বাংলাদেশে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তিনদিনের রাষ্ট্রীয় সফরটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ। রবিবার সফরের শেষ দিনটি সমাপ্ত হয় সচিবালয়ে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকসহ বঙ্গবন্ধু জাদুঘর পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে। উল্লেখ্য, এর আগে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদ্বয় আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছিলেন দিল্লীতে। উল্লেখ্য, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বিজেপি জোট সরকারের একজন প্রভাবশালী সিনিয়র মন্ত্রী এবং প্রবীণ নেতা। উভয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে সীমান্ত হত্যা, মানব পাচার, চোরাচালান, বন্দী বিনিময়, জঙ্গী ও সন্ত্রাস দমনসহ দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান ও উদ্ভূত যে কোন সমস্যা পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের ওপর জোর দেয়া হয়। এর জন্য প্রয়োজনে দুই বছর পর পর নয়, দুই মাস অন্তর বৈঠক করার প্রস্তাব করেন তিনি। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহায়তার কথাও বলেছে ভারত এবং এ ক্ষেত্রে তারা বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে সহযোগিতা চাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। মৌলবাদ ও চরমপন্থা মোকাবেলায় দুই দেশই ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির ভিত্তিতে যৌথভাবে মোকাবেলা করার কথা বলেছে, যেটি বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সমস্যা। বাংলাদেশের নাগরিকদের ভারতের ভিসা সহজ করার জন্য স্বাক্ষরিত হয়েছে ‘রিভাইস ট্রাভেল এ্যারেঞ্জমেন্ট-২০১৮।’ এর আওতায় যমুনা ফিউচার পার্কে খোলা হয়েছে এশিয়ার সর্ববৃহৎ ওয়ান স্টপ ভিসা কেন্দ্র। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাত করেছেন। বিদায়ের প্রাক্কালে এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চিরঞ্জীব হোক।’
বাংলাদেশ ভারতের শুধু নিকট প্রতিবেশীই নয়; বরং দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত অকৃত্রিম বন্ধু ও সুহৃদ। দিল্লী বাংলাদেশের কাছে করিডর, ট্রান্সশিপমেন্ট, শুল্কমুক্ত পণ্য পরিবহন ও বাণিজ্য সুবিধাসহ যখন যা চেয়েছে তখনই তা পেয়েছে । ১৯৭১-এর মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে ভারতের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন এবং সহযোগিতা সর্বদাই স্মরিত হয়ে থাকে। সে তুলনায় বাংলাদেশের চাহিদা ও প্রাপ্তি অনেক কম। উদাহরণত বলা যায়, উজানে পানির প্রবাহ ও প্রাপ্তির কথা। ভারত কোন অবস্থাতেই আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও আইনকানুন ভঙ্গ করে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তাসহ অভিন্ন নদ-নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ অবরুদ্ধ করতে পারে না। অথচ ভারত তাই করেছে প্রথমে গঙ্গা এবং পরে তিস্তা ও অন্যান্য নদ-নদীতে বাঁধ এবং ব্যারাজ নির্মাণ করে। সর্বশেষ ব্রহ্মপুত্রেও বাঁধ নির্মাণের কথা শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশ এসব ক্ষেত্রেই ন্যায়ানুগ ও যুক্তিসঙ্গত প্রতিবাদ জানিয়েছে। তবে গঙ্গার পানি নিয়ে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে তা হয়নি; বরং ঝুলে আছে দীর্ঘদিন থেকে। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রথম দিকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরকালে তিস্তা চুক্তির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। শেষ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সফর বাতিল করায় তা আর হয়ে ওঠেনি। অভিযোগ রয়েছে তিনি তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে আদৌ আগ্রহী নন। তদুপরি বর্তমানে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের সঙ্গে তার টানাপড়েন চলছে। সে অবস্থায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ‘গুজরাল ডকট্রিনের’ মতো তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করতে পারে কিনা সেটা বিবেচনা করে দেখতে হবে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা না হলেও দু’দেশে অনুষ্ঠেয় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিশেষ করে ভারতকে এসব সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানে অবশ্যই উদ্যোগ নিতে হবে।