ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চাহিদার ১১ ভাগ মাছ উৎপাদিত হচ্ছে ময়মনসিংহ জেলায়

মাছ চাষ করেই কর্মসংস্থান

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ১৫ জুলাই ২০১৮

মাছ চাষ করেই কর্মসংস্থান

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ২৮ বছর আগের কথা। বেকারত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে তিন একর জমি ইজারা নেন উচ্চ শিক্ষিত নুরুল হক। সম্বল বলতে মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে বিনিময়ে নেয়া মাত্র ৩০ হাজার টাকা। এই অল্প পুঁজি নিয়েই রুই মাছের রেণু উৎপাদনে মনোনিবেশ করেন তিনি। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পরিশ্রম, অদম্য ইচ্ছা আর দৃঢ় মনোবলকে পুঁজি করে এখন সদর উপজেলার পুলিয়ামারী এলাকায় গড়ে তুলেছেন ব্রহ্মপুত্র ফিস ফিড কমপ্লেক্স। সময়ের ব্যবধানে বদলেছেন নিজের ভাগ্যের চাকাও। কিনেছেন ২০ একর জমি। হ্যাচারি ব্যবসার রোল মডেল নুরুল হক আজ নগররের জেলা স্কুল মোড় এলাকায় ৫তলা বাড়ির মালিকও। শুধু কী নুরুল হকই? রূপালী বিপ্লবে দিনবদলের এমন উদাহরণ কম নয়। জেলার ত্রিশাল উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ জয়নাল আবেদিনের কথাই ধরা যাক! প্রায় দুই যুগ ধরে মাছ চাষ করে অঢেল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন তিনি। উপজেলার ত্রিশাল ইউনিয়নের কোনাবাড়ি এলাকায় ১০০ একর জমির ওপর তার মাছের খামার। খামারে দিন-রাত কাজ করেন প্রায় ৩৫ জন শ্রমিক। কয়েক লাখ পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, রুই, কাতল মাছ রয়েছে খামারটিতে। ময়মনসিংহ সদর উপজেলার শম্ভুগঞ্জ, ত্রিশাল ও ভালুকা উপজেলায় হাজার হাজার যুবক ব্যক্তি উদ্যোগে বাড়ির আশপাশে পুকুরে মাছ চাষ করে রীতিমতো এক বিপ্লব ঘটিয়ে বসেছেন। এই রূপালী বিপ্লবে তারা বেকারত্ব ঘুচানোর পাশাপাশি অবদান রাখছে জাতীয় অর্থনীতিতেও। ময়মনসিংহ জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যমতে, জেলার এসব উপজেলায় বিভিন্ন হ্যাচারি থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ কেজি রেণু পোনা উৎপাদিত হচ্ছে। জাতীয়ভাবে উৎপাদিত মাছের ১১ ভাগ উৎপাদিত হচ্ছে এই জেলা থেকে। এই জেলায় প্রতি বছর উৎপাদিত হচ্ছে ৪ লাখ ৪০ হাজার ৮২৬ টন মাছ। যার বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। এমনকি ঢাকায় মাছের চাহিদার অন্তত ৭০ ভাগের জোগান দিচ্ছে ময়মনসিংহ। ঢাকার ছাড়াও প্রতিদিন ৩০০ থেকে সাড়ে ৩৫০ টন মাছ যাচ্ছে সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে চীন, কুয়েত ও কাতারসহ বিভিন্ন দেশেও রফতানি হচ্ছে ময়মনসিংহের মাছ। জানা যায়, এক সময় ময়মনসিংহ-ঢাকা মহাসড়কের দুই পাশে ছিল আদিগন্ত বিস্তৃত ধানের জমি। কিন্তু এখন ধানের জমিগুলো বিলীন হয়ে গেছে! সেখানে এখন বিশাল আকারের পুকুরের পর পুকুর। অর্থাৎ, মাছের খামার। মূলত আশির দশকের শেষের দিকে শুরু হয় এই রূপালী বিপ্লব। নব্বইয়ের দশকে এটি পরিপূর্ণতা পায়। ধান বা পাট চাষের তুলনায় মাছ চাষ অনেক বেশি লাভজনক হওয়ায় কৃষক এবং বেকার যুবকরা ঝুঁকেন মাছ চাষে। ত্রিশাল ও ভালুকা উপজেলা ছাড়াও সদর উপজেলার শম্ভুগঞ্জ, গফরগাঁও, ফুলপুর, ফুলবাড়িয়া, তারাকান্দা, গৌরীপুরসহ বিভিন্ন উপজেলায় চাষ হচ্ছে পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, কই, শিং, মাগুরসহ হরেক প্রজাতির মাছ। ময়মনসিংহ জেলা মৎস্য অফিসের সহকারী পরিচালক হাসিনা আক্তার জানান, জেলায় বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে ২৪৪টি হ্যাচারি। রেণু উৎপাদন হয় বছরে এক লাখ ৫৮ হাজার ১৯০ টন। এখানে মাছ চাষীর সংখ্যা এক লাখ ১১ হাজার ৬৯৫ জন। মৎস্যজীবীর সংখ্যা ৩৫ হাজার ৮৫০ জন। ১০ হাজারের বেশি রয়েছে বাণিজ্যিক মৎস্য খামার। প্রতি বছর উৎপাদিত হচ্ছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার মাছ। ত্রিশাল উপজেলার কাকচর গ্রামের মাছ চাষী আপেল মাহমুদ জানান, ময়মনসিংহে কার্প জাতীয় মাছ চাষ হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। স্বাদু পানির মাছের মধ্যে শিং, কই ও মাগুরও ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। দেশী কইয়ের পাশাপাশি চাষ হচ্ছে থাই ও ভিয়েতনামের কই। ময়মনসিংহের সফল মাছ চাষীর নাম বলতেই প্রথমেই উচ্চারিত হয় নুরুল হকের নাম। তিনি বিলুপ্ত প্রজাতির দেশী মাগুর ও শিং মাছের পোনা উৎপাদনে সফলতার পাশাপাশি পাবদা, দেশী কই, খইলসা ও বোয়ালের পোনার বাণিজ্যিক উৎপাদনেও মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তার হাত ধরেই এই অঞ্চলে থাই কই ও তেলাপিয়ার মনোসেক্স পোনা উৎপাদিত হয়। মাছ চাষে বিশেষ অবদানের জন্য চারবার জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার পেয়েছেন ‘গবেষক’ খ্যাতি পাওয়া নুরুল হক। মাছ চাষে সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, মাছ চাষে ভূমি উন্নয়ন কর উঠিয়ে বিদ্যুত বিলে ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে সহজ শর্তে বেকার যুবকদের ঋণ দিতে হবে। এতে মৎস্য খাতের অভূতপূর্ব উন্নতির পাশাপাশি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি হবে, আমিষের ঘাটতিও পূরণ হবে। ময়মনসিংহে মাছ চাষে সম্ভাবনার সিংহদ্বার প্রসঙ্গে ময়মনসিংহ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা লুৎফুর রহমান বলেন, দেশে মোট মাছের চাহিদা রয়েছে ৪০ লাখ টন। এর মধ্যে ময়মনসিংহে রয়েছে এক লাখ ১৬ হাজার ৩৫৮ টন মাছের চাহিদা। এছাড়া ময়মনসিংহে উৎপাদিত তিন লাখ ২৪ হাজার ৪৬৮ টন মাছ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত হয়। ময়মনসিংহ জেলার একটি হ্যাচারি। তিনি জানান, জেলার ত্রিশাল উপজেলায় বার্গো এগ্রোফিসারিজসহ দুটি মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রে থেকে পাঙ্গাশ মাছ ফিলেট করে চীনে রফতানি হচ্ছে। এছাড়া দেশী টেংরা, আইড়, মলা, রুই, কাতল ও বোয়াল মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশ কুয়েত ও কাতারে প্রতি বছর রফতানি হচ্ছে।
×