ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশ ইন্সপেক্টর মামুন হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন

প্রকাশিত: ০৮:০২, ১৩ জুলাই ২০১৮

পুলিশ ইন্সপেক্টর মামুন হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন

শংকর কুমার দে ॥ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) ইন্সপেক্টর মামুন ইমরান খানকে নির্মমভাবে হত্যার পর লাশ গুমের চেষ্টার ঘটনার বর্ননা করেছেন প্রকৌশলী রহমত উল্লাহ (৩৫) তার দেয়া জবানবন্দীতে। তার দেয়া এই জবানবন্দীতে চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের নিষ্ঠুরতার কাহিনী যেন সিনেমার রহস্যঘন উপন্যাসের কাহিনীকেও হার মানায়। পুলিশ ইন্সপেক্টর হত্যাকা-ের রহস্য উদঘাটন করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। প্রকৌশলী রহমতউল্লাহকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের পর্যায়ে দেয়া জবানবন্দীতে পুলিশ ইন্সপেক্টর মামুন ইমরান খানের লোমহর্ষক হত্যাকা-ের পর লাশ গুম করার চেষ্টার সেই কাহিনী বর্ণনা করা হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্রে এ খবর জানা গেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, চাঞ্চল্যকর পুলিশ ইন্সপেক্টর মামুন হত্যাকা-ের ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছে প্রকৌশলী রহমতউল্লাহ নামের এক আসামিকে। মঙ্গলবার রাতে প্রকৌশলী রহমত উল্লাহ নামের এই আসামিকে রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেফতার করা হয়। বুধবার তাকে আদালতে সোপর্দ করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হলে ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। বর্তমানে তাকে মিন্টো রোডে গোয়েন্দা হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে হত্যাকা-ের বিবরণ ও সহযোগীদের নাম বলেছে। মামুন হত্যাকা-ে অংশ নেয়া অন্য আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ ইন্সপেক্টর নিহত মামুনের ভাই জাহাঙ্গীর আলম খান বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন বনানী থানায়। এরপর রহমত উল্লাহ নামে এক আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের চাঞ্চল্যকর কাহিনীর বিবরণ দিয়েছেন প্রকৌশলী রহমতউল্লাহ। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, গত ৮ জুলাই, রবিবার রাত থেকে মামুনের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন পরিবারের সদস্যরা। পরদিন গত ৯ জুলাই তারা এসবি কার্যালয়ে গিয়ে খোঁজ করেন মামুনের। তাকে না পেয়ে সবুজবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এসবি ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের খিলগাঁও জোনাল টিম যৌথভাবে বিষয়টি অনুসন্ধান শুরু করে। পরে প্রযুক্তির সহযোগিতায় তারা কিছু তথ্য পায়। সেই সূত্র ধরে গাজীপুরের সেই বাঁশঝাড় থেকে লাশ খুঁজে বের করে। মঙ্গলবার রাতে গ্রেফতার করা হয় রহমত উল্লাহকে। গ্রেফতারের পর রহমত উল্লাহ জিজ্ঞাসাবাদে সব স্বীকার করে জবানবন্দী দেয়। অভিযুক্ত ঘাতক দলের সদস্য রহমত উল্লাহ দেয়া জবানবন্দীতে পুলিশ ইন্সপেক্টর মামুন হত্যাকা-ের পর লাশ গুমের যে বর্ণনা দেয়। হত্যাকা-ের বর্ণনা যেন নির্মম ও নিষ্ঠুরতায় ভরা প্রতিহিংসা আর জিঘাংসার কাহিনী। বন্ধু রহমত উল্লাহ’র ডাকে এক মডেল ও অভিনেত্রীর জন্মদিনে যোগ দেয়ার জন্য বনানীর একটি বাসায় গিয়েছিলেন এসবির ইন্সপেক্টর মামুন ইমরান খান। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথমে ফাঁদ পেতে সেই মডেল ও অভিনেত্রীর সঙ্গে অশ্লীল ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা করা হয় তাকে। মামুন তখন নিজের পরিচয় দিয়ে দেন। পুলিশ ইন্সপেক্টর পরিচয় দেয়ার পর তাকে নির্দয়ভাবে বেদম মারধর করা হয়। নিষ্ঠুর নির্যাতনের এক পর্যায়ে মারা যায় মামুন। সারারাত তার লাশ নিয়ে বসে থাকে সন্ত্রাসী চক্রের সদস্যরা। পরদিন সকালে বস্তায় লাশ ভরে রহমতের প্রাইভেটকারের ব্যাকডালায় তোলা হয়। লাশ নিয়ে সারাদিন তারা গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। সন্ধ্যায় গাজীপুরের কালীগঞ্জ থানার উলুখোলা রাইরদিয়ার রাস্তার পাশে নির্জন এলাকায় গাড়ি দাঁড় করায়। এর আগে তারা একটি পাম্প থেকে সাত লিটার পেট্রোল কেনে। পরে গাড়ি থেকে লাশ বের করে বাঁশঝাড়ে ফেলে দিয়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারপর যার যার গন্তব্যে চলে যায় ঘাতক দলের সবাই। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, শোবিজ মিডিয়ায় মাঝে মধ্যে অভিনয় করার সুবাদে রহমত উল্লাহ’র সঙ্গে পরিচয় ছিল মামুনের। রহমত উল্লাহ পেশায় প্রকৌশলী হলেও শোবিজ মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত। গত ৮ জুলাই, রবিবার বিকেলে রহমতের সঙ্গে ফোনে কথা হয় মামুনের। এ সময় রহমত তাকে মডেল ও অভিনেত্রী মেহেরুন নেছা আফরিন ওরফে আন্নাফি আফরিনের জন্মদিনের পার্টি আছে বলে জানায় তাকে। মোটরবাইক নিয়ে মামুন যায় বনানীর ২/৩ সড়কের বাড়িতে। ওই সড়কের ৫ নম্বর বাসার এ-২ ফ্ল্যাটে সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করা রহমত নিয়ে যায় তাকে। মিডিয়া হাউসের নামে ওই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়ে নিয়মিত মদ্যপান, নাচ গানের জলসা ঘর সাজিয়ে আসর জমাতো এই চক্রটি। মডেল ও অভিনেত্রীরা ছিল ওই জলসা ঘরে ফাঁদ পেতে প্রতারণা বা ব্ল্যাকমেইল করার চক্রের মক্ষিরাণী। সেখানেই নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ ইন্সপেক্টর মামুনকে। ওই ফ্ল্যাটেই আন্নাফি আফরিনসহ স্বপন, মিজান, আতিক, শেখ হৃদয় ওরফে আপন ওরফে রবিউল, সুরাইয়া আক্তার কেয়া, ফারিয়া বিনতে মীম ওরফে মাইশা অপেক্ষা করছিল বলে জবানবন্দীতে জানায় গ্রেফতার হওয়া রহমতউল্লাহ। রহমত উল্লাহ দেয়া জবানবন্দীতে জানায়, মামুন বনানীর সেই বাড়িটিতে যাওয়ার আগে থেকেই একসঙ্গে ইয়াবা সেবন করেছিল তারা। সেখানে মামুন ও রহমত যাওয়ার পর পূর্ব-পরিকল্পনা মতো অশ্লীল ছবি তুলে মামুনকে আটকে রেখে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করে সংঘবদ্ধ এই চক্রটি। কিন্তু মামুন নিজেকে পুলিশ পরিচয় দেন। এ সময় আগে থেকেই ইয়াবা সেবন করা সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্যরা তাকে বেদম মারধর করে। এতে অচেতন হয়ে যান মামুন। পরে রাতভর লাশের সামনে বসেই লাশ গুমের পরিকল্পনা করে তারা। রাতের আঁধার কেটে সকাল হয়ে গেলে বস্তার ভেতরে ঢুকানো হয় মামুনের লাশ। গত ৯ জুলাই সকাল প্রায় ৮টার দিকে লাশসহ বস্তাটি রহমতের নিজের গাড়ির ব্যাকডালায় ঢোকায়। এতে তাদের সহযোগিতা করে ওই বাসার অফিস স্টাফ দিদার। পরে গাড়িটি নিয়ে রহমত, স্বপন, মিজান ও আতিক বেরিয়ে যায় গাজীপুরের উদ্দেশে। একটি পাম্প থেকে সাত লিটার পেট্রোল কেনে গাড়িতে রাখে তারা। এরপর তারা গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় লাশ নিয়ে ঘোরাফেরা করে। কিন্তু লাশ গুমের সুযোগ পায় না। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসলে ঘাতক দলের সদস্যরা কালীগঞ্জের উলুখোলা রাইদিয়া এলাকার নির্জন জায়গায় যায়। সেখানে একটি বাঁশঝাড়ের মধ্যে লাশসহ বস্তাটি নিয়ে যায়। বাঁশঝাড়ের ভেতরে লাশের বস্তাটি ফেলার পর সে তাতে নিজেই পেট্রোল ঢেলে দেয়। তার অন্য সহযোগীরা আগুন ধরিয়ে দিলে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। তারা সেখানে আর অপেক্ষা না করে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। ঢাকায় আসার পর যে যার মতো করে গন্তব্যে চলে যায়। আর এভাবেই পুলিশ ইন্সপেক্টর মামুন হত্যাকা-ের পর লাশ গুম করার নেপথ্যের চাঞ্চল্যকর কাহিনী বের হয়ে এসেছে।
×