ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দেশে মাছের উৎপাদন ২৫ গুণ বৃদ্ধি

প্রকাশিত: ০৪:১০, ১৬ জুলাই ২০১৮

দেশে মাছের উৎপাদন  ২৫ গুণ বৃদ্ধি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ সারা বিশ্বে মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানা গেছে। সম্প্রতি দেশের পুকুর ও খালে মাছ চাষে নীরব বিপ্লব ঘটেছে। বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ২৫ গুণ। তিন দশকে মাছের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই অর্জন। দেশে উৎপাদিত মাছের ৭৫ শতাংশ এখন বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করছেন মাছ চাষীরা। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) সর্বশেষ সমীক্ষায় এ তথ্য জানানো হয়েছে। আইএফপিআরআই’র সমীক্ষায় বলা হয়, বাড়তি চাহিদা, প্রযুক্তির উন্নয়ন, যোগাযোগ অবকাঠামো, লাখ লাখ পুকুর মালিক এবং ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তার বিনিয়োগে বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন দ্রুত গতিতে বেড়েছে। বাংলাদেশে প্রধানত নিজেদের পারিবারিক প্রয়োজনে মাছ চাষের ধারণা এখন বদলে গেছে। ভোক্তাদের এখন নিজের পুকুরের মাছ খাওয়ার সঙ্গে বাজার থেকে মাছ কেনার প্রবণতাও বেড়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে ওই সমীক্ষায়। সমীক্ষায় বলা হয়, আগে গ্রামের মাছ চাষীরা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে মাছ বিক্রি করলেও এখন তারা তাদের উৎপাদিত মাছের দুই -তৃতীয়াংশ ছোট-বড় শহরে আড়তদারদের কাছে বিক্রি করছেন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে মাছ উৎপাদন হয়েছিল ২৭ লাখ ৪১ হাজার মেট্রিক টন। সরকারের যথাযথ উদ্যোগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬৮ হাজার ৩০৫ মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি করে আয় করেছে ৪ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। সরকারের উন্নয়নমুখী নানা উদ্যোগ ও সেবা দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মাছ উৎপাদন ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাছ উৎপাদন হয়েছে ৪০ লাখ ৫০ হাজার টন। মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরেই বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসর্ম্পূণতা অর্জন করেছে এমন ঘোষণা আসবে। মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে মৎস্য খাতের অবদান ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। মোট কৃষি আয়ের ২২ দশমিক ৬ শতাংশই মৎস্য খাত থেকে। দেশের রফতানি আয়ের ৪ শতাংশের বেশি আসে মৎস্য খাত থেকে। এ ছাড়াও দৈনন্দিন খাদ্যে প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ জোগান দেয় এই মৎস্য খাত। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকারের ভিশন ২০২১-এ দেশের মাছের উৎপাদন ৪৫ লাখ মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়েছে, যা বর্তমান উৎপাদনের চেয়ে ১০ লাখ মেট্রিক টন বেশি। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, দেশের প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যা মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশ। বছরে প্রায় ৬ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে এই সেক্টরে। বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ইলিশের অবদান ১ দশমিক ১৫ শতাংশ। এদেশের মোট উৎপাদিত মাছের ১২ শতাংশই ইলিশ। এর অর্থমূল্য আনুমানিক সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। আর ইলিশ রফতানির মাধ্যমে আসে ১৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, প্রতিবছরই বাড়ছে ইলিশের উৎপাদন। মাত্র দেড় দশকের ব্যবধানে এ সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ২ লাখ টনের ঘর। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৮৬-৮৭ সালে দেশে ইলিশ উৎপাদন হতো ১ লাখ ৯৫ হাজার টন। ২০০২-০৩ অর্থবছরে ১ লাখ ৯১ হাজার টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৯৫ হাজার টন। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা তথ্যমতে, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদ-নদীতে এই মাছ পাওয়া যাচ্ছে। পদ্মার শাখানদী মহানন্দা থেকে শুরু করে মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওড় এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেদির হাওড়েও এ বছর ইলিশ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুসারে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম তিন মাস (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মেয়াদে হিমায়িত ও জীবিত মাছ রফতানিতে আয় হয়েছে ১৬ কোটি ৮১ লাখ ৮৪ হাজার ইউএস ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪২ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেশি। আর আগের অর্থবছরে একই সময়ের তুলনায় তা ২৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। গত বছরে প্রথম তিন মাসে ১৩ কোটি ৬১ লাখ এক হাজার ডলারের মাছ রফতানি হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হিমায়িত ও জীবিত মাছ রফতানিতে আয় হয়েছিল ৫২ কোটি ৬৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার। চলতি অর্থবছরে এই খাতের রফতানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেছেন, মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ এখন মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ বিশ্বে মাছ উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে। গবেষণার মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া অনেক প্রজাতির মাছ এখন চাষ করা হচ্ছে। সরকারী-বেসরকারীভাবেও হারিয়ে যাওয়া মাছ চাষ হচ্ছে। মাছ চাষে আরও গবেষণা হবে। এ ছাড়াও মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষায় সরকার ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। ইলিশ ধরা বন্ধকালীন জেলেদের নানা ধরনের সহায়তাও দেয়া হচ্ছে। সরকার ২০১৯ সালের মধ্যে দেশকে মাছ চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে বর্তমান উৎপাদন ৩৮ লাখ টন থেকে বাড়িয়ে ৪২ লাখ টনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এ লক্ষ্যে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও মৎস্য অধিদফতর যৌথভাবে কাজ করছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও দেশে লবণাক্ত পানিতে মাছ উৎপাদন হয়েছে ছয় লাখ ৯৭ হাজার টন। আর মিঠাপানির মাছ উৎপাদন হয়েছে ৩৩ লাখ ২০ হাজার টন।
×