ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ভবিষ্যত না জেনে বিদ্যুত বিভাগও ঝুঁকছে

এলএনজি আমদানিতে সমন্বয়হীনতা

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৪ জুলাই ২০১৮

এলএনজি আমদানিতে  সমন্বয়হীনতা

রশিদ মামুন ॥ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে সমন্বয়হীন প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। নতুন এই জ্বালানি আমদানিতে দেশের চাহিদা এবং ভবিষ্যত জোগান বিবেচনা না করেই বিক্ষিপ্তভাবে প্রকল্প গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। জ্বালানি বিভাগের পাশাপাশি এখন বিদ্যুত বিভাগও এলএনজি আমদানির টার্মিনাল নির্মাণের দিকে ঝুঁকছে। দেশীয় গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে এসব এলএনজি টার্মিনালের ভবিষ্যত কি হবে তা নিয়ে আগেভাগে চিন্তা করা উচিত বলে পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ভূতত্ত্ববিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, আগে আমাদের দেশ কি পরিমাণ গ্যাস আছে তা নিশ্চিত হতে হবে। দেশের গ্যাস ফুরিয়ে আসলে তখন আমদানির প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু আমরা দেখলামই না আমাদের মাটির নিচে গ্যাস আছে কি নেই তার আগে দীর্ঘমেয়াদী এলএনজি আমদানির চুক্তি করে ফেললাম। স্বল্প মেয়াদে সঙ্কট মেটাতে এলএনজি আমদানি যৌক্তিক হলেও দীর্ঘ মেয়াদে এত বড় বড় প্রকল্প গ্রহণের যৌক্তিকতা নেই। এটা সঠিক নীতিও নয় বলে মনে করেন তিনি। অধ্যাপক ইমাম বলেন, এলএনজির যে দাম তাতে ভবিষ্যতে আমাদের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক চাপ তৈরি করবে। আর একবার দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি হয়ে গেলে এলএনজি আমদানি করা হোক বা না হোক তাদেরকে অর্থ প্রদান করতে হবে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এলএনজির প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। শুরুতে এক্সিলারেট এনার্জি প্রতিদিন ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজিকে গ্যাসে রূপান্তর করতে পারে এমন একটি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য চুক্তি করে। এখন দেশের চাহিদা বিবেচনা করে আরও একটি টার্মিনাল নির্মাণের অনুমোদন দেয় সরকার। সামিট গ্রুপের এই টার্মিনালটিও প্রতিদিন ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজিকে গ্যাসে রূপান্তর করতে পারবে। এর বাইরে ভারতের রিলায়েন্সের একটি সমান ক্ষমতার টার্মিনাল নির্মাণের বিষয়ে সরকার অনুমোদন দিয়েছে। এই টার্মিনালটি প্রতিদিন তার বিদ্যুত কেন্দ্রে ব্যবহারের বাইরে বাকি গ্যাস পেট্রোবাংলার কাছে বিক্রি করবে। সেখান থেকে আরও ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার আশা করা হচ্ছে। অর্থাৎ আগামী এক বছরের মধ্যে এক হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানির অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। সবগুলো চুক্তি হচ্ছে ১৫ বছর মেয়াদী। এই ১৫ বছর সরকারকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ এলএনজিকে গ্যাসে পরিণত করার চার্জ প্রদান করতে হবে। ভাড়ায় চালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের মতোই এলএনজি টার্মিনালগুলোকে অর্থ পরিশোধ করতে হবে। টার্মিনাল ব্যবহার হোক বা না হোক উদ্যোক্তাদের অর্থ প্রদানে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি (আরপিজিসিএল)-এর বাইরেও মহেশখালি/ কুতুবদিয়া/ পায়রাতে প্রতিদিন ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানির জন্য স্থায়ী টার্মিনাল নির্মাণের জন্য সমীক্ষা করছে। আরপিজিসিএল কক্সবাজারের মহেশখালির সোনাদিয়া দ্বীপে আরও একটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য সমীক্ষা করছে। পেট্রোবাংলা এখন পর্যন্ত যে সমঝোতা স্মারক সই করেছে সেগুলোতে দেখা যায় আরও এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানির জন্য স্থায়ী টার্মিনাল নির্মাণের জন্য সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছে। ভারতের পেট্রোনেটের সঙ্গে এলএনজি টার্মিনালটি নির্মাণের ওই এমওইউটি সই হয় গত বছর। এর বাইরে এমওইউ সই এর খুব কাছাকাছি রয়েছে সিঙ্গাপুরের কোম্পানি সেম্বকর্প। কোম্পানিটির সঙ্গেও এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি) ক্ষমতার এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের বিষয়ে আলোচনা চলছে। স্থায়ী এই টার্মিনালটি মহেশখালি, কুতুবদিয়া বা পায়রায় নির্মাণ করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর বাইরে চায়না হুয়ানকিউ কন্ট্রাকটিং এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন (সিএইচকিউ) এবং সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের কাছ থেকে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে আর্থিক এবং কারিগরি প্রস্তাব নিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। মালয়েশিয়ার কোম্পানি পেট্রানাস এবং চীনের হংকং সাংহাই মানজালা পাওয়ার লিমিটেডের প্রস্তাব নিয়েও কাজ করছে পেট্রোবাংলা। সম্প্রতি জ্বালানি বিভাগের পাশাপাশি বিদ্যুত বিভাগও এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। আমেরিকার কোম্পানি জেনারেল ইলেক্ট্রিক (জিই)-এর সঙ্গে স্বাক্ষরিত পিডিবি এবং সামিটের উভয় টার্মিনালের সঙ্গেই এলএনজি আমদানি অবকাঠামো রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলএনজি আমদানির সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এর দাম। এলএনজি আমদানির শুরুতেই গ্যাসের দাম ১৪৩ ভাগ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গঠিত কারিগরি কমিটি। প্রতিদিনের দেশীয় উৎপাদন দুই হাজার ৭০০ মিলিয়নের সঙ্গে প্রতিদিন আমদানি করা ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি মিশ্রন ধরে এই গ্যাসের দাম নির্ধারণের কথা জানানো হয়েছে। তবে সব চেয়ে আশঙ্কার কথা হচ্ছে এলএনজি আমদানির পরিমাণ যত বৃদ্ধি পাবে গ্যাসের দাম তত বৃদ্ধি করতে হবে। ভবিষ্যতে এই গ্যাসের দাম কত হবে তার কোন হিসাব পেট্রোবাংলার কাছেও নেই। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম এ বিষয়ে বলেন, এখন আমাদের উৎপাদিত বিদ্যুতের চেয়ে আমদানি করা বিদ্যুতের দাম কম। ভারত ব্যাপকহারে সৌর বিদ্যুত উৎপাদন করছে পরিবেশ রক্ষার জন্য নয় উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশ যখন বিদ্যুতের দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে সেখানে আমরা উচ্চমূল্যের জ্বালানির দিকে ঝুঁকছি। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে আইওসি চেষ্টা করেছিল দেশীয় গ্যাস রফতানি করতে। সরকার রাজি না হওয়াতে তখন আমাদের গ্যাস অনুসন্ধান ষড়যন্ত্র করে থামিয়ে দেয়া হয়। এখনও এলএনজি আমদানির মাধ্যমে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বন্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এভাবে ভবিষ্যত চাহিদা, খরচ বিবেচনা না করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে আত্মঘাতী হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। প্রসঙ্গত সমুদ্রের প্রায় পুরো এলাকার পাশাপাশি স্থলভাগের বড় অংশে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ করতে পারেনি পেট্রোবাংলা। সাগরে ব্লকগুলোও ইজারা দিতে পারেনি এই প্রতিষ্ঠান। অথচ প্রতিবেশী মিয়ানমার এবং ভারত সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে। সেখানে পেট্রোবাংলার ব্যর্থতার কারণে সঙ্কট তৈরি হওয়ার দায় নিতে হচ্ছে পুরো জাতিকে।
×