ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সরকারী চাকরিতে কোটা...

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ১৫ জুলাই ২০১৮

সরকারী চাকরিতে কোটা...

গ্রীক বীর আলেকজান্ডার (খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৬-৩২৩) ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে গাজা, মিসর, সিরিয়া এবং পারস্য সাগর ধরে ভারতবর্ষের সিন্ধু ও পাঞ্জাব পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। ভারতের প্রকৃতি ও মানুষ দেখে তিনি তার সহযোদ্ধা স্যালুকাশের কাছে মন্তব্য করেছিলেন- কি বিচিত্র এই দেশ এবং এর মানুষ। যেহেতু বর্তমান বাংলাদেশ তখনকার ভারতেরই একটা অংশ ছিল। তাই তা বাংলাদেশ এবং বাঙালীর ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। ক্ষেত্রবিশেষ আরও বেশি প্রযোজ্য। মাঝে মাঝে আমি ভাবি আমরা কি খুব আত্মবিস্মৃত এবং অকৃতজ্ঞ জাতি? স্বাধীনতার মাত্র ৪৭ বছর পরে মুক্তিযুদ্ধকে জানার জন্য ইতিহাস খুঁজে বেড়াতে হয়। যদিও অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা এখনও জীবিত; কারণ শতকরা ৯০ জন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধার বয়স ছিল তখন ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র। আমি নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি, এত মুক্তিযোদ্ধা জীবিত থাকা সত্ত্বেও ইতিহাসের মাঝে কেন মুক্তিযুদ্ধকে খুঁজতে হবে? আমি আরও আশ্চর্য হই, বিস্মিত হই যখন দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্র-ছাত্রী (যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার) তার গ্রামের একজন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধার নাম বলতে পারে না অথবা চেনে না। তাই তো তারা প্ল্যাকার্ডে লিখতে পারে ‘নাতি-পুতির’ কোটা চলবে না কিংবা গায়ে লিখতে পারে ‘আমি রাজাকার’। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যারা বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক মনে করে, মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার চেতনা ধারণ করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করে তারা এ কাজটি কোনভাবেই করতে পারে না। তারা কোনভাবেই মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং অনগ্রসর জাতি-গোষ্ঠীর সরকারী চাকরিতে কোটা বাতিল দাবি করতে পারে না। বাংলাদেশ তো কারও দয়ার দান নয়, কোন বিচারকের রায়ে অথবা গোলটেবিল বৈঠকের মাধ্যমে কিংবা কোন মেজরের বাঁশিতে আমাদের স্বাধীনতা আসেনি। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ফসল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অর্জন। সামান্য কিছু আল-বদর, রাজাকার, জামায়াত এবং অন্যান্য পাকিস্তানপন্থী কিছু দল ও গোষ্ঠী ব্যতীত এটা মুক্তিযোদ্ধা ও সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মিলিত ফসল। এই বাংলাদেশ ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের জন্য সম্ভ্রম হারিয়েছেন ২ লাখ বাঙালী রমণী। এই বাংলাদেশ সেই বীর রমণীদের বাংলাদেশ। হাজার বছরের পরাধীন বাঙালী জাতির স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়ক হচ্ছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, হাজার বছরের বাঙালী মায়ের সন্তান, ইতিহাসের মহানায়ক বাঙালীর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অনেকে প্রশ্ন করেন, দেড় থেকে দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধার জন্য সরকারী চাকরিতে ৩০% কোটা কেন থাকবে? তাদের সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করতে চাই, ১৯৭১ সালে যুদ্ধে যাওয়ার মতো কমপক্ষে দেড় কোটির মতো বাঙালী যুবক ছিল তাহলে কেন মাত্র দেড় বা দুই লাখ যুবক রণাঙ্গনের যোদ্ধা ছিল এবং জীবনবাজি রেখে অস্ত্র নিয়ে কিংবা সামান্য অস্ত্র নিয়ে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর বিপুল অস্ত্রের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করলেন এবং অনেকে শাহাদত বরণ করলেন। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষের ছাত্র। সেই সময় আমাদের বিভাগে তিন শ’র মতো ছাত্র ছিল, কিন্তু আমরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম উর্ধে ১৫ জন, বাকিরা কেন গেল না? এটা কোন কম্পিউটারের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা ছিল না, ছিল না কোন সাপ ও লুডুর খেলা। এটা ছিল জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করা। তাই যারা প্রকৃত বীর, প্রকৃত অর্থেই দেশকে ভালবাসে তারাই মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন। এবার আমার প্রশ্ন, কতভাগ যুবক মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন অর্থাৎ রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। পরিসংখ্যান বলে ২% এর বেশি হবে না। সেদিন আমরা তিন ভাই-ই মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। তাই এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহেই আমাদের বাড়ি পাকিস্তান বাহিনী স্থানীয় দালালদের সহায়তায় পুড়ে ছারখার করে দিয়েছিল। আমার বাবা, মা ও ছোট বোনরা নয়মাস গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালিয়ে বেড়িয়েছে। দেশ স্বাধীন না হলে হয়ত আমরা বাড়িতে ফিরতে পারতাম না কিংবা বেঁচে থাকতে পারতাম না। তাই, এটা রাষ্ট্রের বা সরকারের দায়িত্ব, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে তাদেরকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া এবং সর্বোত্তম সুযোগ-সুবিধা দেয়া। যেহেতু শতকরা ৯০ জন মুক্তিযোদ্ধাই ছিল গরিব ও কৃষকের সন্তান (টাকা পয়সা ও সম্পদের মালিকের ছেলেরা খুব কম সংখ্যাই মুক্তিযুদ্ধ করেছে)। উল্লেখ্য, কাপাসিয়ার অন্তত চার মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীন বাংলাদেশে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ইতোমধ্যে তারা মৃত্যুবরণ করেছেন। যেহেতু গরিব বিধায় মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা ঠিকমতো লেখাপড়া করতে পারেনি এবং উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনি, তাই সরকারী চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা অবশ্যই থাকতে হবে এবং তা ৩০%। তবে এটাও আমি মনে করি, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা যেন এই সুযোগ না পায়। (উল্লেখ্য, সব জায়গায় ভুয়া থাকতে পারলে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাও থাকতে পারে বিশেষ করে বিগত বিএনপি সরকারের আমলে দলীয় বিবেচনায় অনেককে মুক্তিযোদ্ধা বানানো হয়েছে)। অতএব প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা এবং তাদের অনাগত বংশধর যেন এই সুবিধা পায় তার শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ইংল্যান্ড ও জাপান এত উন্নত ও সভ্য দেশ হওয়া সত্ত্বেও সেই দেশের রাজপরিবার অনেক সুযোগ-সুবিধা যদি পেতে পারে, তাহলে যাদের ত্যাগের বিনিময়ে এবং রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেলাম, আমাদের ভাইয়েরা, বোনেরা এবং সন্তানরা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হলেন, সচিব হলেন, জেনারেল হলেন, শিল্পপতি হলেন এবং ব্যাংকের মালিক হলেন, তাহলে সেই গরিব এবং কৃষকের সন্তান মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এবং ভবিষ্যত বংশধরদের এই সামান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে সমস্যা কোথায়? আমি এটাও মনে করি, বিসিএস পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্যদের জন্য একটা নিম্নতম মান থাকা উচিত। যদি মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরিরা নির্ধারিত মানসম্পন্ন না হয়, তাহলে মেধা কোটা নিয়ে সাময়িকভাবে তা পূরণ করা যেতে পারে। পরবর্তীতে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে এবং উত্তরসূরিদের একেবারে নিম্নতম পর্যায় থেকে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে তারা সেরামানের ছাত্র, মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হতে পারে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে হলে শুধু মেধাবী হলে চলবে না দেশপ্রেমিকও হতে হবে। দেশপ্রেম না থাকলে কোন দেশ উন্নতির শিখরে উঠতে পারে না। আমার আরও বিশ্বাস, সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরুদ্ধে নয়, তাদের ভুল বোঝানো হয়েছে কিংবা তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানে না, কিংবা স্বাধীনতাবিরোধী চক্র তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহার করছে। কোনমতেই সাধারণ ছাত্রছাত্রী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ হতে পারে না। এটাও ঠিক, ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর পরবর্তী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস এবং মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবগাথা জনতে দেয়া হয়নি। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের ভালবাসেন এবং তাদেরকে যথোপযুক্ত সম্মান দিতে জানেন। মুক্তিযোদ্ধাদের স্থান তার অন্তরের গভীরে। প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধা তথা গরিব এবং অসহায় মানুষের জন্য তার অন্তরাত্মা ভীষণভাবে কাঁদে এবং তাদের পাশে দাঁড়ানো তিনি পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করেন। শেষে বলি, আমরা ভৌগোলিক ও মানচিত্রের স্বাধীনতা পেয়েছি, এখনও বঙ্গবন্ধুর ইপ্সিত মুক্তি আসেনি। তাই, এই প্রজন্মকে বলি প্রত্যেককে এক একজন বঙ্গবন্ধুর সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত উত্তরসূরি এবং শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে হবে। ৩০ লাখ শহীদের স্বপ্নের বাংলাদেশ আমাদের কায়েম করতেই হবে এবং তা আসবে আমাদের প্রিয় নেত্রী বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধকালীন অধিনায়ক কাপাসিয়া থানা, গাজীপুর।
×