ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১৩ জুলাই ২০১৮

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

(গত শুক্রবারের পর) স্ত্রী ও স্বামী দৈহিকভাবে আলাদা দুটি সত্তা হলেও তারা দুইয়ে মিলে এক আত্মা- এই চেতনা দান করেছেন প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : এবং তাঁর (আল্লাহ্র) নির্দেশনাবলীর মধ্যে রয়েছে : তিনি তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গিনীদের যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং (আল্লাহ) তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন, (সূরা রুম : আয়াত ২১)। তিনিই (আল্লাহ্) তোমাদের এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন ও তা থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন যাতে সে তার নিকট শান্তি পায় (সূরা আ’রাফ : আয়াত ১৮৯)। এই দু’খানি আয়াতে কারিমাতে বলা হয়েছে যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন যাতে করে সুখী দাম্পত্য জীবন গড়ে ওঠে এবং পারস্পরিক সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় হয়। এতে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক এবং পরস্পরের প্রীতি বন্ধন যত মজবুত হবে দাম্পত্য জীবন তত সুখী-সুন্দর হবে। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের পূর্বে নারীকে মনে করা হতো পাপের মূল উৎস এবং কোন কোন ধর্মে তো বলাই হয়েছে নারী হচ্ছে শয়তানের ফাঁদ। আর প্রিয়নবী (সা.) এসে ঘোষণা করলেন যে, তারা পরস্পর পরস্পর থেকে। সংসার জীবনে নারী-পুরুষের মর্যাদা একই রকম। গৃহে স্ত্রীর অবস্থান একজন সম্রাজ্ঞীর মতো। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : তোমাদের সবাই এক একজন শাসক (রা’ঈ) এবং প্রত্যেকেই তার নিয়ন্ত্রণাধীনদের (রা’য়ত) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। আমীর (রাজা) হচ্ছে দেশের শাসক আর পুরুষ হচ্ছে পরিবারের শাসক। নারী হচ্ছে তার স্বামী ও সন্তানদের শাসক, সুতরাং তোমরা প্রত্যেকেই শাসনকর্তা এবং প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে (বিচার দিনে) তোমাদের নিয়ন্ত্রণাধীনদের সম্পর্কে (বুখারী শরীফ)। স্ত্রী-পুরুষের শাদি বন্ধনের বেলায় স্ত্রীর অধিকার নিশ্চিত করা, সম্মতি গ্রহণ করা এবং মহ্র প্রভৃতি বিষয় যেমন স্থির করে দেয়া হয়েছে, তেমনি কোন কারণবশত বিবাহ বিচ্ছেদের বা তালাকের অবস্থা সৃষ্টি হলে সেক্ষেত্রে উভয়ের অধিকার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। তালাককে বিশেষ জটিল অবস্থার প্রেক্ষিতে বৈধ করা হলেও এই অবস্থার সৃষ্টি যাতে না হয় সে জন্য প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন : একটি জিনিস আইনসম্মত হলেও আল্লাহ্্ পছন্দ করেন না তা হচ্ছে তালাক। (আবূ দাউদ)। কুরআন মজীদে তালাককে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : তোমরা যদি তাদের (স্ত্রীদের) অপসন্দ কর তবে এমনটা হতে পারে যে, আল্লাহ্্ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন তোমরা তাকেই অপছন্দ করছ। (সূরা নিসা : আয়াত ১৯)। তালাক এড়ানোর পরামর্শ দিয়ে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তাদের (স্বামী-স্ত্রীর) উভয়ের মধ্যে বিরোধ আশঙ্কা করলে তোমরা তার (স্বামীর) পরিবার হতে একজন এবং তার (স্ত্রীর) পরিবার হতে একজন সালিশ নিযুক্ত করবে, তারা উভয়েই নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ্্ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন। (সূরা নিসা : আয়াত ৩৫)। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নারীকে মাতা হিসেবে তার মর্যাদা সমুন্নত করেছেন। এক সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন : কার খিদমত করা আমার কর্তব্য? প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন : তোমার মাতার। সাহাবী বললেন, তারপর? প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমার মাতার। সাহাবী আবার জিজ্ঞাসা করলেন : তারপর? প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন : তোমার মাতার। সাহাবী আবার বললেন, তারপর? প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন; তোমার পিতার এবং তারপর পর্যায়ক্রমে তোমার আত্মীয়স্বজনের। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, তিরমিযী শরীফ, আবূ দাউদ)। এক তরুণ সাহাবী প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের দরবারে এসে জিহাদে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলে প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন : তোমার মা আছেন? সাহাবী বললেন : জি, হ্যাঁ। তখন প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন : যাও, মায়ের খিদমত কর গিয়ে। নিশ্চয় তোমার মায়ের পদতলেই তোমার জান্নাত। (আহমাদ, নাসাঈ, বায়হাকী)। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের পূর্বে নারীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করার কোন ন্যায়সঙ্গত নীতিমালা ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে বঞ্চিত হতো। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামই সর্বপ্রথম নারীকে পুরুষের সহশরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন এবং মৃতের সম্পত্তির হিস্যাদার হিসেবে তার অধিকার নিশ্চিত করলেন। তিনি উত্তরাধিকারী বিষয়ক যে বিধিবিধান প্রদান করলেন তাতে অগ্রগণ্য যে বারোজন উত্তরাধিকারী স্থির করা আছে তার মধ্যে আট জনই হলো নারী। কুরআন মজীদে মৃতের সম্পত্তিতে নারীর অধিকার সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে : পিতা-মাতা এবং আত্মীয়স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছে, তা অল্পই হোক অথবা বেশিই হোক, এক নির্ধারিত অংশ (সূরা নিসা : আয়াত ৭)। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম যে ব্যবস্থা দিলেন তাতে নারী পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হলো। শুধু তাই নয়, সে সন্তানের সম্পত্তিরও উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করেছে। সে উত্তরাধিকারী সূত্রে সে সম্পত্তি পায় তার ওপর তার স্বত্বাধিকারিত্ব অটুট থাকে। তার মৃত্যুর পর সে সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করে তার ওয়ারিশগণ। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নারীর যে অধিকার নিশ্চিত করলেন তাতে তার উপার্জন করার অধিকারও দেয়া হয়েছে। নারী-পুরুষ আল্লাহ জাল্লা শানুহুর কুদ্্রতের এক অপূর্ব নিদর্শন। তিনি প্রতিটি জিনিস জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করার মাধ্যমে সৃষ্টি জগতের অব্যাহত গতি নির্ধারিত করে দিয়েছেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আমি প্রত্যেক বস্তু সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায়, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। (সূরা যারিয়াত : আয়াত ৪৯)। আরও ইরশাদ হয়েছে : পবিত্র ও মহান তিনি, যিনি উদ্ভিদ, মানুষ এবং ওরা যাদেরকে জানে না তাদের প্রত্যেককেই সৃষ্টি করেছেন জোড়া জোড়া করে। (সূরা ইয়াসিন : আয়াত ৩৬)। এই আয়াতে কারিমা দু’খানিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক জিনিস আল্লাহ জাল্লা শানুহু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। নারী-পুরুষ সেই জোড়ারই অন্তর্গত। মানবসন্তান সেই জোড়ারই ফসল। কুরআন মজীদে তো স্ত্রীদের সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে : তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের শস্যক্ষেত্র। (সূরা বাকারা : আয়াত ২২৩)। নারী ও পুরুষের মধ্যে দেহগত ও মনোগত পার্থক্য থাকলেও মানবিক সত্তার দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করলে এই পার্থক্য মুখ্য হয়ে ওঠে না। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অবদান রাখার অধিকার যেমন নারীকে দিয়েছেন তেমনি তাকে মর্যাদা দান করেছেন। সমাজ সংসার যে নর-নারীর সম্মিলিত প্রয়াসেই গড়ে ওঠে তার শিক্ষা তিনি সুস্পষ্টভাবে দিয়েছেন। তিনি আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষ উভয়েরই অবদান রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন, উপার্জন ক্ষেত্রে নারীর অধিকারও সুদৃঢ় করেছেন। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ এবং নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ। (সূরা নিসা : আয়াত ৩২)। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের দরবারে অধিকাংশ সময় পুরুষদের ভিড় থাকত, যে কারণে স্ত্রীলোকদের সেখানে আসা সম্ভব হতো না। ফলে তাঁর কাছ থেকে তাদের সমস্যার সমাধান গ্রহণ করা ও শিক্ষা লাভ করার সুযোগ হতো না। তারা তাদের এই অসুবিধার কথা প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে জানালে মহিলাদের জন্য তিনি নির্দিষ্ট দিন স্থির করে দেন, ফলে মহিলাদের জন্য তাঁর কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ করা ও শিক্ষা লাভ করার সুযোগ এসে যায়। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বিদ্যা অর্জনের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। নারী-পুরুষ উভয়কেই বিদ্যা হাসিল করার জোর তাকিদ দিয়ে তিনি বলেছেন : বিদ্যা অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর অবশ্য কর্তব্য। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নারীদের সঙ্গে অত্যন্ত নরম ব্যবহার করতে নির্দেশ দিলেন। একবার সস্ত্রীক তিনি সফরে ছিলেন। তিনি যে উটের কাফেলায় এই সফর করছিলেন সেই কাফেলার অগ্রভাগে আন্্জশা নামে এক কাফ্রী গোলাম উটগুলোর চলার গতি বাড়াবার জন্য দরাজ কণ্ঠে উট চালানো গীত গাইছিল। উটগুলো অতি দ্রুতগতিতে অগ্রসর হওয়ায় ঝাঁকুনিতে কাফেলার মহিলাদের ভীষণ অসুবিধা হচ্ছিল। তখন তিনি আন্্জশাকে ডেকে বললেন : কাঁচ যাতে ভেঙ্গে না যায়, আন্্জশা তুমি সেদিকে খেয়াল রেখ। এই কাঁচ বলতে প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নারীগণকে বুঝিয়েছেন। কুরআন মজীদে নারী-পুরুষ উভয়কেই পরিশ্রমী ও কর্মনিষ্ঠ হওয়ার তাকিদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আমি তোমাদের মধ্যে কোন কর্মনিষ্ঠ নর অথবা নারীর কর্ম বিফল করি না। তোমরা একে অপরের অংশ (সূরা আল ইমরান : আয়াত ১৯৫)। এই আয়াতে কারিমায় আরও লক্ষ্য করা যায় যে, এখানে নারী ও পুরুষকে বলা হয়েছে বা’দুকুম্ মিম্ বা’দি- অর্থাৎ তোমরা একে অপরের অংশ। এর দ্বারা নারীর অধিকার ও মর্যাদা পুরুষের সমান অবস্থানে অধিক্ষিত করা হয়েছে। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নারীর যথাযথ মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন, ফলে মানবিক মূল্যবোধের সামগ্রিক সৌকর্য জোরদার বুনিয়াদ লাভ করেছে। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আদর্শই সর্বকালের মানুষের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। তাঁর আদর্শ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল বিশ্বশান্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে। (সমাপ্ত) লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ
×