ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সক্রিয় চোরাকারবারি চক্র

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ১৬ জুলাই ২০১৮

 সক্রিয় চোরাকারবারি চক্র

স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর ॥ জেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বানের পানির মতো আসতে শুরু করেছে গরু মোটাতাজাকরণ ট্যাবলেট। হঠাৎ করেই হিলি সীমান্ত দিয়ে গরু মোটাতাজাকরণের নিষিদ্ধ ট্যাবলেটের চোরাচালান বেড়ে গেছে। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে সংঘবদ্ধ চোরাচালানকারী চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ভারত থেকে দেশে পাচার করে আনছে কোটি কোটি টাকার এসব ট্যাবলেট। মাঝে মধ্যে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে নিষিদ্ধ ট্যাবলেটের কিছু চালান ধরা পড়লেও অধিকাংশ চালানই আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। হাতবদলের মাধ্যমে এসব ট্যাবলেট চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত গরুর খামারগুলোতে। অতি মুনাফালোভী কিছু ব্যক্তি এসব ট্যাবলেট খাইয়ে অল্প দিনের মধ্যেই গরুকে মোটা দেখিয়ে বিভিন্ন হাটে বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছে। হিলি সীমান্তের কয়েকটি বিজিবি ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে, গত মাসের ২৫ ও ৩০ তারিখে দুটি চালানের মাধ্যমে ২ লাখ ২৮ হাজার পিস ডেক্সিন ট্যাবলেট ও ২৮ হাজার প্রাকটিন ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। চলতি জুলাই মাসের ৩, ৭, ১২, ১৩ তারিখে ৪টি চালানের মাধ্যমে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৫০ প্রাকটিন ট্যাবলেট, ৯ লাখ ৪০ হাজার ডেক্সিন ট্যাবলেট ও ৭২ হাজার ৬শ পিস সিজেট ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। এসব ট্যাবলেট মূলত গরু মোটাতাজাকরণ কাজে ব্যবহার করা হয়। দুই মাসে অন্তত ২০ লাখ ৩০ হাজার ৫৫০পিস নিষিদ্ধ গরু মোটাতাজাকরণ ট্যাবলেট উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। উদ্ধার করা এসব ট্যাবলেটের বিজিবি নির্ধারিত মূল্য ৬ কোটি ৯লাখ ১৬ হাজার ৫শ’ টাকা। তবে ধরা পড়ার পরও সীমান্ত দিয়ে থামছে না চোরাকারবারীদের তৎপরতা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সীমান্তে চোরাচালান প্রতিরোধে কঠোর অবস্থানের কথা বলছেন বিজিবি কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী জানান, দিনাজপুরের হিলিসহ আশপাশের সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারত থেকে দেশে যেসব গরু মোটাতাজাকরণ ট্যাবলেট আসে, তার পুরোটাই সরবরাহ করে থাকেন ভারতের হিলি অংশে অবস্থিত সোনু মনু নামের এক ব্যক্তি। তিনি জানান, ভারতে প্রতি হাজার প্রাকটিন ট্যাবলেটের দাম পড়ে ২২০ টাকা। আর সাদা রঙের ডেক্সিন ট্যাবলেটের প্রতি হাজারে দাম পড়ে ২৯০ থেকে ৩শ’ টাকা। প্রকারভেদে ১২, ১৫, ১৮ হাজার করে একেকটি প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোড়ানো হয়। প্রতিটি প্যাকেট ভারত থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ এবং হিলির পাশের ঘোড়াঘাট থানায় পৌঁছানো পর্যন্ত ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা করে খরচ পড়ে। আর ভারতের মহাজনের কাছ থেকে সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য ভারত অংশের পাচারকারীরা প্যাকেট প্রতি ৩ থেকে ৪ হাজার রুপী করে নিয়ে থাকে। ওই ব্যবসায়ীর দাবি, সীমান্ত পার করার সময় একটি বাহিনীর সদস্যরা এই চোরাচালান থেকে বখরা আদায় করে থাকে। প্রতিটি প্যাকেট দেশে ঢোকার বিনিময়ে দেড় থেকে আড়াই হাজার টাকা উৎকোচ নিয়ে থাকে তারা। গরু মোটাতাজাকরণের এসব ট্যাবলেট রাজধানী পর্যন্ত পাচারের রুটও জানান ওই ব্যবসায়ী। তিনি জানান, হিলি সীমান্ত পার করার পর এসব ট্যাবলেট চলে যায় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থানা এলাকায়। সেখান থেকে সিএনজি, বাসসহ বিভিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে চলে যায় বগুড়ায় খান মার্কেটে। সেখান থেকে ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় চলে যায় এসব নিষিদ্ধ ট্যাবলেট। পরে সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে তা সরবরাহ করা হয়। তিনি জানান, বগুড়ায় এসব সাদা রঙের ডেক্সিন ট্যাবলেট বিক্রি হয় ৩৯০ টাকা হাজার দরে এবং লাল রঙের প্রাকটিন ট্যাবলেট বিক্রি হয় ২৭০ থেকে ২৮০ টাকা হাজার দরে। ঢাকায় এসব ট্যাবলেটের দাম আরেকটু বেশি। সীমান্ত এলাকা ছাড়া দেশের অন্যান্য স্থানে এসব ট্যাবলেট বহনে তেমন কোন প্রশাসনিক ঝামেলা পোহাতে হয় না। প্রতি বছর কোরবানির ঈদের আগে এসব ট্যাবলেটের চোরাচালান বেশি হয়ে থাকে বলে জানান ওই ট্যাবলেট ব্যবসায়ী। জানা গেছে, কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে একশ্রেণীর অসাধু খামারি গরু মোটাতাজাকরণে মরিয়া হয়ে ওঠে। আর এ কারণে দেশের খামারিদের কাছে বেড়ে যায় গরু মোটাতাজাকরণ কাজে ব্যবহৃত এসব ট্যাবলেটের চাহিদা। আর এই চাহিদাকে পুঁজি করে চোরাকারবারীরা মরিয়া হয়ে উঠে সীমান্ত পথে ভারত থেকে গরু মোটাতাজাকরণ ট্যাবলেট পাচার করে দেশে আনতে। এ কারণে এবারও সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রবেশ করছে কোটি-কোটি টাকার গরু মোটাতাজাকরণ ট্যাবলেট। হাকিমপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. নাসিরুল ইসলাম জানান, প্রতিবছরের মতো এবারও কোরবানির ঈদ ঘিরে হিলি সীমান্ত এলাকাতেও গরু মোটাতাজাকরণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ এসেছে। এ ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এখানে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবীর মাধ্যমে এবং আমরা নিজেরাও এসব এলাকায় যারা গরু মোটতাজাকরণ করছেন, তাদের প্রতি কঠোর নজরদারি রাখছি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অথবা সভা-সেমিনার ও উঠান বৈঠকের মাধ্যমে তাদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। তারা যেন প্রাকৃতিক উপায়ে দানাদার খাদ্য খড় ও ঘাস খাইয়ে গরু মোটাতাজাকরণ করেন। কোনোভাবেই যেন ভারতীয় নিষিদ্ধ ট্যাবলেট দিয়ে গরু মোটাতাজাকরণ না করে এবং তারা যেন এসব ব্যবহারও করতে না পারে সেদিকে বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর পরও কেউ যদি গরু মোটাতাজাকরণ কাজে ট্যাবলেট ব্যবহার করে, সেটি জানতে পারলে তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি জানান, যদি কোনও খামারি এইসব ট্যাবলেট খাইয়ে গরু মোটাতাজাকরণ করেন, তাহলে গরুর শরীরে পানি জমবে, গরুকে অত্যধিক মোটা দেখা যাবে। গরু অবশ হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই আমরা বার বার খামারিদের সতর্ক করছি, তারা যেন কোনভাবেই এই নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে গরু মোটাতাজাকরণ না করেন। দিনাজপুর আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডাঃ আমির আলী জানান, কৃত্রিমভাবে মোটাতাজাকরণে যেসব ট্যাবলেট গরুকে খাওয়ানো হয়, সেগুলো মাংসের মাধ্যমে মানুষের দেহে পৌঁছালে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। মানুষের রক্তনালী, কিডনি, লিভারসহ সব জায়গাতে চর্বি জমে যায় এবং শরীর ফুলে যায়। এসময় হার্ট, ফুসফুস, লিভার, কিডনি দুর্বল হয়ে পড়ে। জয়পুরহাট-২০ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল রাশেদ মোহাম্মদ আনিছুল হক বলেন, ‘সীমান্ত দিয়ে গরু পাচার ও গরু মোটাতাজাকরণ ট্যাবলেটের চোরাচালান রুখতে গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে। বেসামরিক সোর্সও নিয়োগ করা হয়েছে। এছাড়া আমাদের সঙ্গে পুলিশ ও র‌্যাবসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাও কাজ করছে।
×