ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এদের শ্রমের কোন স্বীকৃতি মেলেনা, আইনী সুরক্ষাও নেই

বেঁচে থাকার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম মর্জিনাদের

প্রকাশিত: ০৪:৫৩, ১৬ জুলাই ২০১৮

 বেঁচে থাকার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম মর্জিনাদের

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মোট ছয় বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন মর্জিনা বেগম। একের পর এক বাসায় রান্নাসহ গৃহস্থালির কাজগুলো শেষ করেন। এক ফাঁকে নিজ ঘরে ফিরে স্বামী-সন্তানদের জন্য রান্না করে আবার বেরিয়ে পড়েন পরবর্তী বাসার কাজে। মাসের ৩০ দিনই তার কর্মদিবস। অন্যরা ছুটি কাটালেও তার কোন ছুটি নেই। নিত্যদিন কাজ তার। অসুখ হলেও রেহাই মেলে না মর্জিনাদের। মালিকরা টাকা কেটে নেন। ক্লান্তি নেই, বিশ্রাম নেই, নেই বিনোদন, নেই উপযুক্ত মজুরি। আর এত পরিশ্রম করে সংসার চালানোর মতো প্রাপ্য টাকাও জোটে না। পুরো মাস পরিশ্রম করে মর্জিনার উপার্জন ১০ হাজার টাকা। তার স্বামী রিক্সা চালান। তাদের দুই সন্তান আছে। মর্জিনার মতো হাজার হাজার নারী গৃহকর্মের সঙ্গে যুক্ত। এদের কেউ ঘরে কাজ করেন কাজের চুক্তিতে, কেউ বা বাসায় ২৪ ঘণ্টা হিসেবে কাজ করেন। যারা চুক্তিতে কাজ করেন, তারা রান্না বা ঘর মোছা বা মাছ, তরকারি কাটাকুটি বা কাপড় কাঁচা বা অন্য কোন কাজ করে মাসে চারশ থেকে সাতশ টাকা করে বেতন পান। তবে এই বেতন নির্দিষ্ট নয়। এলাকা ভেদে বেতনের হেরফের রয়েছে। তবে সব জায়গাতেই সেটি যে নিতান্তই কম তা বলাই বাহুল্য। নিত্যদিন কাজ করলেও শ্রম আইনে নেই মর্জিনাদের নাম। প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কিছু আইনী অধিকার রয়েছে। কিন্তু অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের জন্য তার কিছুই নেই। এদের মধ্যে গৃহশ্রমিকদের অবস্থা আরও করুণ। গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক ও বাংলাদেশ শ্রম অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে প্রায় ৫ কোটি অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক রয়েছে। এর মধ্যে গৃহশ্রমিক রয়েছে ২০ থেকে ২২ লাখ। আইনগত অধিকার ও মর্যাদা পায় না তারা। এক জরিপে বলা হয়েছে, একজন গৃহশ্রমিকের দৈনিক আয় গড়ে ৯০ টাকা। এই বিপুলসংখ্যক কর্মজীবীদের মিলছে না কোন আইনগত অধিকার ও মর্যাদা। শ্রম আইনের বাইরে থেকে যাওয়া এ পেশায় যুক্ত শ্রমিকরা কোন ধরনের আইনী সুরক্ষা পায় না। আর তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার মানুষের সংখ্যাও নিতান্তই কম। এই শ্রমিকের সংখ্যা কত, তা নিয়ে নেই কোন পরিসংখ্যানও। এদের ন্যূনতম কত বেতন হওয়া উচিত, বছরে কতদিন ছুটি পাওনা, আনুষঙ্গিক কী কী সুযোগ সুবিধা মিলবে, নিয়োগ বিধি কী হবে, চাকরি থেকে ছাঁটাইয়ের নীতিমালা কেমন হবে, তার কিছুই নির্দিষ্ট নয় অপ্রাতিষ্ঠানিক এই খাতের শ্রমিকদের জন্য। অর্থাৎ শ্রমিকদের মধ্যেও প্রান্তিক গোষ্ঠী এই গৃহশ্রমিকরা। যিনি কাজ না করলে ব্যাঘাত ঘটত রান্না বা ঘর গোছানোর কাজে, তার শ্রমের স্বীকৃতিটুকু জুটে না। সাধারণভাবে ‘কাজের বুয়া’, ‘কাজের মেয়ে’, ‘কাজের লোক’, ‘খালা’, ‘ঝি’ হিসেবেই পরিচয় তাদের। গৃহশ্রমিকদের জন্য একটি নীতিমালার খসড়ায় সরকার অনুমোদন দিয়েছে আড়াই বছর আগে। কিন্তু এরপর কী হয়েছে তা কেউ জানে না। ২০১৫ সালের ২২ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভায় পাস হওয়া ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ’ নীতিমালা করলেও সেটার প্রয়োগ নেই। ওই নীতিমালায় গৃহকর্মীদের সবেতনে ১৬ সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটি, যৌন হয়রানি ও নির্যাতন, শারীরিক অথবা মানসিক নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করলে সরকারকে মামলা পরিচালনার খরচ দেয়া, গৃহকর্মীদের সহায়তার জন্য ‘হেল্পলাইন’ চালুর কথা বলা আছে। এ ছাড়া চাকরি ছাড়লে বা বিদায় করলে এক মাসের আগাম নোটিস দেয়া, গৃহকর্মী নিয়োগের পর ছবিসহ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করা, শ্রম মন্ত্রণালয়ের তদারকি সেল গঠন, ন্যূনতম বয়স ১৪ আর অভিভাবকের অনুমতি মিললে ১২ বছর হওয়ার কথা। তবে এই নীতিমালাতেও ন্যূনতম বেতন উপেক্ষিত। আবার যেসব সুযোগ সুবিধা বা আইনী সুরক্ষার কথা বলা হয়েছিল, সেটারও বাস্তবায়ন হয়নি এখনও। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিল্স) ২০০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহায়তায় ‘গৃহশ্রমিকদের জীবনযাপন প্রক্রিয়া ও প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধা : একটি সামাজিক গবেষণা পরিচালনা করে। গবেষণায় উঠে আসে গৃহশ্রমিকদের প্রতি বঞ্চনার করুণ চিত্র; তাদের নেই বিশ্রাম-বিনোদনের ন্যূনতম কোন সুযোগ। মুক্ত মানুষ হয়েও চার দেয়ালে তারা বন্দী; বন্দী তাদের শিক্ষা, সুকুমারবৃত্তি আর মানবাধিকার। দেশে বর্তমানে ২০ লাখের বেশি মানুষ গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রমিক রয়েছে যার ৮০ শতাংশই নারী। বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে বিলস। প্রতিষ্ঠানটির সহকারী নির্বাহী পরিচালক ও গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক সমন্বয়কারী, সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ জনকণ্ঠকে বলেন, বিদ্যমান শ্রম আইন ও তার অধীন বিধি-বিধানের আওতায় সংজ্ঞায়িত ও নিয়ন্ত্রিত না হওয়ায় শ্রমিক বলে স্বীকৃত পরিচয় নেই গৃহশ্রমিকদের। এ বিষয়ে আইনী কাঠামো হওয়া এখন সময়ের দাবি বলে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা-২০১৪ নামে একটি নীতিমালার জন্য কমিটি গঠন করা হয়। নীতিমালার খসড়ায় গৃহশ্রমিকদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি, মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা, সন্তানদের শিক্ষা, সাপ্তাহিক ছুটি, অবসরকালীন ভাতা, চিকিৎসাসহ মোট ১৩টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেটি আজ দুই বছরেও আলোর মুখ দেখেনি। এদিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রমিকদের ওপর হয়রানি, নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। গত ২৩ জুন মিরপুর-৬-এর ৯ নম্বর লেনের ৭ নম্বর বাসায় মমতা নামে ১২ বছর বয়সী গৃহকর্মীকে উদ্ধার করে পুলিশ। জানা যায়, তাকে প্রায়ই মারধর করা হতো। ঠিকমতো খাবার দেয়া হতো না। কখনও কখনও চুলের মুঠি ধরে বেধড়ক মারধর করা হতো। উদ্ধারের পর মমতার শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাডয় পুলিশ। এদিকে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে গৃহকর্মী মমতা জানায়, তার বাড়ি নোয়াখালীতে। বাবার নাম বুদ্ধি হাওলাদার। সে দীর্ঘদিন ধরে বাসায় কাজ করছিল। অন্যদিকে অভিযুক্ত গৃহকর্তা সাহাদাত হোসেন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে আইটি বিভাগে কর্মরত। তার স্ত্রী সাত্তা আকবর গৃহিণী। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামি গৃহকর্তা সাহাদাত হোসেন ও তার স্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। বেঁচে থাকার তাগিদে, জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে গৃহকর্মীরা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। কিন্তু অধিকাংশ বাড়িতেই তাদের কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ থাকে না। পান থেকে চুন খসলেই গাল-মন্দ, মারধর এমনকি তাদের তাদের হত্যাও করা হয়। বিচারহীনতার কারণেই গৃহশ্রমিক নির্যাতন বাড়ছে বলে মনে করেন গৃহশ্রমিক নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ও বিলসের সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘গৃহকর্মী হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে ঘটনাসমূহ আপোস করা এবং এসব ক্ষেত্রে বিচারহীনতার কারণেই। একমাত্র শিশু গৃহকর্মী আদুরি নির্যাতনের ঘটনায় অপরাধীর কঠিনতম শাস্তি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অথচ এমন অনেক মামলা আছে যেগুলো বছরের পর বছর ধরে ঝুলে আছে। এসব মামলায় আবার উভয়পক্ষের মধ্যে আপোসের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে।’
×