুক্তিযোদ্ধার সংসদের কমান্ডার। মাইক দিয়ে ঘোষণা দিলাম, এর মধ্যে বেশ কিছু উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে কানে কানে বলল আমরাও মুক্তিযোদ্ধা। আপনারা মুক্তিযোদ্ধার রাস্তা বন্ধ করে দেন। আমরা চলে যাব। সেদিন আমি আহাদ সাহেবকে বলেছিলাম তিনি এসে সব জায়গায় খবর দিল। কিন্তু মাইক ব্যবহার করতে দেবে না। মাইক চালানো বন্ধ হয়ে গেল। এর পর গোপনে শ্রদ্ধেয় আবদুর রাজ্জাক সাহেবকে টেলিফোন করে বলার পরে রাজ্জাক সাহেব বলল মিটিং হবে। মঞ্চ করার দরকার নেই। ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে মিটিং হবে। রাজ্জাক সাহেবের আহ্বানে আজকের প্রধানমন্ত্রী ঐ সময়ের বিবোধীদলীয় নেত্রীর নেতৃত্বে বললেন বা আপনি আসেন সমস্ত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে উপস্থিত। আসেন দেখেন, মুক্তিযোদ্ধা কার সঙ্গে আছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা ট্রাকের ওপর উঠে দেখেন শাপলা চত্বর থেকে দৈনিক বাংলা মোড়, এদিকে ইত্তেফাক ভবন, ঐ দিকে নটর ডেম কলেজ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা। সোনালী ব্যাংক থেকে সমস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী একত্রিত হয়। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো মিছিল করে মিটিংয়ে উপস্থিত হয়েছিল। আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলাম, মুক্তিযোদ্ধা সংসদে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধার অধিকার আদায় করতে হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনরায় অধিকার আদায় করতে হবে, সবাই আমাকে বাহবা দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের আকণ্ঠ সমর্থনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত করলেন তাদের দাবি-দাওয়া আহাদ চৌধুরীর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার লিষ্ট করা হয়। যা লাল বই নামক বইতে লিপিবদ্ধ করা হয়। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগকে জামায়াত-বিএনপি চক্র চক্রান্ত করে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে তাদের নির্যাতনের কারণে স্বাধীনতাকামী মানুষ সন্ত্রস্ত ছিলেন। ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারাও। আহাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অত্যাচার এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবনে চেয়ারম্যানের কক্ষে হাতুড়ি সাবল চালানোর কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা সবার জন্য তাদের ওপর অত্যাচার করা কিছুতেই বরদাশত করা যায় না। আপনারা নিজেরা বেঁচে আন্দোলন চালিয়ে যান। তিনি বললেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা আমার পরিবারের লোক, কারণ আমার বাবার ডাকে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে গিয়েছিল।’ আমরা এখন বৃদ্ধ বয়সে। স্বাধীনতা বিরোধী, এমনকি নামধারী পক্ষের লোকেরা মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে অশালীন, অশ্রাব্য, অশোভন আচরণ হরহামেশাই করে থাকে। কীটপতঙ্গরাও তাদের সমাজে সমাজবদ্ধভাবে থাকে, সকলে সমাজে সংগঠিত আছে। শুধু মুক্তিযোদ্ধারা আজ অসংগঠিত করে রাখা হয়েছে। প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা দেয়ায়, বেশি অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। ১৯৭১ সালে ১০০ জনের ভিতরে মুক্তিযোদ্ধা ছিল একজন। বর্তমানে ৮০০ এর উপরে মাত্র একজন মুক্তিযোদ্ধা খাতা কলমে আছে। প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করা দুরূহ। আজ কোন কোন সোসাল মিডিয়া কোন কোন টেলিভিশনে মুক্তিযোদ্ধারা আউট। আজ ৭০ বছর বয়সে যখন দেখি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করার কথা বলে থাকেন অথচ তাদের মুখ থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান দেয় না। তখন খুব কষ্ট হয়। আজ প্রাধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব আমাদের সংগঠন শক্তিশালী করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা সংসদে নির্বাচন অবশ্যই দরকার। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সক্রিয় থাকলে মুক্তিযোদ্ধার পক্ষের কথার শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করবে। তাদের কাজে লাগাতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের পরম সুসংবাদ আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার নেতৃত্বে আছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা গত দশ বছরে দরিদ্র নিপীড়িত, সমস্যা জর্জরিত বাংলাদেশকে একদম বদলে দিয়েছেন। বাহ্যিক অর্থেই উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে বাংলাদেশ। তৃতীয় বিশ্বের বিষ বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে উন্নত বিশ্বের পথে যাত্রা শুরু করেছে। বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আজ জীবন সায়াহ্নে এসে একটি সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। যে স্বপ্নপূরণে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান এবং স্বপ্ন পূরণ করেন। লেখক : সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, ৭নং সেক্টরের সম্মুখযোদ্ধা
×