ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আল মাহমুদের কবিতায় নারী

প্রকাশিত: ০৮:০৩, ১৩ জুলাই ২০১৮

আল মাহমুদের কবিতায় নারী

কবি আল মাহমুদ শিকড় সন্ধানী কবি। জীবনকে উপলব্ধি করেছেন জীবনের খুব কাছ থেকে। নিসর্গরাজির মধ্যেও খুঁজেছেন অনিবার্য জীবনের সেই প্রেম যা সৃষ্টির কার্যকারণ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে। আল মাহমুদ তাঁর কবিতা সমগ্রে বলেছেন, প্রকৃতির মধ্যে এমন একটা সংগুপ্ত প্রেমের মঙ্গলময় ষড়যন্ত্র দেখতে পাই যে আমাকে জগত রহস্যের কার্যকারণের কথা ভাবায়। এক ঝাঁক পাখি যখন গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে বেড়ায়, মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে পতঙ্গ ও পিঁপড়ের সারি, আর মৌমাছির ফুল থেকে ফুলে মধু শুষে ফিরতে থাকে আমি তখন শুধু এই আয়োজনকে সুন্দর করি না বরং অন্তরালবর্তী এক গভীর প্রেমময় রমণ ও প্রজনন ক্রিয়ার নিঃশব্দ উত্তেজনা দেখে পুলকে শিহরিত হই। কবি আল মাহমুদের কবিতায় প্রধান বিষয় হলো নারী। নারী জীবনের প্রকৃতি, মহাপ্রকৃতি উঠে এসেছে তার কবিতায়। পৃথিবীতে যত বিখ্যাত কবি দেখতে পাই; তারাও নারীকে নিয়ে লিখেছেন। তাদের কবিতায় উপমা দিয়েছেন নারী দেহের সঙ্গে তুলনা করে। আল মাহমুদও লিখেছেন জীবনের প্রয়োজনে, মানুষের আনন্দ ও সৌন্দর্যকে চিরজাগ্রত করার জন্য। মানুষের এই সৌন্দর্য ক্ষুধা থেকেই তো একজন কবির জন্ম হয়। ‘সোনালি কাবিন’ আল মাহমুদের এক অনবদ্য সৃষ্টি। আদিম চৈতন্যের সহজাত প্রবৃত্তিকে সহজভাবেই ধারণ করেছেন অসাধারণ রূপকল্পে। কিন্তু তার সেই মানস সুন্দরীকে পাওয়ার কোন আশ্রয় নেননি তিনি। বরং সম্মতি চেয়েছেন, সে যদি রাজি থাকে তা হলেই দিতে পারেন কাবিনবিহীন হাত দুটি। তিনি মানব আচরণের সীমা ছাড়িয়ে যাননি। প্রিয়জনের কাছে আত্মসমর্পণই এক অর্থে প্রেমকে নতুনভাবে উন্মোচিত করে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করে। প্রেমের নতুন উপলব্ধিকে নানাভাবে ধরিয়ে দিয়েছেন কবিতায়; সোনার দিনার নেই, দেন মোহর চেয়োনা হরিণী যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি (সোনালি কাবিনÑ নারীর লাবণ্যময় সৌন্দর্যের মাঝে আল মাহমুদ সঙ্গীতকে আবিষ্কার করতে চান। যে গান হবে হয়ত অন্য কোন গান হতে পারে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কিংবা কোন মঙ্গলময় বাণী হয়ে প্রেমকে করতে চায় আরও ঐশ্বর্যময়। এ রকম কিছু একটা ভাবছেন হয়ত তিনি। তাকে কেবল স্তন বললে কী করে পোষায় আমি তাকে সঙ্গীতই বলি। গানের বিরুদ্ধে গান। ঐ তো ব্লাউজে উঁচু হয়ে আছে বাণীর আভোগ। (দোয়েল ও দয়িতা; দোয়েল ও দয়িতা) কবি সৈয়দ আলী আহসানের নারীর সঙ্গে আল মাহমুদের নারীর অনেকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তিনিও নারীর সৌন্দর্যের মাঝে সঙ্গীতকে আবিষ্কার করেছেন। প্রেমের ইচ্ছাগুলো রাত্রির গান হয়ে অন্ধকারের সেতু হয়েছিল এবং তোমার উজ্জ্বল ঊরুতে আমার স্পর্শ কেঁপেছিল। (কবিতা সমগ্র : উচ্চারণ : ৩১) নারীদেহের রসময় বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গের বর্ণনা চিত্রকল্পে আকর্ষণীয় করে তুলেছেন। স্তনের সৌন্দর্য উপমার চিত্র কল্পনা করেছেন। চাষীর বিষয় নারী উঠোনে ধানের কাছে নুয়ে থাকা পূর্ণস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী (কবির বিষয় : অদৃষ্টবাদীদের রান্না) কিছু কিছু কবিতায় আল মাহমুদের নারী অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ও কামোদ্দীপক। চিত্রকল্পের আশ্রয় নিয়ে শালীন ভাবেই বলেছেন কিন্তু তা প্রবেশ করেছে গভীর থেকে আরও গভীরে। আঘাত থেকে আসবে ছেলেগুলো নাভির নিচে উষ্ণ কালসাপ (মাংসের গোলাপ : কালের কলস) আল মাহমুদ রমণীদেহের বর্ণনা বিভিন্ন উপমায় শোভিত করেছেন : ত্রিকোণ আকারে যেন ফাঁক হয়ে রয়েছে মৃন্ময়ী আর সে জ্যামিতি থেকে ক্রমাগত উঠে এসে মাছ পাখি পশু আর মানুষের ঝাঁক (প্রকৃতি : সোনালি কাবিন) প্রিয়তমাকে তিনি উপলব্ধি করেছেন জলসিক্ত সুখদ লজ্জায় প্রকৃতির মত। প্রকৃতির মত ফুলে ফলে সুশোভিত করে রসময় কুরে তুলেছেন নারীকে। ক্ষীরের মতন গাঢ় মাটির নরমে কোমল ধানের চারা রুয়ে দিতে গিয়ে ভাবলাম; এ মৃত্তিকা প্রিয়তমা কিষাণী আমার বিলের জমির মতো জলসিক্ত সুখদ লজ্জায় যে নারী উদাম করে সর্ব উর্বর আধার। (প্রকৃতি : সোনালি কাবিন) দেবদারুর মত দেহ, রাজা মহীপালের দীঘি, মিথুনরত কবুতর, এই যে উপমার নতুন ব্যবহার আমাদেরকে সত্যিই অবাক করে। তাঁর কবিতায় উড়াল দেয়ার ক্ষমতা লক্ষ্য করি। যে কবিতা বাস্তব জগত ছাড়িয়ে কল্পনা জগতের সৌন্দর্যকে আস্বাদন করতে পারে তাই মহৎকবিতা। দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারুর মত দেহ তার। চোখ যেন রাজা মহিপালের দীঘি। আর বুক দুটি মিথুনরত কবুতর। তার নাভি রন্ধ্রের ভেতর একটি ভরত পাখির মত আমি অনন্তে হারিয়ে গেলাম। (অস্পষ্ট স্টেশন : আরব্য রজনীর রাজহাঁস) পৃথিবীর সমস্ত বেদনা ধরে রেখেছে নারী, না সমস্ত বেদনা ধরে রেখেছে নারীকে? কবি অনুভব করেন এক নারীর ভেতর তাবত পৃথিবীর সৌন্দর্য। শুধু তাই নয়, নারীর প্রসবকালীন যে বেদনা, সেই বেদনাও তিনি নিজের ভেতর অনুভব করেন। এই নারীরা আমার বাসনার ডালপালা। এদের নাভী আমার চোখ যেমন মাছে চোখে কোন পলক পড়ে না তেমনি অজস্র নাভীর ছিদ্র দিয়ে তীর্যক হয় আমার দৃষ্টি। আমি কেবল দেখি আমার দৃষ্টির নিচেই সমস্ত কুমারীর প্রসবকালের যাতনা। আমার দৃষ্টিই জগতের তাবত ঐশ্বর্য অবলোকনের প্রতিচ্ছবি। (বিরামপুরের যাত্রী : কাকস্য পরিবেদনা) সীমার মাঝে অসীমকে ধারণ করতে চান তিনি। একজন মহৎ কবির পক্ষেই তা সম্ভব। কামনার লালা থেকে অন্য কোন সৌন্দর্যের পথ খুঁজে নিয়ে তিনি পৌঁছে গেছেন জীবনের গন্তব্যে। ভাব, তোমার ঊরু যুগলের কথা। মনে হয় যেন পেসিফিকের শান্ত সন্ধ্যার সৌন্দর্য অতিক্রম করে, একটি মাত্র পালতোলা জাহাজ বন্দরের কাছে এসে পড়েছে। (বিরামপুরের যাত্রী : কে কার উপমা) তাঁর চোখকে তিনি বিশুদ্ধ রাখতে চান। তাই নারীর স্তনকে কামনার স্তন হিসেবে দেখেননি। বরং দেখেছেন মুনি ঋষিদের ধ্যানরত অবস্থায়। তাই সব সময় নুয়ে থাকে। এ দেখা সামান্য নয়। বরং আমাদের চেতনাবিন্দুকে তা স্পর্শ করে। আমার চোখের জন্য তৃপ্তিকর ক্লোরোফিল খুঁজতে গিয়ে নগ্ন পৃথিবীকে দেখলাম হুবহু যেন তুমি দেখ আমি আর উপমার দিকে যাই না। আমি বলি না তোমার স্তন বিন্ধ্য পর্বতের মতো যা অগস্ত মুনির আশীর্বাদ ধন্য হয়ে একটু নুয়ে আছে (বিরামপুরের যাত্রী : কে কার উপমা) কবির অভিজ্ঞতা বিভিন্ন স্বাদের। তার আত্ম আবিষ্কার, মহাকাল নারীর জন্যই প্রতিটি প্রত্যুষের জন্ম দিতে থাকে। কার্যত মায়ার বাঁধনেই পৃথিবী টিকে থাকে। তোমার ঠোঁটের কাছে ঠোঁট ঘষে মনে হলো কাল নারীর নুনের মধ্যে আছে এক মায়াবী আগুন। যার লোভে মহাকাল জন্ম দেয় প্রতিটি সকাল। (আরব্য রজনীর রাজহাঁস : কালের অভয়) কিভাবে মানব শিশু ভ্রƒণে জন্মলাভ করে? শিল্প সম্মতভাবেই এই সৃষ্টি তত্ত্বের বর্ণনা করেছেন। পুরুষ চালায় হাল আলভেঙ্গে ঠেলে যায় ফাল মাটি মাখন করে গোঁজে বীজ গোঁজে জন্মকণা নারীর কোষের মাঝে রাখে কীট কালোত্তীর্ণ প্রাণের কীটানু। (অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না : কবির বিষয়) তিনি নারীকে দেখেছেন মানবমুক্তির প্রেমময় জীবনসত্তারূপে। তাঁর কবিতার বিষয় বিন্যাসের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে তাঁর আধ্যাত্মিক চিন্তা ও চেতনার বিষয় আমাদের কাছে আরও গভীর ও রহস্যময় হয়ে েেঠ। সেখানে একক সত্তা আল মাহমুদকে আবিষ্কার করা যায়। তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গাটি ওই একই কেন্দ্রবিন্দুতে এসে মিলিত হয়েছে। ফলে নারীর মধ্যেও তিনি অলৌকিক শক্তির আঁধারের সন্ধান করেন। সামান্য দরিদ্র ও সৎ স্বভাবের একজন লায়লার ভেতর অদৃশ্যের ছায়া দেখেন। লায়লা কেন আসেন বার বার তার কাছে? তাই প্রশ্নবাণে তাকে জর্জরিত করেন। লায়লা তুমি কি জিনদের মেয়ে? রহস্যময়ী অশরীরী অতৃপ্তির ছায়া কি তুমি? না কি জ্যোতির্ময়ী পরমধ্যানে আপ্লুতা নারীসত্তা? বলো, তুমিই হবে রাবেয়া বসরী? (মিথ্যাবাদী রাখাল : এক লায়লার কাহিনী) রমণীকে নগ্ন কুসুম করে তোলেননি কবি আল মাহমুদ। একজন বড় কবির জন্য যতটা উন্মোচিত হওয়া দরকার ঠিক সে পর্যায়েই রেখেছেন। কবিতায় নারী দেহ বর্ণনায় সতর্ক থেকেছেন। কখনও বা নারীর পথচলার পথের ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। তোমার আব্রু ঠিক করে নাও। এই তো ছতর ঢাকার সময় কোথায় হারিয়ে এসেছে তোমার বুকের সেফটিন? আজ ইবলিসকে তোমার ইজ্জত শুকতে দিও না। (বখতিয়ারের ঘোড়া) : নীল মসজিদের ইমাম) তিনি প্রেমকে দেখেছেন আধ্যাত্মিকভাবে। শুধু কামকলা শেখানোর জন্য নয় সুফী দরবেশগণ খুঁজে পান অসীম সৌন্দর্য ও প্রেম। তারা দেহতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব¡, মারেফাত তত্ত্ব, যোগতত্ত্ব, নারী বিভিন্ন তত্ত্বের মধ্য দিয়ে অসীম প্রেমকে খুঁজে পান। এসব রহস্যের গূঢ়তত্ত্বের মধ্য দিয়ে আল মাহমুদ কি খুঁজছেন তেমন কিছু যোগির মতো? তা না হলে তিনি কোন মোক্ষ লাভ করতে চান। একমাত্র সুফী দরবেশগণই তো মোক্ষ লাভের দরজায় পৌঁছতে চান। আমারও মোক্ষই কাম্য, মেহনের চৌহদ্দি পেরিয়ে ছুঁয়ে চাই আসক্তির আরও গূঢ় রহস্যের তল যে লোকে পূর্ণাঙ্গ তৃপ্তি দীপ্তিময় রয়েছে দাঁড়িয়ে যেন এক অগ্নিলেখা যোগিনীর মতো যোগবল (আরব্য রজনীর রাজহাঁস : দেহতত্ত্ব) তার কবিতায় নারী দেহের বর্ণনায় কিছু উপমা ও চিত্রকল্প এবং নতুন শব্দের প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয় সোনার স্তন, মিথুনরত কবুতর, মাংসের গোলাপ, ফলবতিবৃক্ষ শঙ্খমাজাস্তন, নুনভরাদেহ কামের টঙ্কার, আর্যের যুবতী, ঠোঁটের লাক্ষারাস, যৌবন জরদ, ঈশ্বরের অপরূপ ফল, অনিবার্ণ যৌবনের ফুল, নাভির নিচে উষ্ণ কালসাপ, রতির দরদ, নরম গুল্মের কৃষ্ণ সানুদেশ, মাংসের উষ্ণ আতাফল, দুটি বর্তুল শংখ, পূর্ণস্তনী ঘর্মান্ত যুবতী, ব্যর্থকামের জ্বর, ছিন্ন ভিন্ন নারী জ্যামিতির গুল্মময় ত্রিকোণ কদর্ম হলুদ কষ, নগ্ন ঊরু, মাড়াইয়ের কল, চকোলেট রঙের ঠোঁট, অযোনী সম্ভব, সপ্রভিত তলপেট, আপেল বাগান, সুপক্ক সোনালি ফল, ওৎঁপেতে থাকা মাংস, অজ¯্র নাভী ছিদ্র, পাখির উড়ালের মতো ভ্রু, কদলী কা-ের মত ঊরু, সাদা শঙ্খের মত বলয়িত স্তন, চিম্বুক পাহাড়ের মতো নাসিকা, মাধব কু-ের মত ধূমায়িত নাভিমূল, কাম, কেলি, শূন্য কলস, মূত্র ভেজা যোনীর দেয়াল, চরের মাটির মত শরীরের ভাঁজ এ রকম অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে নারী বিষয়ক কবিতা থেকে। আসলে কামজ প্রেম বা দৈহিক মিলন তো সত্যিকারের প্রেম হতে পারে না, প্রেমেরও অনেক রং রূপ আছে, তা বিভিন্ন রকম ও ভিন্ন স্বাদের। কবি আল মাহমুদের নারী সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি দেহজ কামনাকে ছাড়িয়ে চলে গেছেন আরও উর্ধজগতে। সে পর্যায়ে কোন কামনা বাসনা থাকে না। থাকে হৃদয়ের নিবিড় প্রশান্তির আলো তিনি এক নারীর ভেতর শুধু প্রকৃতি নয়, সমস্ত পৃথিবীর ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির রহস্য খুঁজে পেয়েছেন।
×