ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাতিসংঘের ‘ডিজিটাল সহযোগিতা প্যানেল’ ও আমাদের করণীয়

প্রকাশিত: ০৪:৫৭, ১৫ জুলাই ২০১৮

জাতিসংঘের ‘ডিজিটাল সহযোগিতা প্যানেল’ ও আমাদের করণীয়

বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল প্রযুক্তির যে ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছে তার গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতিসংঘ মহাসচিব ১২ জুলাই একটি উচ্চ পর্যায়ের ‘ডিজিটাল সহযোগিতা’ প্যানেল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। মহাসচিব নিজেই ভিডিও বার্তা দিয়ে সংবাদ মাধ্যমে এর গঠনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন। এই প্যানেলের কো-চেয়ার করা হয়েছে দু’জনকে, এরা হলেন বিল এ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের দ্বিতীয় প্রধান মেলিন্ডা গেটস ও চীনের ‘আলীবাবা’ ই-কমার্স ব্যবসার কর্ণধার জ্যাক মা। এই প্যানেলের সদস্য সংখ্যা ১৮ জন ও আরও দু’জন অফিস নির্বাহী হিসেবে কাজ করবেন। মহাসচিব আশা করছেন প্যানেল নয় মাস কাজ করে একটি রিপোর্ট তার কাছে দেবেন যার মাধ্যমে পরবর্তীতে ডিজিটাল প্রযুক্তি নিয়ে বিভিন্ন দেশ কী কী কাজ করবে তার একটা রূপরেখা তৈরি হবে। এই প্যানেল ঘোষণার পর পরই এই প্যানেলের সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে ও এর উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচনা ও বাদ প্রতিবাদ হতে থাকে। অনেকেই মনে করছেন এই প্যানেল যথাযথ প্রক্রিয়ায় সকলের মতামত নিয়ে তৈরি হয়নি ও সদস্যদের অনেকেই প্রযুক্তির বাজার সম্প্রসারণে যতটা অভিজ্ঞ, অনগ্রসর দেশগুলোয় এর সুপ্রয়োগের কার্যকরী অভিজ্ঞতা তাঁদের অনেকেরই নেই ফলে এই প্যানেল কার্যত দারিদ্র্য বিমোচন ও এসডিজি-র মূল উদ্দেশ্য অর্জনে বিশেষ সহায়ক হবে না। ডিজিটাল বাংলাদেশের নীতি নির্ধারণী মহল ও কর্মীদের এই বিষয়টি ভালভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন। সামনের দিনে বাংলাদেশের জন্যে তথ্যপ্রযুক্তি নীতিখাতের যে বড় চ্যালেঞ্জ তা হলো এর আনুপূর্বিক বাস্তবায়ন। সেখানে বিশ্বসভা যদি সহযোগিতার আড়ালে ভুল সিদ্ধান্তে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তখন প্রান্তিক পর্যায়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির অন্যতম বাস্তবায়নকারী দেশ হিসেবে আর অন্যদের সঙ্গে নিজেও ব্যাপক প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়বে যেখান থেকে বের হয়ে আসা এমনকি কঠিনও হয়ে উঠতে পারে। এই প্যানেল গঠনের সমালোচনার কারণ বুঝতে আমাদের একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে বা স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর পুঁজিবাদী দেশগুলো যখন বিশ্বব্যাপী তথ্য-প্রযুক্তির দরোজা খুলে দিতে প্রায় এক প্রকার বাধ্যই হলো তখন গোড়া থেকে এরা খুব সজাগ ছিল যাতে এর সুবিধা হিসাব কষে দেয়া হয় ও নিয়ন্ত্রণ তাদের কাছেই থেকে যায়। বিশেষ করে গরিব বা অনগ্রসর দেশগুলোর সংখ্যা যেহেতু বেশি ফলে এরা যেন কোনক্রমেই এর সব সুবিধা পেয়ে নিজেদের উদ্ভাবনী বাজার তৈরি করে বড় দেশগুলোকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে না পারে। কিন্তু বাদ সাধলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। ১৯৯৭ সালে কানাডায় তথ্য-প্রযুক্তির জ্ঞান সুবিধা বিনিময়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয় যা গ্লোবাল নলেজ কনফারেন্স বা জিকে নামে পরিচিত। ওই সম্মেলনে বিশ্বব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বেশ কয়েকটি দেশ কিছু নামী-দামী তথ্য-প্রযুক্তি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পক্ষে অবস্থান নেয়। মূলত সিসকো ও মাইক্রোসফট এই পক্ষপাতের প্রধান কারণ ছিল। মার্কিন দেশের গ-ি পেরিয়ে মাইক্রোসফট তখন দেশে দেশে তার সফটওয়্যার ব্যবসা সম্প্রসারণে ব্যাস্ত ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোতে নিজেদের বাজার নিয়ন্ত্রণে চাপ দেবার পক্ষে ছিল। অ্যাপল আর পিসির বাজারে সহমত তৈরি করেও নতুন চাপের কাজ শুরু হয়। অপারেটিং সিস্টেমের চড়া দাম, নেটওয়ার্কের বাজার বিস্তৃতি ও ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ তৈরি করে এক দুঃসাধ্য বাজার পরিস্থিতি। এসব নিয়ে অস্বস্তি নিরসণে মাহাথির কুয়ালালামপুরে ২০০০ সালে আয়োজন করেন জিকে-২ নামে আর একটি সম্মেলনের যার সুপারিশ নিয়ে ‘গ্লোবাল নলেজ পার্টনারশিপ (জিকেপি)’ নামের একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের জন্ম হয়। সচিবালয় দেবার কৌশলে এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় বিশ্বব্যাংক। ২০০১ সালের মার্চ মাসে জিকেপির প্রথম বার্ষিক সভায় একে বিশ্বব্যাংক থেকে বের করে এনে কুয়ালালামপুরে সচিবালয় স্থাপন করা হয়। মূলত এই সভায় প্রযুক্তি ব্যবহারের নীতি প্রশ্নে উন্নত বিশ্বও দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়ে। জিকেপির সভাপতি হিসেবে এর নেতৃত্ব যায় অনগ্রসর দেশগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল সুইজারল্যান্ডের কাছে। ফলে শুরু থেকেই হোচট খায় বিশ্বব্যাংকসহ মার্কিন সরকার ও এর নামী-দামী তথ্য-প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো। আড়ালে বসে এরাই গত ষোলো-সতেরো বছর নিজেদের রাগ পুষে বেড়াচ্ছে। কারণ ইতোমধ্যে এদের অনেক ছাড় দিতে হয়েছে। জাতিসংঘ ২০০৩ সালে জেনেভায় ও ২০০৫ সালে তিউনিসে দুই পর্বের বিশ্ব তথ্য সমাজ গঠনে শীর্ষ সম্মেলন করে কফি আনানের নেতৃত্বে উন্নয়নের জন্যে তথ্য প্রযুক্তির ঘোষণাপত্র ও অঙ্গীকারনামা করেছে যা সবগুলো দেশকে মেনে নিতে হয়েছে। জাতিসংঘের পাশে ছিল জিকেপি। এর ফলে উন্নত অনেক দেশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ডিজিটাল সহযোগিতায় আর্থায়নের সমতা নীতি তৈরি হয়েছে, ইন্টারনেট শাসনের নিয়ম যুক্তরাষ্ট্রের একটি একচেটিয়া কোম্পানির কাছ থেকে অনেকাংশে ছাড়িয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছে যার ফলে দুনিয়াব্যাপী ডিজিটাল সেবার সম্প্রসারণ ঘটেছে, বাংলাদেশ যার অন্যতম উদাহরণ। এখন প্রায় সব দেশে তথ্য-প্রযুক্তি সেবাখাতে নিজেদের সক্ষমতা বেড়েছে, নিজেদের নীতিমালা হয়েছে ও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো দেশ মহাকাশে প্রযুক্তি সেবা ছড়িয়েছে। মোবাইল ফোন ও তারবিহীন যোগাযোগের এক বিশাল স্থানীয় বাজার তৈরি হয়ে গেছে, আর দক্ষ হাতে সেবা খাতের সম্প্রসারণ যেভাবে ঘটছে তাতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরামর্শকদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ফলে জাতিসংঘের কাছে কৌশলী দেন দরবারের মাধ্যমে চুপিসারে এই ‘ডিজিটাল সহযোগিতা প্যানেল’ গঠন করা তাদের জন্যে জরুরী হয়ে পড়েছিল। সকলেই জানেন মেলিন্ডা গেটস বিল গেটসের স্ত্রী ও গেটস ফাউন্ডেশনের উপ-প্রধান। পৃথিবীর নানা দেশে এরা আর্থিক অনুদান দেয় প্রধানত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিখাতে। কিন্তু যা অনেকেই জানেন না যে, এই ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো অভিযোগ হলো এরা কখনই দারিদ্র্য বিমোচনে কোন উদ্ভাবনী গবেষণায় অনুদান দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চশিক্ষা খাতের উন্নয়নে এরা প্রচুর অর্থ ব্যয় করে কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিক্ষা উন্নয়নের জন্যে এদের কোন সহানুভূতি নেই। দারিদ্র্য মোচনের কৌশল ও দারিদ্র্য নির্ণয়ের কোন ভিত্তিমূলের গবেষণায় এরা অর্থায়ন করে না। অনেকে মনে করেন এই ফাউন্ডেশন প্রকৃতপক্ষে মাইক্রোসফটের ব্যবসা স্বার্থই বিবেচনা করে বেশি। প্যানেলের অপর কো-চেয়ার জ্যাক মা সম্পর্কেও এই ধারণা প্রচলিত যে, কেবল আর্থিক বিবেচনাই তার প্রতিষ্ঠানের প্রধান বিবেচ্য ও বিভিন্ন দেশের স্থানীয় উদ্ভাবনকে বিনিয়োগের কৌশলে তিনি আলীবাবায় আত্মীকৃত করে নিচ্ছেন যা নতুন উৎসাহকে বাণিজ্যিক রূপ দিতে তরুণদের বিভ্রান্ত করছে। এছাড়া আর যারা এই প্যানেলে রয়েছেন তাদের কেউ কেউ নানা দেশের মন্ত্রী বা বাণিজ্যিক উপদেষ্টা। এই প্যানেলে কোন অনগ্রসর দেশের প্রতিনিধিও রাখা হয়নি। ডিজিটাল বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারতো এই প্যানেল যেখানে বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত হওয়া সঙ্গত ছিল। এই প্যানেল সেপ্টেম্বর মাস থেকে কাজ শুরু করবে ও নয় মাসের সময়সীমায় জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে সুপারিশ প্রতিবেদন দাখিল করবে। আশঙ্কা হলো, সেসব সুপারিশ যেন এতদিনের উন্নয়ন চিন্তার আসনে বাণিজ্যিক চিন্তাকে এনে মূল কাঠামোয় বসিয়ে দেয়া না হয়। বাংলাদেশকে এই বিষয়ে সতর্ক অবস্থান নিতে হবে ও বোঝাপড়ায় আমাদের কূটনীতিকদের বিশেষ মনোযোগ রাখতে সরকারের উ"চমহল থেকে নির্দেশনা রাখতে হবে। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্য-প্রযুক্তি প্রকল্প e-Mail: [email protected]
×