ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ত্রিপুরায় শুদ্ধ সুরে নজরুলসঙ্গীতের কণ্ঠসৈনিক মায়া রায়

প্রকাশিত: ০৭:৫৮, ১৩ জুলাই ২০১৮

ত্রিপুরায় শুদ্ধ সুরে নজরুলসঙ্গীতের কণ্ঠসৈনিক মায়া রায়

অপরাজিতা : আপনার জন্ম, বেড়ে ওঠা, শিক্ষা... মায়া রায় : জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া। শৈশব, কৈশর ওখানেই কেটেছে। তিতাস পাড়ের কন্যা আমি। বি-বাড়িয়া মডেল গার্লস হাই স্কুল থেকে ১৯৬৭ সালে মাধ্যমিক পাস করার পর ত্রিপুরার আগরতলা চলে যাই। এসএসসি পরীক্ষার সময় সঙ্গীত ছিল আমার এডিশনাল সাবজেক্ট। সে সময় আমি কুমিল্লা বোর্ডে গিয়ে মিউজিক পরীক্ষা দিয়েছি। আগরতলা মহিলা মহাবিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন। এ ছাড়াও কোর্স করেছি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অপরাজিতা : আপনার সঙ্গীত শিক্ষার শুরু, যাদের কাছে শিখেছেন... মায়া রায় : আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি তখন থেকে আমার গান শেখা। পারিবারিকভাবে আমার দিদি সন্ধ্যা রায় আমার প্রথম সঙ্গীত শিক্ষাগুরু। তিনি বাহ্মণবাড়িয়া শিল্পকলা একাডেমিতে ক্লাসিক্যাল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং বেতার শিল্পী। বি-বাড়িয়াতেই আমার সঙ্গীতের কাঠামো তৈরি হয়েছে। আমার সঙ্গীত শিক্ষক ছিলেন : গজেন্দ্র লাল রায়, অধ্যক্ষ উমেশ চন্দ্র রায়, আদিল হোসেন খান। আমার গুরু উমেশ চন্দ্র রায় যিনি বি-বাড়িয়া আলাউদ্দিন মিউজিক কলেজের অধ্যক্ষ। উনি আমাকে শিখিয়েছেন কিভাবে সঙ্গীত নিয়ে এগিয়ে যাওয়া যায়। রেওয়াজ কি করে করতে হয়। কি করে ক্লাসিক্যালে উন্নতি করা যায়। আগরতলায় পড়ালেখার ফাঁকে যখন ছুটি হতো, আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে তালিম নিয়ে যেতাম। আগরতলায় আমার গুরু ছিলেন হিরণ দেব বর্মণ। এ ছাড়াও আমার গুরু মা আরতি কর। অপরাজিতা : নজরুলসঙ্গীত বেছে নেয়ার কারন? মায়া রায় : আগরতলায় আমাদের কলেজের এক অনুষ্ঠানে আমি আসার পর মাস্টারমশাই বললেন ‘এত দেরি করলে কেন? তাড়াতাড়ি আসো। রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার অনেক শিল্পী আছে কিন্তু নজরুলের গান গাইবার একজনও শিল্পী নেই।’ ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না তার পরও দুটি গান গেয়েছিলাম। তখন আমার মনের মধ্যে আক্ষেপ আসে যে এত বড় একটা শহর, এখানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের এত ছড়াছড়ি কিন্তু নজরুলের গান গাইবার কেউ নেই! সিদ্ধান্ত নেই, ‘আমি গাইব নজরুলের গান।’ আরেক কারন হলো, অসুস্থ নজরুলকে ঢাকায় আনার পর আমি তাঁকে দেখতে ঢাকায় আসি। আমি তখন কলেজে পড়ি। অনেক অনুরোধে দেখা করার পারমিশন মিলেছিল। রুমে ঢুকে দেখি উনি শুয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। তার চোখের দৃষ্টি এতই উজ্জ্বল যে চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। চোখ নামিয়ে নিতে হয়। ওনার পা ঢাকা ছিল। আমি ওনাকে প্রণাম করতে যাওয়ায় উনি পা টেনে নেন। আমি ভয়ে তৎক্ষণাৎ দু’পা পিছিয়ে এলাম। ওনার পাশে যারা ছিলেন তারা বললেন ‘ওনার পায়ে ফোঁসকা পড়েছে এ কারণেই বাঁধা দিয়েছেন।’ আবার অনুরোধ করলাম, আমি তার হাতটা একটু ধরতে চাই। অনুমতি পেলাম। আমি কাছে গিয়ে তাঁর হাতটা আমার মাথায় রাখলাম। তরপর থেকে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল, এমন একজন সৃষ্টিশীল মানুষ, যিনি বাংলা সাহিত্য, বাংলা সঙ্গীত জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন, বাঙালীর বুকে চেতনার বীজ বপন করেছেন। অথচ সেই মানুষ এভাবে নির্বাক হয়ে পড়ে রয়েছেন। তখন থেকে আমি আরও ডিটারমাইন্ড হলাম আমি নজরুল সঙ্গীতই গাইব। অপরাজিতা : আদি শুদ্ধ স্বরে নজরুল সঙ্গীত গাইবার প্রয়োজনীয়তা কখন থেকে অনুভব করলেন এবং কেন? মায়া রায় : বি-বাড়িয়ায় ছোটবেলায় যখন গান শিখেছি তখন তো আদি সুরেই গাইতাম। তখন তো বুঝতাম না কোন্টা সঠিক সুর। কিন্তু যখন আগরতলায় গেলাম, দেখি একেক জন একেক রকম ভাবে গাইছে। ক্যাসেট থেকে অনুকরণ করে গাইছে। তখন আমিও গেয়েছি। কিন্তু ১৯৯৭ সালে যখন মহারাজ বীরবিক্রম কলেজে লাইব্রেরিয়ান হিসেবে চাকরি করি তখন নজরুলের ওপর পড়ার বিশেষ সুযোগ পেয়েছিলাম। নজরুলের গান কিভাবে বিকৃত করা হচ্ছে এর ওপর বিশেজ্ঞরা লিখেছেন এ বিষয় নিয়ে আমার মনের মধে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। আমি সিদ্ধান্ত নেই নজরুলের আদি সুরকে ছড়িয়ে দিতে আমি কাজ করে যাব। অপরাজিতা : আপনার এ কাজের কিছু কথা... মায়া রায় : আমি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা শুরু করলাম। কিছু লেখা একত্র করে আমি বাংলাৃদেশে আসি। এখানকার নজরুল সঙ্গীতের বড় বিশেষজ্ঞ এবং শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলি। আদি সুরের প্রচারে আমার ভাবনাগুলো তাদের কাছে তুলে ধরি। তারা আমায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। অপরাজিতা : আমরা জানি বালাদেশের সঙ্গে আপনার একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ত্রিপুরায় আদি সুরে নজরুলসঙ্গীত প্রসারে আপনার যে যুদ্ধ সেই যুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে কতটা সমর্থন পেয়েছেন। মায়া রায় : বাংলাদেশ সহযোগিতা না করলে আমার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব হত না। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমার চলার প্রতিটি পদক্ষেপে তারা সহযোগিতা করেছেন। আমি যখন ২০০২ সালে ঢাকার নজরুল ইনস্টিটিউটে আসি তখন সৈয়দ মান্নান, ড. রশিদুন নবীÑ ওনাদের আমার লেখা দেখাই। ওনারা লেখার প্রশংসা করে, বই লিখতে উৎসাহ যোগায়। আমার প্রথম বই ‘নজরুলসঙ্গীতের বৈচিত্র্য বিপন্নতা।’ পরেরবার এসে সুধীন দাস দাদাকে বলি, ‘দাদা আমাদের রাজ্যে তো আদি সুরে স্বরলিপির বই পাওয়া যায় না, আপনি যদি অনুমতি দেন আমি স্বরলিপির বই করতে চাই। বইয়ে আপনাদেরই নাম থাকবে আমি শুধু গান বাছাই করে সম্পাদনা করব। উনি রাজি হলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, কর। এত ভাল কথা।’ ৩টি স্বরলিপির বই করলাম। আবার এসে, সুধীন দাদাসহ অন্যদের বললাম, ‘আপনারা তো পুরনো রেকর্ড থেকে অনুকরণ করে নতুন সিডি বের করছেন, ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, তারা আবার সিডি বের করছে। আমি তো আপনাদের কাজ দেখে মুদ্ধ। আমি আমার রাজ্যে এটা করতে চাই।’ ড. রশিদুন নবী বললেন, ‘কর। এত ভাল কথা। আমরা তোমার সঙ্গে আছি। আমরা চাই নজরুল সবখানেতেই ছড়িয়ে পড়ুক।’ তাঁরা আমায় উৎসাহ দিলেন, নানাভাবে সহায়তা করলেন। আগরতলায় সুর-অঞ্জলি নামে আদি সুরে নজরুলসঙ্গীতের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল। সুধীন দাস, সোহরাব হোসেন, ড. রশিদুন নবী, খালিদ হোসেন, আসাদুল হক, তৌহিদুন নবীসহ অন্য সবার কাছে আমরা চির ঋণী। অপরাজিতা : নজরুলের গানে আদি সুর এবং স্বাধীনতা... মায়া রায় : কাজী নজরুল নিজে যে সুরে গেয়েছেন তার রেকর্ড, তিনি জীবিত থাকাকালীন তার সান্নিধ্যে যারা গান শিখেছেন সেই রেকর্ড অর্থাৎ সেই সুরই হচ্ছে নজরুলের গানের আদি সুর। নজরুল কখনও তাঁর গানে স্বাধীনতা দিয়ে যাননি। এটা ভ্রান্ত ধারণা। কোন শ্রষ্ঠা কি চায় যে তাঁর সৃষ্টি নষ্ট হোক? কবি নিজে এর জোরালো প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেছিলেন ‘আমার গান যদি পছন্দ না হয় তা হলে গেয়ো না।’। একবার রেডিওতে কোন এক মহিলা ভুল সুরে গান গেয়েছিলেন। গান শুনে কবি বলেছিলেন ‘আমি যদি সামনে পেতাম তবে সুরাসুরের যুদ্ধ বেঁধে যেত।’ এ রকম দৃঢ় কথা যে কবি বলেছেন, তাঁর গানে স্বাধীন সুরের কথা বলা রীতিমতো অপরাধ। অপরাজিতা : আপনার শুরুর সময়টাতে ত্রিপুরায় নজরুলসঙ্গীত চর্চার অবস্থা কেমন ছিল? মায়া রায় : আগরতলা কলকাতার মুখাপেক্ষী। আগরতলার শিল্পীরা কলকাতার অবিকল অনুকরণ করে গান গেয়ে হাততালি কুড়ায়। তখন নজরুলসঙ্গীত যে যার মতো গাইত। একই গানের বিভিন্ন সুর। অপরাজিতা : নজরুলের গানের আদি সুর প্রচারে কোন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন কি? মায়া রায় : হয়েছি। ভালবাসা, ¯েœহে দিয়ে বুঝিয়ে এবং নিরলস কর্মের মাধ্যমে উৎড়ে উঠেছি। পেছনে মানুষ বলেছে ‘ও আবার কি পাগলামো শুরু করল? আদি সুর আবার কি? তা হলে আমরা কি ভুল গাইছি? তবে পরবর্তীতে তারা বুঝেছে এবং গ্রহণ করছে। অপরাজিতা : সুর-অঞ্জলি নিয়ে আপনার পথ চলার গল্প... মায়া রায় : এ বছর সুর-অঞ্জলির বয়স ২৫ বছর হলো । বিগত পনেরো বছর ধরে আমরা জোড়ালোভাবে শুদ্ধ সঙ্গীত নিয়ে কাজ করে চলেছি। আমরা প্রতি বছর নজরুল উৎসব পালন করি। এ সময় আমরা তিন দিনের এক কর্মশালার আয়োজন করে থাকি। এ কর্মশালায় বাংলাদেশ থেকে গুণী শিল্পীরা যোগ দেন, তাঁরা গান করেন, কর্মশালায় শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেন। দিনে দিনে শিল্পীদের মনে নজরুলের শুদ্ধ সুরের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। এভাবেই সুর-অঞ্জলি এগিয়ে চলেছে। অপরাজিতা : সঙ্গীত এবং গীতি নিয়ে কিছু বলবেন... মায়া রায় : সঙ্গীত কথাটি ব্যাপকতা, বিশালতার পরিচয় বহন করে। গীতি কথাটির মধ্যে গীতিমাল্য অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত পরিসর বোঝায়। নজরুল গান লিখেছেন সাড়ে তিন হাজার। তাঁর কর্মময় জীবন ছিল স্বল্পসময়ের এবং সংগ্রামময়। তবুও তিনি ৫টি স্বরলিপির বই লিখেয়েছেন। আমরা নজরুলের গানকে নজরুলসঙ্গীত বলে প্রাধান্য দেই এবং যুক্তিসঙ্গত মনে করি। অপরাজিতা : ভারতের অন্যান্য রাজ্যের ভাষায় নজরুলসঙ্গীত প্রচারের কোন উদ্যোগ আছে কিনা? মায়া রায় : এখন আমরা আদি সুর প্রচারে কাজ করে চলেছি। আমরা সফল। তবে পথের এখনও অনেক বাকি। যদি শুদ্ধভাবে অনুবাদ করা যায়, পরবর্তীতে এ নিয়ে কাজ হবে। অপরাজিতা : নতুন প্রজন্ম থেকে নজরুলসঙ্গীত শিল্পী সেভাবে উঠে আসছে না কারণ... মায়া রায় : প্রথম কারণ সুর নিয়ে বিভ্রান্তি। পরেরটি মিছে ভয়। কেননা অনেকে মনে করেন নজরুলসঙ্গীত গাইতে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত ভাল জানতে হয়। অন্য কারণ হচ্ছে ছেলেবেলায় ইচ্ছা থাকলেও বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য পড়ালেখার চাপ থাকে। কারও আবার সংসার জীবনে বাঁধা থাকে। অপরাজিতা : বাংলাদেশের নবীন নজরুলসঙ্গীত শিল্পীদের উদ্দেশে আপনার কিছু কথা; মায়া রায় : নতুনরা আরও বেশি করে নজরুলসঙ্গীত শিখুক। শুদ্ধ নজরুলসঙ্গীতের চর্চা করুক। নজরুলের গানের আদি সুর ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র।
×