ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

বিশ্বকাপ ফুটবল ॥ সুন্দরের মাঝে কুৎসিত চিত্র

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ১৩ জুলাই ২০১৮

বিশ্বকাপ ফুটবল ॥ সুন্দরের মাঝে কুৎসিত চিত্র

বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। দু’শ’রও বেশি দেশে ২৫ কোটি খেলোয়াড় এই খেলায় অংশ নিয়ে থাকে। ধারণা করা হয়, প্রাচীন চীনের হান রাজবংশের সময় কুজু নামে যে খেলা হতো তা থেকে ফুটবলের উৎপত্তি। তবে ফুটবলের যে আধুনিক রূপটা আমরা দেখে থাকি তা প্রথম খেলা হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ডে। আরও ৪ বছর অন্তর বিশ্বকাপ ফুটবলের জমজমাট আসরটির যাত্রা শুরু ১৯৩০ সালে যদিও মাঝখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তা বন্ধ ছিল। এত যে জনপ্রিয় ও সুন্দর একটি খেলা এবং এই খেলা নিয়ে ৪ বছর পর পর জাঁকজমক ও জমাট এক প্রতিযোগিতা এর আবার কদর্ম, কুৎসিত দিকও আছে। তিন বছর আগে মার্কিন বিচার বিভাগের নেতৃত্বে একটি তদন্ত বোর্ডের উদ্যোগে সুইজারল্যান্ডের পুলিশ ভোরে জুরিখে হানা দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিষ্ঠান ফিফার বেশ কয়েক কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে। অভিযোগ তারা লাখ লাখ ডলারের ঘুষ আদান প্রদান করছিলেন। এই সংক্রান্ত মামলায় ফিফার দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট সেপ ব্ল্যাটারসহ আজ অবধি প্রায় ৪ ডজন স্পর্শ করা যেত না এমন অনেক ফুটবল প্রশাসক বা কর্মকর্তার এই খেলার সঙ্গে সম্পৃক্ততা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর অগণিত ফুটবলপ্রেমিক এই রূঢ় নিরানন্দ তথ্যটি জেনে মর্মাহত হয়েছেন যে, তাদের অতি ভালবাসার খেলা ফুটবলে লাগামহীন দুর্নীতি এসে ঢুকে একে কলঙ্কিত করে ফেলেছে। এবারের বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ যে রাশিয়া ২০১০ সালে তাকে আয়োজক হতে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর আজও মেলেনি। নিলামের প্রক্রিয়ায় রাশিয়ার তরফ থেকে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছিল এমন অভিযোগও ওঠে। ফিফা এ নিয়ে তদন্ত চালাতে গেলে রাশিয়ার নিলাম টিম জানায় যে ভোটাভুটির পর তাদের কম্পিউটারের তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে। তখন ফিফা রাশিয়াকে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় এই যুক্তিতে যে প্রমাণ যখন নেই তখন রাশিয়ার দিক থেকে কোন অপরাধও হয়নি। ফিফা যেভাবে এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। আয়োজক হওয়ার প্রক্রিয়ায় রাশিয়া দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিল এমন সমালোচকদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েই যেন প্রেসিডেন্ট পুতিন গত শরতে প্রকাশ্যে ব্লাটারকে এবারের টুর্নমেন্টে ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অথচ ফুটবলের যে কোন প্রতিযোগিতায় উপস্থিত থাকার ব্যাপারে ২০১৮ সালে ফিফা ব্লাটারের ওপর ৬ বছরের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। ব্লাটার রুশ নেতার এই আমন্ত্রণ গ্রহণে এতটুকু সময় নষ্ট করেননি এবং সর্বশেষ খবরে জানা গেছে ব্লাটার এবারের টুর্নামেন্টে উপস্থিত থেকেছেন। ফিফার বর্তমান প্রেসিডেন্ট গিয়ানি ইনফানটিনোর বিরুদ্ধেও ইতোমধ্যে দু-দুটি নৈতিক অভিযোগ উঠেছে। ফিফা ইতোমধ্যে বেশকিছু সংস্কার বাস্তবায়নের দাবি করলেও সংস্থার অভ্যন্তরে সুগভীর দুর্নীতির সংস্কৃতি মোকাবেলায় সেগুলো এতই অপর্যাপ্ত যে ওগুলো তামশার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। গত ১৩ জুন ফিফা ২০২৬ সালের বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ মরক্কোকে হতে না দিয়ে যৌথভাবে মেক্সিকো, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রকে হতে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমন প্রকাশ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে আরেক জনসংযোগ বিপর্যয় হয়ত এড়ানো গেছে। কিন্তু জুরিখের গ্রেফতার ঘটনার তিন বছর পর এখনও এমন সব তথ্য ও খবরা-খবর পাওয়া যাচ্ছে যা থেকে বলা যায় ফিফা সেই আগের ফিফাই রয়ে গেছেÑ বদলায়নি। বিশ্বকাপ ফুটবলের জন্য এটা যে কত লজ্জার ও কলঙ্কের তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজক দেশের জন্য এক বিশাল ব্যবসা ও মুনাফার ব্যাপার। শুধু রাশিয়া নয়, সব দেশের ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। বিশ্বকাপ দেখার জন্য দশ লাখেরও বেশি বিদেশীর আগমন ঘটেছে রাশিয়ায়। এ জন্য ভিসা পদ্ধতিও সহজতর করা হয়েছে। টিকেটের বৃহত্তম ক্রেতা দেশ আমেরিকা। এর জন্য অবকাঠামো, নতুন কয়েকটি স্টেডিয়াম, প্রশস্ত ফুটপাথ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তৈরির পেছনে প্রায় ১১০০ কোটি ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে। অর্থ খরচের ব্যাপারে ব্যাপক ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ আছে। তবে ২০১৪ সালে রাশিয়ার সোচি অলিম্পিকে ৫০০০ কোটি ডলার ব্যয়ের সময় ঘুষ-দুর্নীতি যে ব্যাপক পর্যায়ে পৌঁছেছিল এবার অবশ্য অতটা হয়নি। রাশিয়ার যেসব শহরে এই প্রতিযোগিতা হচ্ছে সেগুলোতে প্রায় সর্বজনীন ওয়াই-ফাই কভারেজ আছে। পথে পথে খোলা হয়েছে অজস্র বিয়ারের পানশালা। ইংরেজী বলতে পারে এমনি অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক রিক্রুট করা হয়েছে। ট্যাক্সি চালকদেরও ইংরেজীতে কথা বলার দক্ষতা ঝালিয়ে নিতে উৎসাহিত করা হয়েছে। এমনকি ট্রেনের বিষদ বদনের কন্ডাক্টরদের যাত্রীদের সামনে স্মিথ চেহারা নিয়ে হাজির হতে শেখানো হয়েছে। রাশিয়ার বিশ্বকাপ আয়োজন দীর্ঘমেয়াদী বিচারে দেশটির জন্য নিট লাভ বয়ে আনবে। কারণ অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর রুশ অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করতে পারার সম্ভাবনা আছে। তবে এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যে ধরনের দুর্নীতি, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার কাজ করেছে তাতে টুর্নামেন্টের সৌন্দর্য যে ম্লান হচ্ছে এবং এই সুন্দর প্রতিযোগিতার কদর্য দিক যে উন্মোচিত হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। বিশ্বকাপ আয়োজনে রাশিয়ার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং তাতে ফায়দা লোটার চেষ্টা যে কাজ করেনি তা নয়। স্বাগতিক দেশ হওয়া রাশিয়ার সামনে একাধিক রাজনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করেছে। রাশিয়া বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে যেÑ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে দেশটির কত উন্নতি হয়েছে, তার অর্থনীতি কত বিভিন্নমুখী রূপ ধারণ করেছে, তার অবকাঠামো ও সংস্কৃতির কত প্রসার ঘটেছে। তবে এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না যে ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক উত্তেজনা এবং রাশিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অব্যাহত অভিযোগের পটভূমিতে এই টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সে জন্যই সম্ভবত ফুটবপ্রেমীদের আগমনের সময় থেকে রাশিয়ার সিনেমা হলগুলোতে ‘লেটো’ নামে এক নতুন ছবি দেখানো হচ্ছে যেটির পরিচালক কিবিল সেরেব্রেনিকভ যাকে দুর্নীতির বানোয়াট অভিযোগে প্রায় এক বছর গৃহবন্দী রাখা হয়েছিল। পুতিন বিরোধী বিক্ষোভের জন্য রাশিয়ার শীর্ষ বিরোধীদলীয় রাজনীতিক আলেক্সি নাভালনিকে গত মাসে জেল দেয়া হয়েছিল। তাকে এই প্রতিযোগিতার সময় ছেড়ে দেয়ার কথা। যত কিছুই করা হোক না কেন, রাশিয়া যে এবারের আয়োজকের আসনটি চুরি করেছিল সেই কলঙ্ক কিন্তু কিছুতেই মোছা যাচ্ছে না। এবারের বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ হতে ব্রিটেন অতিমাত্রায় ব্যগ্র ছিল। ১৯৬৬ সালের পর থেকে ইংল্যান্ডের মাটিতে বিশ্বকাপ হয়নি। দেশটির ফুটবলপাগল মানুষও চেয়েছিল ২০১৮ সালে বিশ্বকাপ তাদের দেশে হোক। নিলামে ব্রিটিশ সরকার যে ডাক দিয়েছিল তা ছিল মোট খরচের চেয়েও বেশি। বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তি ও কর্পোরেশন ছাড়াও প্রিন্স উইলিয়াম, ডেভিড বেকহাম ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন ব্যক্তিগতভাবে ব্রিটেনের এই উদ্যোগের পেছনে সমর্থন দিয়েছিল। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের তুলনায় রাশিয়ার এই টুর্নামেন্ট আয়োজনের যোগ্যতা ছিল অনেক কম। রাশিয়ার ফুটবলের ঐতিহ্যও আহামরি কিছুই ছিল না। দেশটির ফুটবল দল ২০১০ সালে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারেনি সেøাভেনিয়ার কাছে হেরে যাওয়ার কারণে। আরও বড় কথা দেশটিতে পর্যাপ্ত সংখ্যক স্টেডিয়াম ও অন্যান্য অবকাঠামোও ছিল না। দেশটা কি করে এত বড় আসরের আয়োজন করবে তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। ফিফা রাশিয়ার আয়োজক হওয়ার চেষ্টাকে বিভিন্ন বিবেচনায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পুতিন নিজের ও দেশের শক্তিমত্তা ও ক্ষমতাকে জাহির করার একটা উপায় হিসেবে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে চেয়েছিলেন এবং যে কোন মূল্যে এই সংক্রান্ত ভোটে জয়ী হতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তার জন্য পরবর্তী কয়েক মাস তিনি ভোটের বিনিময়ে বিভিন্ন দেশকে সস্তায় গ্যাস বিক্রির চুক্তি করেন, ফিফা ভোটারদের দামী দামী শিল্পকলা উপহার দেন এবং ফিফার প্রেসিডেন্ট ব্লাটারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য লন্ডনভিত্তিক চেলসি ফুটবল ক্লাবের মালিক বিলিয়নিয়ার রোমান আব্রাহামোভিচকে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠান। এভাবে ফিফাকে দুর্নীতিগ্রস্ত করতে অলিগার্ক ও মাফিয়া ডনদেরও কাজে লাগানো হয়। এফবিআইএর ইউরেশিয়ান অর্গানাইজড ক্রাইম স্কোয়াড পরে এ নিয়ে তদন্ত চালাতে গিয়ে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ে। ফিফার অভ্যন্তরে কয়েক দশক ধরে যে সুগভীর পচন ধরে ছিল এবং দুর্নীতির রাহুগ্রাসে পড়েছিল সংস্থাটি তা তদন্তে উন্মোচিত হয়ে যায়। দেখা যায় যে এই সুন্দর জনপ্রিয় খেলাটি সুসংগঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ সিন্ডিকেটের বিশাল মুনাফার উৎসে পরিণত হয়েছে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট/টাইম/ইন্টারনেট
×