ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

উন্নত চিকিৎসার জন্য মানুষ বিদেশ যাচ্ছে কেন?

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৪ জুলাই ২০১৮

 উন্নত চিকিৎসার জন্য মানুষ বিদেশ  যাচ্ছে কেন?

হাসান নাসির ॥ বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে অপার সম্ভাবনার হাতছানি। উৎপাদিত ওষুধ দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি হচ্ছে বিদেশে। প্রতিবছরই রফতানির প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের ওপরে। সমাপ্ত অর্থবছরে বাংলাদেশ ওষুধ রফতানি করে আয় করেছে ১০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। অথচ, ওষুধ রফতানিকারক দেশের হাজার হাজার মানুষ উন্নত চিকিৎসার জন্য ছুটছে বিদেশে। যে দেশটি মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদন করে, সে দেশের চিকিৎসার ওপর মানুষের এমন অনাস্থা কেন সে প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক মানুষ বিদেশে যাচ্ছে চিকিৎসার জন্য। শুধু চিকিৎসা নয়, মামুলি স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্যও যেন দেশের রোগ নির্ণয় কেন্দ্রের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। অনেকেরই অভিযোগ, দেশে তারা যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছেন না বলেই বিদেশে ছুটতে বাধ্য হচ্ছেন। বিষয়টি যেহেতু জীবন রক্ষার, সেহেতু ন্যূনতম ঝুঁকিও নিতে রাজি নন রোগাক্রান্তরা। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ১৩৩ দেশে ওষুধ রফতানি করছে। এ চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। সম্প্রসারিত হচ্ছে বাংলাদেশী ওষুধের আন্তর্জাতিক বাজার। ওষুধ শিল্পে যে সম্ভাবনার হাতছানি তাতে অদূর ভবিষ্যতে এ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত হতে চলেছে এই খাত। শিল্প মালিকদের সংগঠন আগামী ১০ বছরের মধ্যে ওষুধ রফতানি খাতে ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করার টার্গেট নিয়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ ওষুধ রফতানি করে আয় করেছে ১০ কোটি ৩৪ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি আগের বছরের তুলনায় ১৬ দশমিক ০৩ শতাংশ বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে এখাতে আয় হয়েছিল ৮ কোটি ৯১ লাখ মার্কিন ডলার। সমাপ্ত অর্থবছরে ওষুধ রফতানি খাতে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তার চেয়ে ৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেশি হয়েছে। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির তথ্য অনুযায়ী এ দেশে ছোট বড় ২৬৯টি ওষুধ কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ১৬৪টি প্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবে ওষুধ উৎপাদন করে চলেছে। এ দেশের বিভিন্ন নামে ২৪ হাজার রকমের ওষুধ উৎপাদিত হয়। দেশের চাহিদা মেটাতে পুরোপুরি সক্ষম হওয়ায় উদ্যোক্তারা এখন বিদেশে মার্কেট তৈরির চেষ্টায় মনোযোগী হয়েছে। বাংলাদেশের ওষুধ যাচ্ছে এশিয়ার ৩৭টি, দক্ষিণ আমেরিকার ২১টি, আফ্রিকার ৩৪টি, উত্তর আমেরিকার ৪টি এবং ইউরোপের ২৬টি দেশে। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া মহাদেশেও ওষুধ রফতানি হচ্ছে। ওষুধ শিল্পের অবস্থান যদি হয় এমনই পর্যায়ে তাহলে এ দেশের মানুষ চিকিৎসার জন্য কেন ছুটছে বিদেশে, এই প্রশ্নও সঙ্গতভাবেই এসে যায়। চিকিৎসা গ্রহণের জন্য এক সময় শুধুমাত্র বিত্তবানরাই বিদেশে ছুটে যেতেন। অনেকেই সমালোচনা করে মন্তব্য করতেন, এটা কেবলমাত্র অর্থবিত্ত জাহির করা। কিন্তু হাল সময়ে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তরাও চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন। বিশেষ করে নিকট প্রতিবেশী ভারত থেকে রয়েছে ভাল চিকিৎসার হাতছানি। এখন যারা বিদেশগামী তাদের অন্তত ৯০ ভাগের গন্তব্য ভারত। বাংলাদেশ এবং ভারতের সঙ্গে চিকিৎসার মানে এতটা তফাত থাকার কথা কী না- সেই প্রশ্ন অবশ্যই রয়েছে। ভারত থেকে যারা চিকিৎসা গ্রহণ করে আসছেন তাদের অধিকাংশেরই অভিমত বাংলাদেশে মানসম্পন্ন ওষুধ রয়েছে। আছেন ভাল চিকিৎসকও। কিন্তু এখানে চিকিৎসকদের আন্তরিকতা পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে অভিযোগ খুব বেশি নয়। এ দেশের ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্ন নেই। প্রায় সকল রোগের ওষুধ মিলছে বাংলাদেশে। তাহলে কেন এমন বিদেশে ছোটাছুটি, এ প্রশ্নের জবাবে রোগী এবং স্বজনরা তুলছেন প্রধানত দুটি অভিযোগ। প্রতিবেশী ভারত বা থাইল্যান্ড হতে চিকিৎসা বা চেকআপ করিয়ে আসা রোগীদের সাধারণ দুটি অভিযোগ হলো-- এক. বাংলাদেশের চিকিৎসকরা রোগীদের যথেষ্ট সময় দেন না এবং আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলেন না। দুই. অপ্রয়োজনীয় অনেক টেস্ট করিয়ে অধিক অর্থ ব্যয় করান। গাদা গাদা যে টেস্ট করানো হয় তার অধিকাংশই প্রয়োজনীয় নয় বলে জানিয়ে দেন বিদেশের ডাক্তাররা। রোগীদের ধারণা, মামুলি রোগের জন্য অনেকগুলো টেস্টের মধ্যে যেগুলোর রিপোর্ট ‘নরমাল’ আসে তার বেশিরভাগই রোগের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এটি হতে পারে সংশ্লিষ্ট ল্যাবের আয় বাড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি নিজের কমিশন ঠিক রাখা। ভারত থেকে চিকিৎসা নিয়ে আসা এক রোগী জানান, বাংলাদেশে করা টেস্টের রিপোর্ট সংবলিত মোটা ফাইল বিদেশী ডাক্তারের কাছে দিলে তারা সরাসরি জানিয়ে দেন যে, এতগুলো টেস্টের কোনই প্রয়োজন ছিল না। সেখানকার একজন ডাক্তারের কাছে মন খুলে অনেক কথা বলা যায়। কিন্তু রোগীর কথা শোনার জন্য আমাদের চিকিৎসকদের অত সময় নেই। বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ করা রোগীরা প্রায় একবাক্যেই বলে থাকেন, আমাদের চিকিৎসকরা শুধুমাত্র আন্তরিকতা, দায়িত্বশীলতা এবং রোগীদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটালেই দেশের সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থার বড় ধরনের অগ্রগতি ঘটে যাবে। রোগীরাও আস্থা ফিরে পাবেন। রোগীদের সময় দিয়ে এবং আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে চিকিৎসার্থে বিদেশগামিতা ঠেকাতে পারলে বরং চিকিৎসক ও বেসরকারী হাসপতালগুলো বেশি লাভবান হবে। ডাক্তার ও হাসপাতাল-ক্লিনিকের মালিকদের কি এই সাধারণ উপলব্ধিটুকু হয় না?
×