ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ছোট্ট পতঙ্গ ফড়িং

বাতাসে স্থির ভেসে থাকা, কপ্টার আবিষ্কারের পথদ্রষ্টা

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৪ জুলাই ২০১৮

বাতাসে স্থির ভেসে থাকা, কপ্টার আবিষ্কারের পথদ্রষ্টা

সমুদ্র হক ॥ ছেলেবেলায় ফড়িং নিয়ে খেলেনি বা ফড়িং দেখে হেসে লুটোপুটি খায়নি মধ্য বয়সী ও প্রবীণ এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। বর্তমান প্রজন্মের শিশুদের অনেকেই ফড়িং দেখেনি। তবে গল্পে কবিতায় পড়েছে। পূর্বসূরিদের কাছে শুনেছে। ছেলে বেলায় ঝাউবনে ছোট গাছের শাখা প্রশাখায় ফড়িং ও প্রজাপতি দেখলেই দুষ্টুমি চেপে বসত কিভাবে ধরা যায়। বিংশ শতকের শুরুর দিকেও কেউ ভাবেনি ঝাউবনের ফড়িং বিজ্ঞানীদের আকাশ যান হেলিকপ্টার বানানোর দুয়ার খুলে দেবে। পরবর্তী সময়ে তাই হয়েছে। ফড়িং যেভাবে ওড়াউড়ি করে হেলিকপ্টারও সেইভাবেই আকাশে ওড়ে। আকাশে পাখির ওড়াউড়ি দেখে বিজ্ঞানীদ্বয় রাইট ব্রাদার্স উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেছিলেন। রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণে রানওয়ে দরকার। রানওয়ে ছাড়া আকাশে ওড়া যাবে এমন কৌশল নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে থাকে বিশ্বের বিজ্ঞানীরা। এমন কিছু করা যায় কি না যাতে ওড়ার জন্য রানওয়ে লাগবে না। বিজ্ঞানীদের এই ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে এগিয়ে আসে ছোট্ট এক পতঙ্গ ফড়িং। এই পতঙ্গ গবেষণা করে দেখা যায় যার দেহের বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ ডানা কোন রানওয়ে ছাড়াই যে কোন জায়গায় নামতে পারে। স্থির থেকে ভার্টিক্যালি উড়তে পারে। এ ভাবেই যন্ত্র গড়তে থাকে বিজ্ঞানীরা। সাফল্যের দরজায় এসে দেখা যায় এমন আকাশ যান বেশি উড়তে পারবে না। তবে যতটা আকাশ পথই যাক তাও অনেক বেশি। দ্রুত জরুরী প্রয়োজনে এই আকাশ যান এতটাই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল যা উদ্ভাবনে আর তর সইল না। সবচেয়ে দ্রুত এগিয়ে এলো ফ্রান্স। গত শতকের প্রথমার্ধে ১৯২৪ সালে ফরাসী বিজ্ঞানী এটিয়েন উইমিচেন প্রথম হেলিকপ্টার বানিয়ে আকাশে উড়াল দিয়ে প্রমাণ করলেন পাখি দেখে রাইট ব্রাদার্স বানিয়েছিলেন উড়োজাহাজ আর ফড়িং গবেষণা করে তিনি বানালেন হেলিকপ্টার। বিশ্বে প্রত্যেক দেশেই এই আকাশ যানের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য পতঙ্গের ওড়ার সঙ্গে ফড়িংয়ের ওড়ার পার্থক্য আছে বিস্তর। বিশেষভাবে ওড়ার জন্য ফড়িংয়ের শরীর আলাদা বৈশিষ্ট্যের। ফড়িংয়ের বুকের কাছে দুই জোড়া লম্বা ডানা আছে। যা দেখতে অনেকটা স্বচ্ছ। এই ডানা বা পাখা ফ্লাক্সিবল নয়। প্রসারিত এই ডানাকে ফড়িং এতটা জোড়ে পরিচালিত করে যে, বাতাসকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার সময় শব্দ হয়। ডানাগুলোও দেহের ওপরের দিকে ক্রসসেকশনে এঁটে থাকে। গঠন কাঠোমোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে ফড়িংয়ের ডানা গাছের পাতার মতো শিরা উপশিরার আচ্ছাদনে ঢেকে দেয়া। যাতে বাতাসের চাপ সয়ে দেহ থেকে ছিড়ে না পড়ে এবং উড়বার সময় দেহের ব্যালেন্সের হেরফের না হয়। ফড়িংয়ের ওড়ার বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হলো, ডানার অতিদ্রুত সঞ্চালন ভারসাম্য রক্ষা। যার ফলে ওড়ার সময় ওপরে ও নিচের অংশে যথাক্রমে নিম্ন ও উচ্চ চাপ ধারণ এবং সামনে পিছনের বাতাসের মধ্যে জ্যামিতিক কোণের সৃষ্টি করতে পারে। যে কারণে বাতাসের মধ্যেও ফড়িং ওপরে স্থির থাকতে পারে। যা সাধারণত অন্য পতঙ্গের মধ্যে নেই। ফড়িংয়ের পা বিশেষভাবে নাড়া চাড়া করেও ডানাগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ফলে যে কোন স্থানে বসে থাকা অবস্থায় যে কোন পরিস্থিতিতে ফড়িং ওপরে উড়ে উঠতে পারে। পাসহ ফড়িংয়ের দেহের তিনটি অংশই বিশেষ কৌশলে ডানাকে নিয়ন্ত্রণ করে। দেহের মধ্যে বুক বিশেষভাবে আচ্ছাদিত। মাথা গোলাকৃতির। এদিক সেদিক ঘোরাতে পারে। ওড়ার সময় বাতাসের মধ্যেই স্থির হয়ে ভেসে থাকে। ওই অবস্থাতেই ৯০ বা ১৮০ ডিগ্রীতে চট করে ঘুরে দিক পরিবর্তন করে উড়তে পারে। ফড়িংয়ের এই বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবিষ্কৃত হয় দ্রুতগতির হেলিকপ্টার। বর্তমানে হেলিকপ্টারকে সংক্ষেপে কপ্টারও বলা হয়। গত শতকের মধ্যভাগের পর আকাশে হেলিকপ্টারের উড়াল দেখে মানুষ বিস্মিতই হয়েছিল। বিশ্বের দেশে দেশে উড়োজাহাজের পাশাপাশি সকল দুর্যোগ ও জরুরী প্রয়োজনে হেলিকপ্টারই কাজে লাগে বেশি। বিশেষ করে যেখানে দ্রুত পৌঁছার সড়ক ব্যবস্থা নেই সেখানে হেলিকপ্টারই ভরসা। প্রকৃতির কপ্টার হয়ে ফড়িং আজও উড়ে বেড়ায় আকাশে।
×