ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সুজাত মনসুর

কারলাইল কেন লন্ডন বাদ দিয়ে দিল্লীকে বেছে নিলেন?

প্রকাশিত: ০১:২৮, ১৫ জুলাই ২০১৮

কারলাইল কেন লন্ডন বাদ দিয়ে দিল্লীকে বেছে নিলেন?

মি. কারলাইল বিলেতের একজন বিশিষ্ট আইনজীবী-কাম সম্মানিত লর্ড। বেশ কয়েক বছর ধরেই তিনি লন্ডনে বসে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে, বিশেষ করে রাজনীতি নিয়ে একটি বিশেষ মতাদর্শের রাজনৈতিক জোটের পক্ষে লবিং থেকে শুরু করে যা যা দরকার, তাই করছেন। এই জোটটি হলো বিএনপি-জামায়াত জোট। তার এ তৎপরতার সূচনা মূলত বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার প্রেক্ষিতে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই চার যুগের অধিক তামাদি হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে। এই যুদ্ধাপরাধীদের অধিকাংশই জামায়াতে ইসলামের নেতা-কর্মী। যাদের মধ্যে জামায়াতের শীর্ষনেতা গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা, দেলাওয়ার হুসাইন সাইদী এবং বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আব্দুল আলিম অন্যতম। বিএনপি শুরু থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সরাসরি বিপক্ষে। খালেদা জিয়া প্রকাশ্য জনসভায় যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ ও তাদের মুক্তির দাবি জানিয়েছে। বিএনপি-জামায়াত কোটি কোটি টাকা খরচ করে লবিষ্ট নিয়োগ করে বিদেশে, এমনকি জাতিসংঘেও তদ্বির করার চেষ্টা করেছে। আর সেই আন্তর্জাতিক লবিংয়ের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে লন্ডন ও লর্ড কারলাইলকে। এদিকে খালেদা জিয়ার বড়ছেলে তারেক রহমান (বাংলাদেশে আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত) ও বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত চৌধুরী মঈনুদ্দিন লন্ডনে অবস্থান করছে। তারেক রহমান বাংলাদেশে সেনা-সমর্থিত তিন উদ্দিনের সরকারের সময় জেলে বছরখানেক কাটিয়ে রাজনীতি করবে না মুচলেকা দিয়ে চিকিৎসার নামে লন্ডনে এসে বসবাস করছে। অন্যদিকে মঈনুদ্দিন স্বাধীনতার পর পরই লন্ডনে এসে অবস্থান নিয়েছে এবং বাংলাদেশ বিরোধী যত ধরনের তৎপরতা সম্ভব চালিয়ে যাচ্ছে। দু’জনেই সাজাপ্রাপ্ত আসামি, অঢেল সম্পদের মালিক এবং দু’জনেরই কাজ হলো লন্ডনে বসে বাংলাদেশ বিরোধী সব প্রকার তৎপরতা চালানো। আশ্চর্যের বিষয় হলো-যুক্তরাজ্য বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের পাদপীঠ ও আইনের শাসনের ব্যাপারে চ্যাম্পিয়ন বলে সুখ্যাতি থাকলেও দেশটিতে বিশ্বের যত দাগী, খুনী, স্মাগলার, ডাকাত, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনকারী শুধু তথাকথিত মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে বেঁচে-বর্তে থাকতে পারে। অনেকেই রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আর্থিক সহায়তা পায়। দেশটি নাৎসিদের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স দেখালেও বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বিশেষ করে সরকারী দল ও বাংলাদেশ হাইকমিশন সেভাবে তৎপর নয়। যুক্তরাজ্যের সরকারী দলের হাতেগোনা কয়েক ব্যক্তি ছাড়া এ ব্যাপারে কারও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। সবাই যেন নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। এমনকি দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে আওয়ামী লীগ ঘরানার কেউ কেউ জামায়াত-বিএনপি নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশনগুলোর টকশোতে এমন সব ব্যক্তির উপস্থাপনায় টকশোতে অংশ নেয়, যারা মূলত কারলাইলদের সঙ্গে জোটের পক্ষ থেকে লিয়াঁজো রক্ষা করে। কারলাইলদের এই অশুভ তৎপরতা সম্পর্কে ইতোপূর্বেও জনকণ্ঠে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। শুরুতেই উল্লেখ করেছি, লর্ড কারলাইল বিএনপি-জামায়াত জোটের লবিষ্ট। তিনি যে কেবল শুধুই লবিষ্ট তা কিন্তু নয়, তিনি হলেন তাদের আন্তর্জাতিক লবিষ্ট গোষ্ঠীর পালের গোদা। হাউস অব কমন্স থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক এমন কোন ফোরাম নেই যেখানে তারা লন্ডনে বসে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য চেষ্টা চালায়নি। এমনকি জাতিসংঘের মহাসচিবসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান পর্যন্ত তদ্বির চালিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। এর বিনিময়ে মোটা অঙ্কের পাউন্ড মি. কারলাইলরা হাতিয়ে নিয়েছে এবং এটাই স্বাভাবিক। তাদের পেশাই হলো এটা। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা আমলে নেননি। কেননা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তাদের সাজা কার্যকর করা তাঁর নির্বাচনী অঙ্গীকার। তারা যে শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্যই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করে তা কিন্তু নয়। মানবাধিকার, মুক্তমতের অবাধ স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক পরিবেশ, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি বিরূপ আচরণের বিষয়ে বানোয়াট কল্পকাহিনী প্রচার করে বাংলাদেশকে বন্ধুহীন করতে না পারুক অন্তত বহির্বিশ্বে যাতে বাংলাদেশ সরকার ও শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করতে পারে সে চেষ্টায় বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছে তারেক রহমান ও মঈনুদ্দিন গংয়ের ছক অনুযায়ী। বাংলাদেশ সরকার কারলাইলের ভিসা আবেদন নাকচ না করে, বিবেচনাধীন থাকা অবস্থায়ই খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করিয়ে দিল্লীতে বসে বাংলাদেশের রাজনীতি ও খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করার পাঁয়তারা ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রেরই অংশ। বিএনপির অপরিপক্ব হাইকমান্ড (যে মূলত খালেদা জিয়া জেলের বাইরে থাকাকালীনও অঘোষিত হাইকমান্ডের দায়িত্ব পালনকারী) তারেক রহমানের পরামর্শেই লর্ড কারলাইল ভারতের রাজধানী দিল্লীকে বেছে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিষোদগার করার জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে কেন? তিনি তো সেটা বাংলাদেশে এসেও করতে পারতেন। বাংলাদেশ সরকার তো তার ভিসা আবেদন নাকচ করেনি, বিবেচনাধীন রেখেছে। ধরে নিলাম তার অতীত কার্যকলাপ বিবেচনায় বাংলাদেশ সরকার তাকে ভিসা দিলো না। কেননা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি কিংবা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বা অন্যকোন যৌক্তিক কারণে সরকার তাকে ভিসা না দেয়ার অধিকার রাখে (এমনকি কারলাইলের চেয়েও অধিক ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে কোন ধরনের কারণ দর্শানো ছাড়াই সরকার তা করতে পারে)। সে ক্ষেত্রে কারলাইল তো লন্ডনে বসেই তার কাক্সিক্ষত সাংবাদিক সম্মেলনটি করতে পারতেন। তা না করে তিনি ভিসার সব প্রকার শর্ত ভঙ্গ করে বাংলাদেশের প্রতিবেশী, মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত (জিয়া ও খালেদা জিয়ার শাসনামল বাদ দিয়ে) আমাদের অকৃত্রিম বন্ধুরাষ্ট্র ভারতকে বেছে নিলেন কেন? এর উত্তর ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমারের বক্তব্যেই রয়েছে। তিনি বলেছেন, লর্ড কারলাইলের ভিসা বাতিলের কথা তাকে আগেই জানানো হয়েছিল। তিনি যে কাজের জন্য ভারত সফরে আসতে চাচ্ছিলেন ভিসা আবেদনের ফর্মে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেননি। ভিসা আবেদনের ফর্মে তিনি ভারত সফরের যে উদ্দেশের কথা উল্লেখ করেছিলেন, সেটির সঙ্গে তার ভারতে আসার মূল উদ্দেশ্যের মিল না থাকায় ভিসা বাতিল করা হয়েছিল। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সমস্যা তৈরি করতে তিনি (কারলাইল) এসেছিলেন এটা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। এর ফলে বাংলাদেশের বিরোধীদলগুলোর সঙ্গেও আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হতে পারত। তার কিছু বলার থাকলে উনি কেন লন্ডন থেকে বলেননি? কেন ভারতে এসেছিলেন? এখানে এলে আমাদের দেশের আইন মানতে হবে। তাকে জানতে হবে বাণিজ্যিক ভিসায় এসে সাংবাদিক সম্মেলন করা যায় না। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের কথাই ঠিক। ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করাই ছিল তার মুখ্য ও একমাত্র উদ্দেশ্য। তারেক রহমান ও জামায়াতের ভুল রাজনীতির জালে আটকে পড়া দিশেহারা বিএনপির এটিও একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তারা দেশে সুবিধা করতে না পেরে এতদিন বিদেশীদের কাছে ধরনা দিয়েছে হারানো ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য। কিন্তু শেখ হাসিনার সততা, নিষ্ঠা, সময়োপযোগী, বিচক্ষণ ও সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে সুবিধা করতে পারেনি। শেষমেশ তারা ভারতের কাছেও ধরনা দিয়েছে, যেভাবেই হোক তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়ার জন্য। যদিও ভারতবিরোধী স্লেøাগান ও রাজনৈতিক শক্তিই তাদের মূল পুঁজি। এমনকি তাদের শাসনামলে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়-ট্রেনিং দেবার বিষয়টি নিশ্চয় ভারত ভুলে যাওয়ার কথা নয়। বিএনপি কি করে ভাবল সেই ভারত আবার তাদের অত্যন্ত ভাল বন্ধু শেখ হাসিনা সরকারকে হটিয়ে বিএনপি-জামায়াতকে ক্ষমতায় বসাতে সহায়তা করবে? অন্যদিকে ভারত একটি ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক দেশ, তারা কেন অন্য একটি স্বাধীন দেশের রাজনীতি ও ক্ষমতার পালাবদলে ভূমিকা রাখবে? সুতরাং যৌক্তিক কারণেই বিএনপির ভারত মিশন ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং, দেশে দিন দিন জনবিচ্ছিন্ন হওয়া দলটির দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আইনজীবী নিয়োগের নামে লর্ড কারলাইলকে দিয়ে দিল্লীতে সাংবাদিক সম্মেলন করানোর সিদ্ধান্ত বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির চরম রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বেরই প্রকাশ। আমার ধারণা, ব্রিটিশ লর্ড কারলাইল ভারত সরকার তাকে দিল্লীতে সাংবাদিক সম্মেলন করা দূরে থাক, ভারতের মাটিতে পাও রাখতে দেবে নাÑ তিনি তা জানতেন। কেননা, ভিসার শর্ত ভঙের কারণে তার ভিসা যে বাতিল করা হয়েছে তা আগেই জানানো হযেছিল। তবুও তিনি গিয়েছেন এবং যথারীতি পত্রপাঠ ফেরত এসেছেন। আবারও প্রশ্ন জাগে, ভিসা বাতিল হয়েছে জানা সত্ত্বেও কেন কারলাইল ভারতে প্রবেশের চেষ্টা নিলেন? উত্তর অতি সহজ, পাউন্ড হালালকরণ ও ভারত গণতান্ত্রিক দেশ হলেও মুক্তমত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই তা প্রমাণের চেষ্টা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিবৃতিতে কিন্তু তাই উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, বিএনপি মনে করে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে মুক্তচিন্তা অনুশীলনের সঙ্গে এই ঘটনা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিন্তু ফখরুল ও কারলাইলরা বুঝতে পারেননি বিষয়টি তাদের জন্যই বুমেরাং হয়ে যাবে। একজন সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন মানুষের পক্ষেও অনুধাবন করা কঠিন নয় যে, বিষয়টি ছিল বিএনপি নামক অস্তগামী একটি দলের হাস্যকর ও অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত। যা দলটির আরেকটি চরম দেউলিয়াত্বেরই বহির্প্রকাশ। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য; প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা তরিকুল ইসলামের একটি মন্তব্য দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। সম্প্রতি চরমভাবে রোগাক্রান্ত তরিকুল ইসলাম তার যশোরের বাসভবনে বিএনপির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, “জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, আই উইল মেইক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর পলিটিশিয়ান্স।’ আর তারেক রহমান বিএনপি করাই কঠিন করে দিয়েছে।” বাস্তবতা তো তাই। বিএনপির অন্তিম পরিণতি এখন সময়ের ব্যাপার বলেই মনে হয়। ১৪ জুলাই, ২০১৮ লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক
×