ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৫ জুলাই ২০১৮

পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই ॥ প্রধানমন্ত্রী

তৌহিদ আক্তার পান্না, ঈশ্বরদী ॥ রূপপুর পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র সুরক্ষায় সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। শনিবার পাবনার রূপপুরে দেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণে কংক্রিট ঢালাই কাজ উদ্বোধন করে দেশবাসীকে তিনি আশ্বাসের কথা শোনান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র এমনভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে যাতে কোন দুর্ঘটনা ঘটতে না পারে। আমরা নিরাপত্তার দিকটায় বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। যে কোন দুর্যোগে এটি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটা বিবেচনায় নিয়েই এই প্লান্টের ডিজাইন করা হয়েছে। এই বিদ্যুত কেন্দ্র পরিচালনা নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া ও ভারত বাংলাদেশের জনবলকে প্রশিক্ষিত করছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ইউরি ইভানোভিচ বরিশভ, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা আইএইএ পরিচালক দোহি হ্যান, রোসাটমের উপমহাপরিচালক আলেকজান্দার রাস্কিনও বক্তব্য রাখেন। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংবলিত সর্বাধুনিক থার্ড জেনারেশন প্রযুক্তি দিয়ে এই প্লান্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। ব্যবহৃত তেজষ্ক্রিয় জ্বালানি সরিয়ে নিতে রাশিয়া বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ৬৮ মাসের এই বিদ্যুতকেন্দ্রের মূল স্থাপনা নির্মাণ করবে রাশিয়ার কোম্পানি এ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট। বাংলাদেশের উন্নয়নে বাঙালী জাতিকে আর কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রের মতো প্রকল্প যে করা সম্ভব তার ধারণা কারও মাথায় ছিল না। দেশ স্বাধীন না হলে এ ধরনের প্রকল্প করারও সুযোগ হতো না। দেশ স্বাধীন হবার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নতুন করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী কাজের বেশ খানিকটা অগ্রগতি হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নিহত হবার পর অনেক কর্মসূচীর মতো এ প্রকল্পের কাজও বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর আমরা জ্বালানি নীতিতে পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করি। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য বিদ্যুত অপরিহার্য্য। দেশীবিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণীয় করার জন্য প্রথমে প্রয়োজন পর্যাপ্ত এবং নির্ভরযোগ্য বিদ্যুত সরবরাহ। সাধারণ মানুষও সবকিছুর আগে বিদ্যুত চান। আমরা দেশের সকল মানুষের কাছে এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক সেক্টরে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করছি। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের সময় আমরা বিদ্যুত পেয়েছিলাম মাত্র ৩২০০ মেগাওয়াট। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় তখন ভয়াবহ লোডশেডিং হতো। জনগণকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ দেয়ার জন্য রূপপুর প্রকল্পের কাজ শুরু করি। নির্মাণ কাজ শেষ হলে এ প্রকল্প থেকে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হবে যা জাতীয় গ্রীডে যোগ করা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে আমরা নানাভাবে দেশে ১৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করে ৯৩ ভাগ বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছি। যেখানে যেটা করা সম্ভব আমরা সেখানে সেটাই করছি। এলাকাবাসীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নিরাপত্তার বিষয়টিকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি। রাশিয়ান সরকারের ত্রি-প্লাস রি-এ্যাক্টর দিয়ে এ প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের পরমাণু জগতের ৩৩তম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ প্রকল্পের জন্য রাশিয়ান সরকারের বিশেষ সহযোগিতার জন্য রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্যাটেলাইট জগতেও দেশ এখন ৫৭তম স্থান অধিকার করেছে বাংলাদেশ। এসব কিছুই আমাদের সরকারের অর্জন। সকল প্রকার অর্জনকে অব্যাহত রাখার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ গ্র্যাজুয়েশন পেয়েছে। ২০৪১ সালে এদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গড়ে তোলা হবে। দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, আমরা একটি সুখী সমৃদ্ধ উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি। যে বাংলাদেশ হবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। আজ আমরা সোনার বাংলা বিনির্মাণের পথে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছি। গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ সবক’টি শর্ত ভালভাবে পূরণ করে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় প্রবেশ করেছে। এর আগে ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা দিয়েছে। আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নয়, অনেক উন্নত দেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। বিগত এক দশক ধরে বাংলাদেশ সাড়ে ছয় শতাংশের বেশি হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। যা এ বছর ৭.৭৮ শতাংশে পৌঁছবে বলে আশা করা যাচ্ছে। মাথাপিছু আয় গত নয় বছরে ৫৪৩ মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১ হাজার ৭৫২ ডলার হয়েছে। দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৪১.৫ শতাংশ হতে ২২ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে ৭২ বছর হয়েছে। শিক্ষার হার ৭৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। পরিশেষে সকলকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমাদের উন্নয়ন অভিযাত্রায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এগারোটা ৫০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের একটি হেলিকপ্টারে এসে প্রকল্পের অভ্যন্তরের হেলিপ্যাডে নেমে বিএমডব্লিউ গাড়িতে করে এসে বারোটায় কুন্নিতে সিমেন্ট নিয়ে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটের প্রথম কংক্রিট ঢালাই উদ্বোধন করেন। এ সময় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস উসমান, ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ এমপি, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মনি, রুশ ফেডারেশনের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইউরি ইভানোভিচ বোরিশভ, আইএইএর পরিচালক দোহী হ্যান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব আনোয়ার হোসেন, পরমাণু কমিশনের চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক ও প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবরসহ অন্যান্য দেশী-বিদেশী উর্ধতন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। বেলা বারোটা ৪০ মিনিটে ফলক উন্মোচন শেষে মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন। একটা ২৮ মিনিট থেকে একটা ৪০ মিনিট পর্যন্ত ১২ মিনিট বক্তব্য দেন। পরে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সফর সঙ্গীদের বিশাল গাড়ি বহর নিয়ে বেলা দুটো ১০ মিনিটে সড়ক পথে পাবনা পুলিশ লাইন মাঠের জনসভার উদ্দেশ্যে প্রকল্প এলাকা ত্যাগ করেন।
×