ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

একটি পুরস্কার ও কিছু ভাবনা দুর্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৭:০২, ১৬ জুলাই ২০১৮

একটি পুরস্কার ও কিছু ভাবনা দুর্ভাবনা

আমাদের দেশে সবকিছুই রাজনীতি। এমনকি চলচ্চিত্রও। পুরস্কার জাতীয় বিষয়গুলোও এর বাইরে না। সেটাই দেখছি আবার। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিতরণের একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে ঘুরছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার উদারতার কথা যেমন মুখে মুখে তেমনি ছবিটি প্রশ্ন তুলেছে বৈকি। আমাদের দেশ ও সমাজ নানা ভাগে বিভক্ত। সবচেয়ে বড় বিভক্তির কারণ ধর্ম আর রাজনীতি। রাজনীতির বিভক্তি এতটাই প্রকট এটি ধর্মকেও ছাড় দেয় না। সবাই জানেন আমাদের দেশে রাজনীতি মানে আসলে আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি। বলা উচিত আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের শক্তি বনাম বিরোধীরা। যেসব কারণেই হোক বিএনপির দিকটাও কম কিছু না। বরং ইদানীং তারা কোণঠাসা হলেও দেশের শাসনভার আর সমাজকে খোল নলচেসহ বদলে দেয়ার ব্যাপারে তাদের কাজকর্ম ছিল চোখে পড়ার মতো। আমাদের দেশের রাজনীতি উদার কিছুও না। পাশের দেশ ভারতে যেমন সোনিয়া গান্ধীর পাশে বসে সুধী-সমাবেশে মোদি ভাষণ দিতে পারেন তেমনটা আমরা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারি না। কারা দায়ী বা কারা বেশি আগ্রাসী সে বিচারে না গিয়েও বলা যায় মূলত সবাই আজ এই রোগে আক্রান্ত। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও এই রোগ মহামারী। দীর্ঘকালের বন্ধুত্ব একসঙ্গে ওঠাবসা পরিবারে পরিবারে সম্প্রীতি এমনকি সম্পর্কও ভেঙে গেছে ভেঙে যাচ্ছে। কেন জানি না মনে হয় এটাই আমাদের নিয়তি। মূলত বড় দুই দলের নেতারা কখনও তাদের ভেতর বন্ধুত্ব রাখার চেষ্টা করেননি। আওয়ামী লীগ প্রধান যখন সরকারপ্রধান তখন তিনি পুত্র বিয়োগের সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়াকে। গেটও খোলা হয়নি। ফোনালাপে আমরা যে কর্কশ ও তিরস্কারের ভাষা শুনেছি সেটাও দুঃখজনক। আওয়ামী লীগের নেতা, পাতি নেতারাও কম যায় না। সুযোগ পেলেই বিএনপির চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে তারা। আওয়ামী লীগে জোটের নামে মন্ত্রী হওয়া তথ্যমন্ত্রী ইদানীং শান্ত এই কিছুদিন আগে তাঁর কাজই ছিল খালেদা নিন্দা। অন্যদিকে রিজভির মতো নেতা বা গয়েশ্বরের মতো নেতারা রাতদিন আগুনে ঘি ঢালছেন। এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে বিএনপির সাংস্কৃতিক সম্পাদক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলেন, আবার সে পদক নিলেন প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে এতে জনমনে কৌতূহল জাগতেই পারে। বলছি না তিনি অযোগ্য। বরং যোগ্য মানুষ তিনি। টিভি মিডিয়ায় যতটুকু দেখেছি মিতভাষী। একটু বেশি বিনয়ী মনে হয় বলে আমি সন্দেহপ্রবণ তাঁর ব্যাপারে। অতি বিনয়ের পেছনে কি থাকে বলা মুশকিল। গাজী মাজহারুল আনোয়ার তারপর একজন জননন্দিত গীতিকার। তাঁর লেখা অনেক গান আমাদের ইতিহাসে অমর। যেমন যুদ্ধের সময় গীত আজ যা কিংবদন্তি সে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটিও তাঁর লেখা। কিন্তু প্রশ্ন জাগে সে জয় বাংলা কি তিনি আর বলেন? বলেন না বলেই জয় বাংলার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়া জিন্দাবাদের দলে আছেন। যেখানে জয় বাংলা বাংলার জয় টোটালি নিষিদ্ধ। সে রাজনীতির সাংস্কৃতিক সম্পাদককে পুরস্কৃত করার মতো পরিবেশ কি তাহলে তৈরি হয়ে গেছে? না এর পেছনে কাজ করেছে কোন ষড়যন্ত্র বা আশাবাদ? ষড়যন্ত্রটা এমন হতে পারে প্রধানমন্ত্রী জানতেনই না। কৌশলে তাঁকে দিয়ে কাজটা করানো হয়েছে। আর আশাবাদটা এমন গাজী সাহেব কথা দিয়েছেন তিনি আবার জয় বাংলায় ফিরবেন। যেটাই হোক না কেন এই ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর সার্বজনীন ইমেজ জয়ী হয়েছে। আর বিপাকে পড়েছে সেসব মানুষেরা, যারা আদর্শের নামে নিজেদের ভেতর কাইজা ঝগড়া করে খালি একা হতে হতে নিঃশেষ হতে চলেছে। এর উত্তর কেউ জানে না। কেউ জানে না মুক্তি কোথায়? আমাদের রাজনীতি যতদিন আসল কথা না বলবে বা সত্যিকার আদর্শ আর অবস্থান পরিস্কার না করবে ততদিন এমন হ-য-ব-র-লই থাকবে সবকিছু। আমরা প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা রাখি। তিনি আমাদের ভরসার আসল জায়গা। গাজী মাজহারুল আনোয়ার কোন বিষয় না। এমন অনেক মানুষ আছেন দেশে। তাঁর মতো মেধাবী গীতিকার বা সুরকারও কম না। মেধার দেশ আমাদের। মুশকিল কিন্তু বিষয় হলো কেন হঠাৎ তিনি বা তাঁর মতো বিএনপির মানুষ এমন পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেন। আর যদি হনও একদিকে যেমন দেয়া আর একদিকে নেয়াও প্রশ্ন তৈরি করে বৈকি। যারা বলবেন কেন এসব কথা, বা এতে দোষের কি আছে তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করেই বলি, দোষের কিছু নেই। বরং এমনটাই হওয়া উচিত। কিন্তু খালেদা জিয়া কি তা করতেন? বা করতে পারতেন? উদারতার দায় ভাগ আমরা কেবল আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনার ওপর চাপিয়ে দেব আর অন্যের বেলায় কিছু বলব না- এটা কেমন রীতি? এই পুরস্কার যখন বিএনপির সাংস্কৃতিক সম্পাদক নিচ্ছিলেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর আশপাশের এলাকায় কি চলছিল? খুব শান্তিপূর্ণ কিছু হচ্ছিল কি? কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে শেখ হাসিনার ওপর যে রাগ আর উত্তেজনা তার ভেতর কি সহমর্মিতা ছিল? বরং এই সরকারের পতন আর সবর্নাশ কামনাতেই কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের পথ হারা করার চেষ্টা দেখেছি আমরা। সঙ্গে এও বলি, তাদের মারধর করা কিংবা নির্যাতন করাটা ছিল অন্যায়। আইন হাতে তুলে নেয়া অপরাধ। যা বলছিলাম নানা কারণে এই ছবিটি এখন মানুষের মনে প্রশ্ন তুলেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতা ও উদারতা দেশ-বিদেশে প্রশংসিত। তাঁর পিতাও ছিলেন দিলদরাজ। গায়ের চাদর থেকে অন্তর খুলে দেয়া সে মহান নেতাকে কিভাবে বিদায় নিতে হয়েছিল? সে করুণ কাহিনী ভুলিনি আমরা। তাই সাধু সাবধান। বিএনপি ও দুর্জনের ছলে ভুলে কোন ফাঁদে পা দিলে সময় বা নিয়তি দুই-ই আমাদের ছেড়ে কথা বলবে না। আশা করি, এই উদারতা ও ভাললাগা বিরোধী দলের রাজনীতিকে নতুন করা ভাবাবে। তবে একটা প্রশ্নের উত্তর পেতে চাই আমরা। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’- এমন ঐতিহাসিক গানটির গীতিকার কি করে সেই উজ্জ্বল ইতিহাস ছেড়ে পাকিপ্রেমীদের মতো জিন্দাবাদের শিকার হলেন? কি সেই প্রলোভন? আর কেন বা তিনি তাঁর মতো মানুষ শিকার হলেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকারী দলে? এসব না জানা থাকলে আমাদের জীবনও সামনে যাওয়া কখন-ই কণ্টকমুক্ত হবে না। [email protected]
×