ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বদলে যাচ্ছে গ্রাম

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৩ জুলাই ২০১৮

বদলে যাচ্ছে গ্রাম

ওয়াজেদ হীরা ॥ শহরের আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে গ্রাম। শহরের সুবিধা পৌঁছে যাচ্ছে গ্রামেও। বদলে গেছে গ্রামীণ জীবন। পুরুষদের পাশাপাশি স্বাবলম্বী এখন গ্রামের নারীও। গ্রামে মাটির ঘর খুব একটা নেই বললেই চলে। অধিকাংশ গ্রামেই দেখা মেলে পাকা বা আধাপাকা বাড়ি। সরকারের স্থায়িত্বে উন্নয়নের সুফল প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে আর ক্রমশ বদলে যাচ্ছে সবকিছু। ভূমিহীন-গৃহহীনরা সরকারের দেয়া বিনা পয়সায় ঘর পাচ্ছে। স্বল্পসুদে বা বিনাসুদে ঋণ নিয়ে পুরুষের পাশাপাশি নানা ধরনের আয়বর্ধক কাজে জড়িত হচ্ছে নারী। এতে সংসারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন হচ্ছে তেমনিভাবে পাল্টে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি। বিশিষ্টজনরা মনে করছেন, শেখ হাসিনা সরকারের গৃহীত নানা প্রকল্পের কারণেই গ্রামীণ অর্থনীতিতে পরিবর্তন এসেছে। এ জন্যই শেখ হাসিনার সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছেন অনেকেই। জানা গেছে, গ্রামীণ অর্থনীতিতে পরিবর্তন তথা দেশের মানুষের উন্নয়নে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সেবা দেয়া হচ্ছে। প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে সেই সেবাকার্যক্রম। দেশের গৃহহীন পরিবারদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ঘর করে দেয়া হচ্ছে। ‘একটি বাড়ি একটি খামারে’র সদস্য হয়ে সংসারে সচ্ছলতা ফেরাচ্ছে অনেকেই। শুধু তাই নয় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়সের ফলে ঐসব এলাকার রাস্তাঘাট পরিবর্তন হচ্ছে। এলাকার ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাতায়াতও হচ্ছে শতভাগ। এতে অজপাড়াগাঁও শব্দটি আর থাকছে না। পরিবর্তনের ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে সবকিছুই। পালাবদল ঘটেছে গ্রামীণ অবকাঠামোতে, খাদ্যের প্রাপ্যতায়, জীবনযাত্রার মানে, যোগাযোগ ব্যবস্থায়, শিক্ষায় ও স্বাস্থ্যে। কুঁড়েঘরের জায়গায় এসেছে টিনের ঘর। শুধু কৃষিকাজ নয়, গ্রামের মানুষ এখন বহু ধরনের পেশায় নিজেদের যুক্ত করে জীবন বদলে নিচ্ছে। ময়মনসিংহের শিল্প এলাকা ভালুকা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ‘ইন্তারঘাট’। বছরের পর বছর ধরে অবহেলিত এই গ্রামে সম্প্রতি ১০ কি.মি. একটি পাকা রাস্তার কারণে বদলে গেছে গোটা গ্রামের চিত্র। মল্লিকবাড়ি থেকে দেবরাজ পর্যন্ত ১০ কি. মি এই রাস্তা হওয়ায় শুধু ইন্তারঘাট নয় উপকৃত হয়েছে সোনাখালি, ছিটাল, আউলিয়ারচালা গ্রামের কয়েক হাজার পরিবার। বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি নানামুখী কর্মে নিয়োজিত এলাকার নারীরাও। এসব গ্রামের উৎপাদিত নানা পণ্য নিয়ে সহজেই যাতায়াত করছেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে যেমন গতি এসেছে তেমনি অর্থনৈতিক উন্নয়নও হচ্ছে। দারিদ্র্য জয় করে প্রতিটি পরিবার এখন উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখেন। অথচ কয়েক বছর আগেও কাঁচা রাস্তার কারণে এলাকার মানুষ বেকার সময় কাটাতেন। বিশেষ করে বর্ষাকালে হাঁটুসমান কাদায় পরিণত হতো রাস্তাটি। এখন এলাকার প্রতিটি মানুষের আয় বেড়েছে। আর্থ-সামাজিক অবস্থাও বদলে গেছে। বাচ্চাদের উন্নতমানের স্কুলে পড়াশোনা এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দ্রুতই উপজেলাসহ অন্যান্য জায়গায় যেতে পারছেন গ্রামের মানুষ। এই গ্রামের বাসিন্দা মুজিবুল হক এক সময় অন্যের জমিতে শ্রম দিলেও এখন দোচালা টিনের বাড়ি করেছেন। নিজের করা সবজি বাগানের উৎপাদিত পণ্য প্রতিদিন বিক্রি করে বেশ সচ্ছল তিনি। একই গ্রামে বাজারে একটি মুদি দোকান করেন রুস্তম (৪৫)। তিনি বলেন, তিন বছর আগে দৈনিক বিক্রি হতো ১০০-১৫০ টাকা আর এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হওয়ায় দৈনিক বিক্রি ৫০০-৭০০ টাকা। ইন্তারঘাট গ্রামের সবুর উদ্দিন বলেন, এলাকার উন্নয়ন তথা রাস্তাঘাটের জন্য মানুষের নানা ধরনের কাজ বেড়েছে। এতে আয়ও বেড়েছে। নানা ধরনের আয়বর্ধক কাজে জড়িত হয়ে সবাই এখন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল। এলাকা সূত্রে গেছে, রাস্তা ভাল হওয়ায় এলাকার অধিকাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। যারা অন্যের জমিতে কাজ করতেন তাদের অনেকেই ছোটখাটো ব্যবসা বা বিভিন্ন ধরনের ফসল আবাদ করছেন। কেউ কেউ অটোরিক্সা বা ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল চালিয়েও জীবিকা নির্বাহ করছেন। সন্ধ্যার পর এসব এলকা ছিল ‘ঘুমন্ত গ্রাম’। আর এখন এসব গ্রামের মানুষ এখন রাত দশটারও বেশি সময় পর্যন্ত বাজারে বসে টেলিভিশন দেখেন। চায়ের দোকানে আড্ডা আর গল্পে মেতে ওঠেন। ছিটাল গ্রামের চা বিক্রেতা সোরহার বলেন, আগে এলাকার মানুষই খুব একটা দোকানে আসত না। আর বর্ষায় তো কোন মানুষ সহজে ঘর থেকে বের হয়নি। আর এখন অন্য এলাকার মানুষ এসেও আড্ডা দেয়। সড়ক ভাল হওয়ায় রাত আর দিন নেই সবই সমান। আমারও ইনকাম বাড়ছে। বাড়িতে নতুন টিনের ঘর দিছি। এদিকে, গ্রামের মহিলারা গরু, ছাগল লালনপালনের পাশাপাশি বাড়ির পাশে নানা ধরনের সবজির বাগান করেছেন। একসময় ধান আর আখ ছাড়া এসব এলাকায় যাতায়াতের সঙ্কটের জন্য অন্য ফসল আবাদ করত না কেউ। আর বর্তমানে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই সবজির বাগান হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে করলা, শসা, লাউ, কুমড়া, বেগুন উৎপাদিত হচ্ছে এবং উৎপাদিত পণ্য দ্রুতই উপজেলাসহ রাজধানীতেও পাঠাতে পারছেন। যাদের মাটির ঘর ছিল অর্থনৈতিক সচ্ছলতায় তারা এখন আরও ভালমানের ঘর তৈরি করছেন। আওলিয়ারচালা গ্রামের শরিফা বেগম বলেন, লাউ আর লালশাক করেছিলাম বিক্রির জন্য। একদিনও বাজারে যেতে হয়নি। পাইকাররা (পাইকারি ক্রেতা) আমার ক্ষেত থেকেই সব নিয়া যায়। পাশের দেবরজা গ্রামের বেকার ছেলে আসলাম মিয়া এখন মোটরসাইকেল ভাড়ায় চালিয়ে দৈনিক আয় করেন ৬০০-৮০০ টাকা। জনকণ্ঠকে বলেন, একটি রাস্তার কারণে আমরা কোন দিকেই বের হতে পারতাম না। এখন যাতায়াত যেমন সহজ হইছে আমাদের অনেকের আয়ের পথও খুলছে। এজন্য সরকারের সুনামও করেন তিনি। এই সকল গ্রামের মতো দেশের অসংখ্য গ্রাম বদলে গেছে। গত কয়েক বছরে কোন কোন গ্রাম বদলে গেছে রাস্তাঘাট হওয়ার কারণে আবার কোনটি বিদু্যুতের সংযোগ পেয়ে। আবার কোন গ্রাম বিভিন্নভাবে পুঁজি পেয়ে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এনেছে। ভালুকা উপজেলার পাশের উপজেলা সখীপুর। লালমাটির বিখ্যাত টাঙ্গাইলের এই উপজেলার প্রান্তিক পর্যায়ের গ্রাম কালমেঘা। বিদ্যুত কিংবা পাকা সড়ক ছিল স্বপ্নের চেয়েও বেশি কিছু এসব এলাকার মানুষের। আশপাশ এলাকার গ্রামে যাতায়াতের ভাল রাস্তা না থাকায় কেউ যেতেও পারত না অন্য গ্রামের কেউ আসতও না। বর্তমানে রাত জেগে বিদ্যুতের আলোয় পড়াশোনা হচ্ছে প্রতিটি ঘরেই। কালমেঘার স্থানীয় বাসিন্দা রুবেল সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের এলাকার ক্রমেই উন্নতি হচ্ছে। মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আসছে। অথচ রাস্তাঘাট বিদুুত সংযোগ পাওয়ার আগে এসব চিন্তাই করিনি। এলাকার অন্যান্য বাসিন্দা বলেন, এখন অনেকেই এলাকায় এসে নানা ধরনের প্রজেক্ট করতে চাচ্ছে। এতে করে অনেকের কর্মসংস্থান হবে। একই উপজেলার কুতবপুর গ্রাম বিদু্যুতের আলোয় আলোকিত। রাস্তাঘাট আগে থেকেই ভাল থাকলেও অন্ধকারে ছিল এলাকা। সম্প্রতি বিদ্যুতের একটি সাবস্টেশন হওয়ায় গোটা গ্রাম আলোকিত। এলাকার যুবকরা বেশিরভাগ সময় বিদ্যুত পাওয়ার করণে কেউ কেউ পোল্ট্রি বা গরুর খামার করছেন। গ্রামের বাসিন্দা নিয়াজ হাসান বলেন, আমরা বিভিন্ন ধরনের রাইস মিল করেছি। অনেকেই খামার করেছেন। যোগাযোগ ভাল ছিল তবে বিদ্যুত থাকত না, এখন সেই চিন্তা নেই। গ্রামের উন্নয়নে নজর দেয়ার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানান এলাকার একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা। গত কয়েক মাসে একাধিক গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে গ্রামীণ জীবনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দৃশ্য। শুধু মধ্যাঞ্চলই নয় রাজশাহী, রংপুরের বিভিন্ন গ্রামেও দেখা গেছে উন্নয়নের চিত্র। গ্রামের রাস্তাঘাট আর খুব একটা কাঁচা নেই। অনেক গ্রামেই পৌঁছে গেছে বিদ্যুত। অনেক গ্রামেই বেশিরভাগ পাকা বাড়ি। গ্রামের বাসিন্দারা স্থানীয় বাজারসহ রাজধানীতে যোগাযোগ করে দ্রুতই উৎপাদিত নানা ধরনের ফসল সরবরাহ করতে পারছেন। অসুখ-বিসুখে হাসপাতালে যেতে পারছেন। বাচ্চাদের জন্য ভাল শিক্ষার ব্যবস্থা হচ্ছে। সরকার গ্রামীণ জীবনের উন্নয়নে নানা ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন অনেক গ্রাম যেভাবে বদলে গেছে এটা সরকার গৃহীত পদক্ষেপের ফল। আগামী কয়েক বছরে বড় পরিবর্তন হবে বলেও সংশ্লিষ্টদের মত। বাংলাদেশের প্রথম খানা আয়-ব্যয় জরিপ হয়েছিল ১৯৭৩-৭৪ সালে। ওই জরিপে দেখা যায়, তখন গ্রামের একেকটি খানার (পরিবার) মাসিক গড় আয় ছিল ৪৬৪ টাকা। ২০১০ সালের সর্বশেষ জরিপে দেখা যায়, সেই গড় আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৬৪৮ টাকায়। তখন একটি পরিবার যে আয় করত, এখন তার ২১ গুণ বেশি আয় করে। সেই আয় দিয়ে মানুষ এখন শুধু তার খাদ্য চাহিদাই নয়, অন্য অনেক চাহিদাও পূরণ করছে। এদিকে সরকার অসহায়দের ঘর তৈরি করে দিয়ে ভাল মানের জীবন যাপন করার সুযোগ দিচ্ছেন। ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়ার কালাদহ ইউনিয়নের পাটিরা উত্তরপাড়ার ৮৫ বছরের বৃদ্ধ রুস্তম আলী সরকারের সহায়তায় পাকা মেঝের ঘরে থাকেন তিনি। সরকারের করে দেয়া ঘর পেয়ে আবেগে চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে। ঘর নিয়ে তিনি বলেন, ‘রাইতে ঘুমের কি আরাম, বিশ বছর ধইরা কবার পাইতাম না। শীতের দিন কষ্টের শ্যাস নাই, ঘরের মধ্যেই ঊস্ (কুয়াশা) পড়ত, বাতাসে থাকবার পাইতাম না। জীবনেও ভাববার পাইছি না টিনের ঘরে থাকমু, মরার আগে আল্লায় (আল্লাহ) রহমত করছে। সরকার টিনের ঘর কইরা দেয়ায় শেষ বয়সে আরাম-আয়েশে ঘরে থাইক্কা যাবার পামু। ’ সম্প্রতি ফুলবাড়ীয়া উপজেলার ১৩ টি ইউনিয়নের এক কোটি ২১ লাখ টাকায় ১২১ ভিক্ষুককে বিনামূল্যে বাসস্থান করে দিয়েছে সরকার। ফুলবাড়িয়ার মতো দেশের অনেক জায়গায় ভূমিহীন বা জমি আছে, ঘর নেই এমন মানুষের ঘর তৈরি করে দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি ঘর পেয়েছেন গাজীপুরের কাপাসিয়ার ফেটালিয়া গ্রামের বিধবা আমেনা খাতুন। ৯ বছর আগে স্বামী হারানো এই নারী একটি খুপরি ঘরে চার মেয়েকে নিয়ে নানা আতঙ্কে দিন কাটিয়েছেন। সেই আমেনার এখন মেঝে পাকা করা বাড়ি। ঘর নিয়ে আবেগজড়িত কণ্ঠে আমেনা জানান, শেখের বেটি যেন সারাজীবন সব দুঃখীর পাশে থাইকা শান্তিতে দেশ চালাইতে পারেন। কাপাসিয়ার একঢালা গ্রামের ঝালমুড়ি বিক্রেতা আবদুল আজিজও পেয়েছেন বসবাসের ঘর। আমেনা বা আজিজের মতো দেশের বহু গৃহহীন মানুষের জীবন পাল্টে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্ভাবনী উদ্যোগে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় জেলায় ইট-টিন সিমেন্টের এসব ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। সাড়ে ১৬ ফুট দৈর্ঘ্য, সাড়ে ১০ ফুট প্রস্থ ও সাড়ে ৫ ফুট বারান্দার চৌচালা টিনের প্রতিটি ঘরের পাকা ভিটি ও টয়লেটের জন্য খরচ হয়েছে এক লাখ টাকা। আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর তালিকায় দেখা গেছে সারাদেশে বিভিন্ন গ্রামে অসংখ্য মানুষের ঘর করে দিয়েছে সরকার। ‘আশ্রয়ণের অধিকার, শেখ হাসিনার উপহার’ স্লোগানে এগিয়ে চলছে আশ্রয়ণ প্রকল্পটি। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ১ লাখ ৬০ হাজার গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। প্রকল্পের অধীনে গৃহহীন প্রত্যেক পরিবারকে একটি করে ঘর করে দেয়া হয়েছে। ২১ হাজার ৭৪৫টি পরিবারকে ৩২ কোটি ৫২ লাখ টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। ঋণের টাকায় এসব পরিবার আয়বর্ধক নানা কর্মকা-ের মাধ্যমে নিজেরা স্বাবলম্বী ও দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। ঋণপ্রাপ্ত বিভিন্ন গ্রামের একাধিক নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাপ্ত টাকা দিয়ে তারা কেউ ছাগল-গরু বা হাঁস-মুরগি লালন পালন শুরু করেন। এতে অনেকের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে ঘুরেছে ভাগ্যের চাকা। ময়মনসিংহের রমিজা বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, আমি ছাগল পালন করে এখন সংসারে বাড়তি আয় করতে পারছি। নির্বাচন-ভোট বিষয়ে তেমন জ্ঞান না থাকলেও শেখ হাসিনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ তিনি। গ্রামীণ জীবনের উন্নয়ন নিয়ে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোঃ আইনুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, এই সুফল একটি দীর্ঘমেয়াদী সরকারের সুফলও বটে। কেননা, একটি সরকার পরিবর্তন হলে প্রকল্পও শেষ হয়ে যায় অনেক সময়। আরেকটি হচ্ছে যে সকল প্রান্তিক পর্যায়ে নানা ধরনের সহায়তা দেয়া হচ্ছে এদের কর্মসংস্থান করতে হবে। গ্রামের মানুষের যেন এই সহায়তা পেয়ে নিজেদের ছোটখাট কর্মসংস্থান হয়। এলাকাভিত্তিক বিদ্যুত বা রাস্তাঘাটের যে সমস্যা বিদ্যমান তার সমাধান হলে সেসব এলাকা আরও বদলে যাবে বলে মনে করেন তিনি। আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রকল্প প্রকৌশলী মোঃ এজাজ মোর্শেদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের কেবল একটি করে ঘর করে দেয়া হয়নি, পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের চাহিদামতো কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে পরিবার প্রতি ৩০ হাজার টাকা করে সুদমুক্ত ঋণও দেয়া হয়। এই ঋণ নিয়ে তারা আয়বর্ধক কর্মকা-ে যুক্ত হয়ে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করেন। এজাজ মোর্শেদ জানান, প্রকল্পের তিনটি পর্যায়ে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৮৮১টি প্রকল্পে এলাকায় ১ লাখ ৬০ হাজার গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৮৩৭টি গ্রামে ব্যারাক নির্মাণ করে ১ লাখ ৪৪ হাজার ১২০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে । এছাড়া ‘যার জমি আছে ঘর নাই’ এমন পরিবারকে নিজ জমিতে গৃহনির্মাণ করে পুনর্বাসনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ১৪২টি পরিবার। ৬৯১টি ভিক্ষুক পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। পার্বত্য এলাকায় ৩৮টি বিশেষ ঘর এবং ২০টি টংঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের সকল ছিন্নমূল ও গৃহহীন মানুষকে এই প্রকল্পের আওতায় আনার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। এর অংশ হিসেবে চলমান আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে সরকার নিজস্ব অর্থায়নের মাধ্যমে ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে আড়াই লাখ গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করার পরিকল্পনা করেছে। জানা গেছে, প্রকল্প গ্রামসমূহের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য পরিচর্যা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় স্কুলগামী সকল শিশুর স্কুলে যাওয়া নিশ্চিত করা হচ্ছে। পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্রকল্প এলাকাগুলোতে স্যানিটারি ল্যাট্রিন ও গোসলখানা নির্মাণ করা হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতির এই পরিবর্তনের পেছনে রেমিটেন্স, গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নতি, কৃষির বহুমুখীকরণ ও পোশাক খাতের মতো শ্রমনির্ভর খাত ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা। সরকারের দারিদ্র্য দূরীকরণ তথা গ্রামীণ উন্নয়নে ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প’ বেশ জোরালো ভূমিকা রাখছে। জানা গেছে, ২০২০ সালের মধ্যে দেশে দারিদ্র্যের হার ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে এই প্রকল্পটি ২০০৯ সালে গ্রহণ করা হয়েছে। সমন্বিত গ্রাম উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিটি বাড়িকে অর্থনৈতিক কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াসে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১৬ সালে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত করা হয়। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পটি ৬৪ জেলার ৪৯০ উপজেলার ৪০ হাজার ৯৫০টি গ্রামে বাস্তবায়িত হচ্ছে। একটি বাড়ি একটি খামারে শুরু থেকে মার্চ ২০১৮ পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত পরিবারের সংখ্যা ৩৪ লাখ ১৩ হাজার ৯৬৭ জন। যেখানে ৪৮৪৯.৭৮ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। আদায়কৃত ঋণ ২৬১১.২৬ কোটি টাকা। পারিবারিক বলয়ে গড়ে ওঠা খামারের সংখ্যা ৩৬ লাখ ৫৬ হাজার ৯৯২টি। নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চরমায়াজাল গ্রামের সাত সন্তানের জনক মিশু মিয়া। সমিতির সদস্য হয়ে ঋণ নেন এবং পেয়ারা চাষ শুরু করেন। সরকারের সহায়তা আর নিজের চেষ্টা দুই মিলে গত কয়েক বছরে তিনি এখন সফল মানুষ। সরকারের একটি বাড়ি একটি খামার নিয়ে তিনি বলেন আমার ভাগ্য বদলে গেছে এর মাধ্যমে। একই উপজেলার তিন সন্তানের জননী জেসমিন এখন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। অথচ এক সময় দারিদ্র্যের মধ্যে ডুবে ছিলেন। প্রকল্পের মাধ্যমে সদস্য হয়ে ঋণ নিয়ে শুরু করেন পরিবেশবান্ধব ব্যাগ তৈরির কাজ। আর ফিরে তাকাতে হয়নি। এমন দারিদ্র্যবান্ধব কর্মসূচীর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান ও দোয়া করেন তিনি। এমন অসংখ্য সফলতার চিত্র রয়েছে দেশজুড়ে। ৬০ লাখ পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে দেশব্যাপী ‘একটি বাড়ি, একটি খামার’ প্রকল্প চললেও নতুন করে প্রকল্পে ভিক্ষুক পুনর্বাসন কাজ অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে পাইলট প্রকল্প হিসেবে নীলফামারী জেলার কিশোরীগঞ্জ উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। ফলে ভিক্ষুকমুক্ত হয়েছে উপজেলাটি। উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল কালাম আজাদ মুঠোফোনে জনকণ্ঠকে বলেন, কিশোরীগঞ্জ উপজেলা ভিক্ষুকমুক্ত হয়েছে। আমরা বিভিন্ন সমিতির মাধ্যমে ভাগ করে ৯৭৯ ভিক্ষুককে পুর্নবাসন করেছি। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) আকবর হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা দারিদ্র্য দূর করতে চাই। আর সেকারণেই ভিক্ষুকমুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া। ইতোমধ্যেই আমরা এই বিষয়ে কাজ করেছি এবং বেশ ভাল সাড়াও পেয়েছি। প্রকল্পটির মাধ্যমে ভিক্ষুকদের ট্রেনিং দিয়ে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের সমিতি থেকে ঋণ দেয়া হবে। একটি বাড়ি, একটি খামার প্রকল্প পরিচালক বলেন, এটি প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ইচ্ছা থেকে সৃষ্টি। এই প্রকল্প দারিদ্র্য বিমোচনে মানুষের নিজস্ব স্থায়ী পুঁজি তৈরি করে দেয়। দারিদ্র্য দূর তথা কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনও প্রান্তিক পর্যায়ে নানা ধরনের সহায়তা দিচ্ছে। গ্রামীন জীবন কাঠামো এবং উন্নয়ন নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সিনিয়র গবেষক ড. ফাহমিদা খাতুন জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারী- বেসরকারী কর্মকা- বাড়ছে। গ্রামের চিত্র পাল্টে যাচ্ছে, অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে, নন-ফার্মিং কাজ বাড়ছে, রাস্তাঘাট হচ্ছে এসব ভাল। তবে উন্নয়ন সুষম হচ্ছে না। এলাকাভিত্তিক উন্নয়নে সমতা নেই বলে জানান তিনি। এক্ষেত্রে বিভাজন কমানোর পরামর্শ দিয়ে বলেন, বেসরকার পর্যায়ে আরও অর্থায়ন করা যেতে পারে। গ্রামে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে নয়ত গ্রাম থেকে সবাই শহরমুখী হবে; এতে শহরে সুবিধা বাধাগ্রস্ত হবে। পিছিয়ে থাকা এলাকার উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা আরও জোরালো হওয়া প্রয়োজন বলেও জানান তিনি। এদিকে, সরকারের গ্রামীণ উন্নয়ন তথা প্রান্তিক মানুষের উন্নয়ন নিয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জনকণ্ঠকে বলেন, গ্রামীণ উন্নয়নে সরকারের পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। নানা প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে পারছে এবং তাদের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ হচ্ছে। একটি দীর্ঘ মেয়াদের সরকার যেমন ভূমিকা রাখছে তেমনি গ্রামের মানুষ নানা ধরনের সহায়তা পেয়ে এখন আরও বেশি উদ্যমী হচ্ছে। গত কয়েক বছরে পাল্টে গেছে প্রান্তিক জীবন, পাল্টে গেছে অনেক গ্রাম। বছরে দু’একবার যারা শহর থেকে নিজ গ্রামে ফেরেন বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে উন্নয়নের চিত্র দেখে তারাও অবাক হয়ে যান। সেই সঙ্গে মনের অজান্তেই স্বপ্ন বুনেন শহর ছেড়ে গ্রামে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার।
×