ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যুক্তিবাদী তরুণরাই বদলাবে...

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ১৮ জুলাই ২০১৮

যুক্তিবাদী তরুণরাই বদলাবে...

বছর কয়েক আগে পশ্চিমবঙ্গের যুক্তিবাদী আন্দোলনের প্রবক্তা প্রবীর ঘোষ ঢাকায় এসেছিলেন ব্যক্তিগত সফরে। মিডিয়া কভারেজ তেমন ছিল না। অনেকের ব্যক্তিগত তথ্যেও তাঁর আসার সংবাদ ছিল না। তিনি ‘ভারতীয় যুক্তিবাদী আন্দোলন’-এর প্রতিষ্ঠাতা। সম্ভবত সে কারণে ঢাকায় এসে নিজ উদ্যোগে যোগাযোগ করেন এখানকার যুক্তিবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত তরুণদের সঙ্গে। যারা যুক্তির আলোকে পথ চলতে চায়। সঙ্কীর্ণতা, ভাবালুতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে তাদের সোচ্চার কণ্ঠ সমাজের মূল ধারাকে স্পর্শ করতে না পারলেও তরুণদের একাংশের চেতনাকে তারা শাণিত করার চেষ্টা করছে। সে সময় প্রবীর ঘোষের সঙ্গে তাদের মতবিনিময় অনুষ্ঠানে গিয়ে সে কথাই মনে হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তন উপচে পড়ছে। আগতদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই তরুণ। প্রাণপ্রাচুর্যে টগবগ করছে। প্রশ্ন, যুক্তি, পাল্টা যুক্তিতে প্রবীর ঘোষকে ব্যতিব্যস্ত রাখছিল তারা। প্রবীর ঘোষ তার অভিজ্ঞতা থেকে একের পর এক উদাহরণ দিয়ে বলছিলেন জ্যোতিষী, ভাগ্য গণনাকারী, যোগ-তান্ত্রিক সাধকদের যুক্তি দিয়ে মোকাবেলা করার কথা। যুক্তি আর বিজ্ঞানের এই আবহ দারুণ আশাবাদী করে। এই তরুণদের মতো আরও অসংখ্য তরুণ নিশ্চয়ই ছড়িয়ে আছে সারাদেশে। যারা চিন্তা করতে পারে। যুক্তির পরম্পরা দিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারে চারপাশের ঘটনাবলী। ভাবালুতায় ভরা সমাজ ও রাজনীতির জায়গায় এরাই প্রতিষ্ঠা করবে যুক্তিনির্ভর সমাজ ও মননশীল রাজনীতি এমন ভাবনা আশাবাদী করে। সমাজের বিন্যাস এখন সামন্ত উৎপাদন কাঠামো ঘিরে না হলেও আমাদের মতো দেশে মনোজগতে সামন্ত আধিপত্যই বেশি। আর তাই রয়েছে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, ভাবাবেগ ও মতান্ধতার নিয়ন্ত্রক ভূমিকা। এর বিপরীতে অনিবার্য হয়েছে যুক্তি ও বিজ্ঞান মনস্কতা। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে যা তরুণরাই প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। তাদের ওপর ভরসা করা ছাড়া কিইবা করার আছে। দেশের রাজনীতি যে চক্রব্যূহে পড়েছে তা ভাঙ্গার ক্ষমতা বর্তমান রাজনৈতিক কুশীলবদের নেই। তারা চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছেন আর একে অন্যের গায়ে কাদা ছুড়ছেন। সাধারণ মানুষ সব সয়ে ‘সঙ্কটই সমাধানের পথ দেখায়’ এই সান্ত¡না নিয়ে আছেন। যদিও রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘নৈরাশ্যের মধ্যেই এই কথাও মনে আসে যে, দুর্গতি যতই উদ্ধতভাবে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠুক, তবু তাকে মাথা তুলে বিচার করতে পারি, ঘোষণা করতে পারি, তুমি অশ্রদ্ধেয়, অভিসম্পাত দিয়ে বলতে পারি, ‘বিনিপাত’ বলবার জন্য পণ করতে পারে প্রাণ এমন লোকও দুর্দিনের মধ্যে দেখা দেয়, এই তো সকল দুঃখের সকল ভয়ের উপরের কথা’Ñ (কালান্তর)। এখনকার প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন হচ্ছে কি পদ্ধতিতে বলতে হবে এ কথা? বহুদলীয় গণতন্ত্রের অবস্থা ব্যাখ্যা করে বলার দরকার নেই। বামপন্থী রাজনীতির কোমর ভাঙ্গা। যে ক’জন বামপন্থী রাজনীতিক সরকারে আছেন, তারা কীভাবে কোন্ পদ্ধতিতে সমাজ পরিবর্তনে অবদান রাখছেন, বাম রাজনীতির চর্চা ও বিকাশ ঘটাচ্ছেন তা সাধারণ মানুষের বোধের বাইরে। রাজনীতিতে এরা বর্জ্য। তবে যে আদর্শের নাম ভাঙ্গিয়ে এরা নেতার তকমা ধারণ করেছেন সে আদর্শ যে বর্জ্য নয় সচেতন তরুণরা তা বোঝে। দেশকে ভালবাসার নামে যে ভ-ামি তার স্বরূপও তারা চেনে। তাদের শুধু জানতে হবে কোন্ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে রাজনীতি দূষণমুক্ত হবে। প্রয়োগের রূপরেখা তারাই বের করে নেবে। যুক্তির পেছনে যারা ছুটতে পারে নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি খাটিয়ে চলার ক্ষমতা তারা রাখে। ওই সময়ই এক গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি হিসেবে তরুণদের অগ্রণী ভূমিকা নেয়ার পরামর্শ দিয়ে এক কলামে তাদের জোটবদ্ধ হওয়ার কিছু সুপারিশ রেখে বলেছিলেন, আমার চিন্তা হলো, বাংলাদেশে যুবকদের নেতৃত্বে একটি নতুন ধরনের রাজনৈতিক দল সৃষ্টি হবে। ২০১২ সালেই এর সূচনা হতে পারে সমমনা যুবকদের গ্রুপ গঠনের মাধ্যমে। ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী যুবকরাই এর সদস্য হবেন। প্রবাসেও এর সদস্য সংগ্রহ করা হবে। যুবকদের এই গ্রুপ প্রতিমাসে গ্রুপভিত্তিক মিটিং করবে। এই সম্মেলনে তারা আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে বাংলাদেশের ২৫টি জাতীয় সমস্যা, জেলাভিত্তিক (জেলা গ্রুপ) ২৫টি স্থানীয় সমস্যা ও এর সমাধান চিহ্নিত এবং লিপিবদ্ধ করবে। প্রবাসী বাংলাদেশী তরুণরাও ই-মেইল, ফেসবুক, ব্লগ ও স্কাইপের মাধ্যমে এসব গ্রুপ আলোচনায় অংশ নেবে ও মতামত দেবে। এভাবেই দুই বছর আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে তারা দেশের জাতীয় এবং স্থানীয় সমস্যা চিহ্নিত এবং সমাধানের প্রস্তাব করবেন। এই ‘যুব শক্তি’ তাদের পছন্দমতো (ভোটের মাধ্যমে) একটি ‘জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ’ গঠন করবে। কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে (বা সাবেক) ব্যক্তি এই উপদেষ্টা পরিষদে স্থান পাবেন না। সব টেকনিক্যাল, অভিজ্ঞ ও পেশাদার ব্যক্তি এই উপদেষ্টা পরিষদে থাকবেন। যুবশক্তি তাদের প্রস্তাবিত সমস্যা ও সমাধান নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে ইস্যুভিত্তিক মতবিনিময় করবে। প্রবাসী বাংলাদেশী কিছু বিশেষজ্ঞও এই পরিষদে থাকবেন। উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর তাঁরা এই কর্মসূচী চূড়ান্ত করবেন এবং এই কর্মসূচী বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় কনভেনশন ও অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য আহ্বায়ক কমিটি গঠন করবেন। আহ্বায়ক কমিটি পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে দলের গঠনতন্ত্র রচনা করবে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় ও জেলা কমিটি গঠন করা হবে। রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে এই মিডিয়া ব্যক্তিত্বের প্রস্তাব জনবিচ্ছিন্ন মানুষের এনজিও মার্কা কথাবার্তা। তিনি সম্ভবত ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন, তথাকথিত আরব বসন্ত ইত্যাদি ঘটনায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। এভাবে জনমত গঠন কোন পরিবর্তন আনতে পারে না। তবে একটি কথা তিনি ঠিকই বলেছিলেন, তরুণদেরই তৃতীয় শক্তি হতে হবে। আঠারো শতকে ইউরোপে সামন্তবাদমুক্ত হয়ে স্বাধীন বুর্জোয়ার পথ চলা শুরু হয়েছিল। আমাদের এখানে তখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফসল হিসেবে যে ভূস্বামী ও জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল তারা স্বাধীন ছিল না। রাজনৈতিক ক্ষমতাও তাদের ছিল না। যারা ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তাদের স্বার্থও ছিল শাসক ব্রিটিশের সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং তারাও স্বাধীন ছিলেন না। মধ্য শ্রেণী এখানে এসেছিল মূলত মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী ও ভূস্বামী শ্রেণী থেকে। পাকিস্তান আমলেও সে অবস্থা প্রায় একই ছিল। অর্থাৎ যাদের মধ্য থেকে শাসক গোষ্ঠী বেরিয়ে আসছিল তাদের জন্ম ও বিকাশের প্রক্রিয়ায় শুরু থেকেই গলদ ছিল। হয়ত সে জন্যই বুর্জোয়া বিকাশের সঙ্গে সামন্ত ধ্যান-ধারণা আগাগোড়া জড়িয়ে রয়েছে। এই মিশ্রণের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তার চরম প্রকাশ বার বার আমরা দেখছি। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে রাজনীতি স্বাভাবিক ছন্দে এগুতে পারবে না। অনেক পথ পেরিয়ে এসেও সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়ের ভূমি মালিক ও ব্যবসায়ী বিকাশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে রাজনৈতিক ক্ষমতার ধারক মধ্য শ্রেণী। তাদের সামন্ত মানসিকতা ভাঙতে তরুণদের আগমন অপরিহার্য। পচে যাওয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূলে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিতে নিশ্চয়ই তারা আসবে।
×