ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ার প্রাচীন থম্পসন হল

লন্ডন থিয়েটার হলের আদলে নির্মিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৭ জুলাই ২০১৮

লন্ডন থিয়েটার হলের আদলে নির্মিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

সমুদ্র হক ॥ ঐতিহ্যের ওই ভবনের অনেক জায়গায় শেওলা জমেছে। ভেতরের কোন স্থানে পলেস্তোরা খসে পড়েছে। সংস্কার করা হয়নি অনেক দিন। দেড় যুগ তো হবেই। সংরক্ষণও করা হচ্ছে না। বগুড়া নগরীর নবাববাড়ী সড়কের ধারে জিলা স্কুলের ভেতরে পশ্চিম কোণায় ভবনটি উঁকি দেয় নিত্যদিন। জানান দেয় দেড় শ’ বছরের ঐতিহ্যের সাক্ষী। কালের পথ পরিক্রমায় নীরবে-নিভৃতেই রয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের এই স্থাপনাটি। ব্রিটিশ শাসনামলে লন্ডন থিয়েটারের আদলে গড়ে তোলা হয় এই থম্পসন হল। যা দিনে দিনে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। ভবনটি রক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন বগুড়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরও চাইছে পুরাকীর্তি ঘোষণা করতে। সে-ই ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে বগুড়ায় ‘ইংলিশ স্কুল’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে নগরীর সূত্রাপুরে। এর ২৮ বছর পর ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে নগরীর কেন্দ্রস্থল সাতমাথার কাছে নবাববাড়ী সড়কের ধারে প্রায় দেড় একর জায়গার ওপর স্কুলটি স্থানান্তর করা হয়। নামকরণ করা হয় বগুড়া জিলা স্কুল। পরের বছর ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট গবর্নর স্যার রিভার থম্পসন জিলা স্কুলের সঙ্গেই সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র হিসেবে থিয়েটার হল নির্মাণ করেন। লন্ডন থিয়েটার হলের আদলে স্বল্প পরিসরের এই হলটির নামকরণ করা হয় ‘থম্পসন হল’। ওই সময়ের দেশী বিদেশী থিয়েটার কর্মীরা এই হলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতেন। জনশ্রুতি আছে কলকাতার অনেক গুণী কণ্ঠ ও নাট্য শিল্পী থম্পসন হলে অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে যত বড় বড় থিয়েটার হল ছিল তার এই থম্পসন হল অন্যতম। থিয়েটার চর্চায় এগিয়ে যায় এই এলাকার সাংস্কৃতিক কর্মীরা। জিলা স্কুলের ধারে প্রায় পাঁচ শতাংশ জায়গার ওপর স্থাপিত থম্পসন হলটি বহুকাল তার পরিচিতির জৌলুস ধরে রাখে। ১৯১৯ সালে থম্পসন হলের নিকটে একটি ছাত্রাবাস নির্মিত হয়। সেখানে সকল ধর্মের শিক্ষার্থীরা থাকত। ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীদের মিলন মেলায় পরিণত হয় এই থম্পসন হল। গত শতকের ষাটের দশক পর্যন্ত জিলা স্কুলের একজন ব্রিটিশ শিক্ষক এই হলের রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। দেশ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর জাতীয় দিবসগুলোর অনুষ্ঠান হতো এই থম্পসন হলে। গত শতকের ১৯৯০ সালে ভবনের নক্সা ঠিক রেখে থম্পসন হলের সংস্কার কাজ করে ফ্যাসিলিটিজ বিভাগ। তারপর এই হলটি জিলা স্কুলের পাঠাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। একটা পর্যায়ে হলটি ব্যবহারের নানা অসুবিধার সৃষ্টি হয়। হলটি সংস্কার ও সংরক্ষণের উদ্যোগে ভাটা পড়ে। বগুড়ার সাংস্কৃতিক কর্মীরা হলটি সংরক্ষণের দাবি জানাতে থাকে। বগুড়ার বর্তমান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী ঐতিহ্যের থম্পসন হলটি রক্ষায় এগিয়ে আসেন। তিনি জানান, ঐতিহ্যের এই হলটিকে মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর হিসেবে রূপান্তরের চেষ্টা চলছে। ভূমির কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে। কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। বগুড়ার সুধীজন ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বগণও মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় একমত হয়েছেন। সুধীজনের মতামতেই হলটি সংরক্ষণ করা হবে। এ দিকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা জানিয়েছেন, থম্পসন হলটিকে পুরাকীর্তি ঘোষণা করার জন্য তিনি দুই দফায় অধিদফতরের মহাপরিচালকের মাধ্যমে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানিয়েছেন। এই বিষয়ে জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু নূর মোহাম্মদ আনিসুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে থম্পসন হলটি যে ভূমির ওপর স্থাপিত তার মালিকানার কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে। কাগজ খুঁজে দেখা হচ্ছে। প্রধান শিক্ষক চান ঐতিহ্যের হলটি ভালভাবে সংরক্ষণ করা হোক। বগুড়ার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি তৌফিক হাসান ময়না বলেন, থম্পসন হলটির সঙ্গে শিকড়ের সংস্কৃতির প্রাচীন ইতিহাস জড়িত। তিনিও চান হলটি মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক।
×