ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

কল্পনার চেয়েও বিস্ময়কর ১২ কিশোর উদ্ধারের কাহিনী

প্রকাশিত: ০৫:০০, ১৫ জুলাই ২০১৮

কল্পনার চেয়েও বিস্ময়কর ১২ কিশোর উদ্ধারের কাহিনী

অজানা গন্তব্যে নিজেদের উদ্বেলিত করা উদীয়মান কিশোরের স্বভাবজাত। বয়সটা এমনই নতুন কিছু অনুসন্ধানে কোন ঝক্কি-ঝামেলাকে তোয়াক্কা না করে অভীষ্ট লক্ষ্যে ধাবিত হওয়া। ১২ থেকে ১৭ বছর যে কোন কিশোরদের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল। দক্ষিণ এশিয়ার থাইল্যান্ড একটি সমৃদ্ধ এবং আধুনিক বিশ্বে জায়গা করে নেয়া দেশ। একটি সুশৃঙ্খল জাতি হিসেবে দেশটিকে উন্নয়নের কোন্ সোপানে নিজের আসন মজবুত করেছে ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। সারা বিশ্ব যখন নানা সঙ্কট এবং সমস্যার আবর্তে তখন থাইল্যান্ড নিজস্ব ঐতিহ্য আর কৃষ্টিকে সমুন্নত করে স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্যে উদ্দীপ্ত। অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা কিংবা আইনবিরোধী কার্যকলাপ মোটেও দৃশ্যমান নয়। শান্তিপ্রিয় এবং শঙ্কাহীন থাইল্যান্ড হঠাৎ সারা বিশ্বকে চমকে দিয়ে এক মহাদুঃসময়ের বার্তা নিয়ে সবার নজরে চলে আসে। চঞ্চল কিশোরের উদ্দীপ্ত আবেগে ১২ খুদে খেলোয়াড় (ফুটবল) তাদের কোচসহ এক দুঃসাহসিক অভিযানে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। ২৩ জুন শনিবার এই ১২ জন ফুটবলার তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ শেষ করে দেশটির উত্তর প্রদেশের যা কিনা মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চল ‘থাম লুয়াং’ গুহায় কোন একজনের জন্মদিন উপলক্ষে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে প্রবেশ করে। গুহায় ঢোকার সময় প্রকৃতি ছিল শান্ত, কোন ঝড়-ঝাপটার আশঙ্কাই ছিল না। গ্রীষ্মপ্রধান এই দেশটিতে হঠাৎ করে বৃষ্টি কিংবা প্রকৃতি বিরূপ হতেও সময় নেয় না। ১২ কিশোরসহ কোচের গুহার ভেতর অভিগমন অভিযানের চাইতেও দুঃসহ অস্বস্তির মুখোমুখি করায়। প্রতিকূল বৈরী প্রকৃতি সমস্ত আনন্দকে তছনছ করে দিয়ে তাদের গভীর আশঙ্কার আবর্তে ফেলে দেয়। প্রায় দশ দিন প্রচন্ড জলরাশির অন্ধ কূপে তাদের অবস্থান করতে হয়। কারণ তাদের এই দুঃসাহসিক অভিযানের কথা পরিবার-পরিজন কিংবা স্বজনদেরও অজানা। বর্ষণস্নাত গুহায় দিনের পর দিন আটকে পড়া এই ১৩ জন এক সময় জীবনের আশা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। শেষ অবধি অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাদের সন্ধান মেলে ‘থাম লুয়াং’ গুহার ভেতরে পানিবন্দী অবস্থায়। এই লোমহর্ষক ঘটনাটি নিজের দেশের সীমানা অতিক্রম করে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। অভিজ্ঞ এবং দক্ষ ডুবুরিরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এই ১৩ জন অসহায় কিশোরের প্রতি। প্রচন্ড বৃষ্টিপাত এবং পাহাড়ী ঢলে বিপর্যস্ত গুহার ভেতরে জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে ১২ জন কিশোর এবং তাদের ২৫ বছরের কোচ। গুহার ভেতরে গভীর জলাবদ্ধতায় নৌবাহিনীর সহায়তার প্রয়োজন পড়ে সবার আগে। থাই নৌ কর্তৃপক্ষই শুধু নয়, বিশ্বের বিজ্ঞ ডুবুরিদেরও দরকার হয় এই অনিবার্য করুণ পরিণতি থেকে উদ্ধার পেতে। উদ্ধার অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, মিয়ানমার, লাওস, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞ, ডুবুরি, তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ মানুষের সহায়তায় এই অবর্ণনীয় সঙ্কট থেকে মুক্ত হওয়ার সব ধরনের সুযোগ তৈরি হয়। ৯ দিনের রুদ্ধশাস জীবন পার করার পর ২ জুলাই সোমবার গুহা মুখ থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার ভেতরে খুদে খেলোয়াড়দের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রথম যারা অসম সাহসিকতায় এই অসাধ্য কাজটি করেন তারা ব্রিটিশ ডুবুরি রিচার্ড স্ট্যানটন ও জন ভলান থেন। তবে তারও আগে ৮ জুলাই রবিবার ৪ কিশোরকে উদ্ধার করা গেলেও বাকিরা পানির নিচে তালিয়ে যায়। তবে ইতোমধ্যে অনেক পানি সেচের মাধ্যমে বের করা হয় গুহার অভ্যন্তর থেকে। ডুবুরিদের অক্লান্ত পরিশ্রমই শুধু নয়, জীবন বিপন্ন করার মতো সমূহ বিপর্যয়ের মুখোমুখিও হতে হয় তাদের। কারণ এসব কিশোরকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণকে রক্ষা করতে পারেননি থাই নৌবাহিনীর প্রাক্তন ডুবুরি সামান গুনান। গত শুক্রবার পানিবন্দী থাকা কিশোরদের হাতে অক্সিজেনের বোতল তুলে দিয়ে গুহা থেকে ফেরার পথে নিজেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান। মানবিক মূল্যবোধের এমন অবারিত অবদান এবং মানবতার অবিস্মরণীয় জয়গান শুধু থাইবাসীদেরই মুগ্ধ ও একই সঙ্গে বিষণ্ণ করেনি তাবত বিশ্ববাসীকেও বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়েছে। তবে উদ্ধার অভিযানের নায়কদের মনে হয়েছিল আরও কিছু সময় অপেক্ষা করে বর্ষণ এবং পানির স্রোতধারা কমানো গেলে উদ্ধার কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। তবে উপস্থিত বিপর্যয় এমন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল, যার কারণে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে উদ্ধার অভিযানকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ত্বরান্বিত করতে হয়। থাই প্রকৃতি জুলাই থেকে নবেম্বর পর্যন্ত রুষ্ট থাকে। তবে সময়টা প্রায় ৫ মাস দীর্ঘায়িত হওয়ায় অতখানি ঝুঁকি নিলে খেলোয়াড়াদের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়াটাই স্বাভাবিক। বৃষ্টির কোন কমতি ছিল না, সঙ্গে অন্য ঝড় ঝঞ্ঝারও আতঙ্ক বেড়ে যাচ্ছিল। এমন সঙ্কটাপন্ন মুহূর্তে ডুবুরিরা যেভাবে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে উপস্থিত দুর্যোগকে সামলান তাতে তারা শুধু প্রশংসারই দাবিদার নন এক অনিবার্য দুঃসহ পরিস্থিতিকে অদম্য বিবেচনায় ঠেকানোর মনোবল নিয়ে সাক্ষাত প্রাণসংশয়কে প্রতিরোধ করারও বলিষ্ঠ নায়ক। এমন সমূহ বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে আটকে পড়া কিশোরদের শারীরিক সুস্থতার বিষয়টি সবার আগে সামনে চলে আসে। ফলে প্রয়োজন হয় চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি। সেই দায়িত্ব নেন অস্ট্রেলিয়ার একজন দক্ষ চিকিৎসক। তারই পরামর্শে উদ্ধারকারীরা নিশ্চিত হন আটকে পড়াদের গুহা থেকে বের করার মতো শারীরিক অবস্থা মোটামুটি শঙ্কামুক্ত। ফলে অভিযান পুরোদমে চলতে থাকে। ৮ জুলাই প্রাথমিক চেষ্টা চালানোর পর মাত্র ৪ জন কিশোরকে গুহা থেকে বের করে আনা হয়। অবিশ্রান্ত বৃষ্টির মধ্যে এই কাজটি সম্পন্ন করা গেলেও বাকিদের উদ্ধার করার কথা সে সময় ভাবা যায়নি। তাৎক্ষণিকভাবে এই ৪ জনকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয়। পরের দিন নতুন করে অভিযান শুরুর মাধ্যমে আরও ৪ জনকে গুহার পরিপূর্ণ জলরাশি থেকে বের করা সম্ভব হয়। তাদেরও চিকিৎসালয়ে পাঠানো হয়। থাম লুয়াংয়ের তমসাচ্ছন্ন আঁধারে আরও কিছু সময় পার করেন গুহায় আটকে পড়া বাকি ৫ জন। থাইল্যান্ডসহ সারা দুনিয়া রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে উদ্ধার অভিযানের সফল নায়কদের সর্বশেষ বিজয় দেখতে। সেই যুগান্তকারী সময়টিও এসে গেল। ১০ তারিখ মঙ্গলবার সেই মাহেন্দ্রক্ষণে বের হয়ে আসল গুহার অন্য ৫ জন। অবিশ্বাস্য এক সত্যের মুখোমুখি উদ্ধার কর্মীরা, বিপদগ্রস্তরা, তার সঙ্গে তাবত বিশ্বও। প্রযুক্তিবিদ্যার সাফল্য নাকি মানবতার জয় কিংবা ঐশ্বরিক কোন ঘটনা এমনতর আনন্দের ভাগিদার করতে পারল দুনিয়াজোড়া মানুষকে। মানুষ মানুষের জন্য এই মর্মবাণী আবারও ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো মানুষের দ্বারে। হিংসার উন্মত্ত পৃথ¦ী মানবতার বিজয় কেতনও যে ওড়াতে পারে থাইল্যান্ডের কয়েকদিনের রুদ্ধশ্বাসের এই ঘটনাপ্রবাহ সেটাই নতুন করে মনে করিয়ে দিল। থাইল্যান্ড কর্তৃপক্ষের একা এত বড় সঙ্কট মোকাবেলা করা শুধু অসম্ভবই ছিল না, তাৎক্ষণিক সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতেও বিভ্রান্তিতে পড়া অমূলক নয়। কিন্তু বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর বিজ্ঞ এবং পারদর্শী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেভাবে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তা মানুষের প্রতি মানবিক দায়বোধের অনন্য দৃষ্টান্ত। উদ্ধারকারী সহযোগীরা শেষ পর্যন্ত সঙ্কটাপন্ন খেলোয়াড়দের সঙ্গে ছিলেন। এই চারজন ত্রাণকর্মী সবার শেষে গুহা থেকে নিজেদের বের করে আনেন। আর এর সঙ্গে সঙ্গেই সমাপ্তি ঘটে এক নাটকীয়, অবিস্মরণীয়, তার চেয়েও বেশি বাস্তবোচিত রুদ্ধশ্বাস কাহিনীর। সত্যিই গল্প এবং সিনেমা বানানোর উপযোগী ঘটনাবহুল পর্ব। ছোটকালে পড়েছি অনেক সময় সত্য কল্পনাকেও হার মানায়। সেই সত্যের বাস্তব ঘটনা, চমকে দেয়ার মতো অভিনব কাহিনী সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল। বিপন্ন দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় জীবন ফিরে পাওয়া এসব কিশোর নতুন করে বাঁচার মর্মোপলব্ধি পারছে। এ এমন এক বিরল অভিজ্ঞতা যা শুধু কোন গুহা থেকে নয়, বরং ভয়ঙ্কর মৃত্যুকূপ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়ার মতো চমৎকার, দুঃসহ এবং অভিনব অনুভব। পুরো থাইল্যান্ড আনন্দের সাগরে ভাসছে। সারা পৃথিবী সেই খুশির অংশীদার হয়েছে। পরিবার এবং স্বজনরা সন্তান ফিরে পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা-আবেগাপ্লুত। অজানাকে জানার আগ্রহ নতুন প্রজন্মের উদ্দীপ্ত-উদ্দীপনা। কিন্তু সেখানে বিপদশঙ্কুল পরিবেশেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। নতুন কিছু দেখতে গিয়ে অবশ্যম্ভাবী বিপদকে যেন কোনভাবেই ডেকে আনা না হয়। বেঁচে ফিরে আসাটা অলৌকিক না হলেও না ফেরা একেবারে অসম্ভবও ছিল না। নতুন কিছু জয়ের আকাক্সক্ষা যেমন প্রবৃত্তিগত, একইভাবে বিপদের আশঙ্কাকে সমানভাবে বিবেচনায় আনাও যুক্তিসঙ্গত। তারুণ্যের উদ্দমতায় অনেক কিছুকে জয় করার আগ্রহ অস্বাভাবিক না হলেও সাবধানতা এবং সতর্কতার বিষয়টিও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। দুঃসহ অভিযাত্রায় সবাইকে চমক লাগিয়ে দেয়ার আগে নিজের নিরাপত্তা নিয়েও ভাবাটা সবার আগে জরুরী।
×