ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মোহসেনা হোসেন ইলোরা

তরুর সারা বেলা

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ১২ জুলাই ২০১৮

তরুর সারা বেলা

ঘুম ভাঙলেও তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা কাটছে না। মোবাইলে আলোটা জ্বেলে তরু দেখে সময় ৪.২৫। যাক আর ১০ মিনিট বিছানায় থাকা যাবে। চোখের পাতাটা বুজে আসে। কিন্তু চোখের পাতা দুটো লাগতে না লাগতেই আজানের ধ্বনি ভেসে এলো। আলসেমি ঝেড়ে উঠে পড়ে তরু। নাহ্ আর শুয়ে থাকা যাবে না। বিছানা ছাড়ার আগেই একপলক দৃষ্টি বুলিয়ে যায় ঘুমন্ত স্বামী রফিক আর টুনির দিকে। আরামে ঘুমাচ্ছে ওরা। ঘুমাক আর কিছুক্ষণ। তাড়াতাড়ি উঠে নামাজ পড়ে কাজে লেগে যায় তরু। সকালের নাশতা, টুনির স্কুুলের টিফিন, রফিকের লাঞ্চ রেডি করতে করতেই টুনিকে ওঠানোর সময় হয়ে যায়। মেয়েটার ঘুম ভাঙতেই চায় না। একেবারে উঠতেই চায় না। ওর মায়াবি ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালে আর ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু উপায় নেই। স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে। টুনিকে ওঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এদিকে রফিকও গভীর ঘুমে অচেতন। নাশতা টেবিলে রেডি করে মেয়েকে নিয়ে যায় বাথরুমে। মুখ ধুইয়ে, ড্রেস পরিয়ে, চুল আচড়ে জোর করে নাশতা খাওয়াতে খাওয়াতেই স্কুলের ব্যাগ টিফিন রেডি করতে করতেই রফিক ফ্রেশ হয়ে যায়। ফ্রেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার চা চাই। নইলে সারাদিনই মাটি। মেয়েকে রেডি করে রফিকের চা দিয়ে নিজে ছুটে বাথরুমে। কোন রকমে মাথায় দুই মগ পানি দিয়েই তৈরি হয়ে নেয়। নিজে চারটা মুখে দেবে সে সময় হাতে নেই, মেয়ের স্কুলের দেরি হয়ে যাবে। কোন রকমে দুটো রুটি ব্যাগে ভরে নেয়। বেরুবার আগে আর একবার দেখে সব ঠিক আছে কিনা? রফিকের লাঞ্চ, পানির বোতলসহ লাঞ্চ বক্সটা রেডি করে বেরুতে যাবে তখনই রফিকের ডাক: Ñ আমার ব্লু শার্টটা তো ইস্ত্রি করোনি? : এখন ইস্ত্রি করতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। আরও শার্ট আছে ইস্ত্রি করা, সেগুলোর একটা দিয়ে চালাও না প্লিজ। Ñ গতকাল থেকেই বলছি আজ মিটিংয়ে এটা পড়ব। আমার কিছুতেই তোমার নজর নেই। থাক লাগবে না। বিরক্ত হয়ে বাথরুমে ঢুকে যায় রফিক। চাপা একটা দীর্ঘশ্বাাস ছেড়ে টুনিকে একটু বসতে বলে তাড়াতাড়ি ইস্ত্রি করতে বসে শার্টটা। তারপর মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে পড়ে। মেয়েকে স্কুল গেটে ঢুকিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, ক্লাসরুমে ঢোকা পর্যন্ত তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে, তারপর রওনা হয় নিজের অফিসের উদ্দেশে। অন্য মায়েরা যেখানে গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসে তরু সেখানে পা বাড়ায় বাস কাউন্টারে। কাউন্টারের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছানোর মুহূর্তেই বাসের আগমন। এখন পুরোপুরি যুদ্ধের প্রস্তুতি কারণ বাসে ভিড় ঠেলে উঠতেই হবে যেভাবেই হোক। না হলে অফিসে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। অফিসে কাজের চাপে ভুলেই যায় সেই কোন ভোরে এক কাপ চা আর একটা টোস্ট ছাড়া পেটে কিছুই পড়েনি। একটু অবসর পেতেই এক কাপ চা আর দুটা বিস্কুট হাতে নেয়। বসের ডাক পড়ে যায়। কিছু আর্জেন্ট রিপোর্ট দিতে হবে। কোন রকমে চা-টা শেষ করে কাজে ডুবে যায় তরু। মেয়েটা কি করছে? ঠিকমতো খেয়েছে কিনা? ঘুমাল কিনা এই সব চিন্তায় ভেতর থেকে ক্ষয়ে যেতে থাকে প্রতিনিয়ত। লাঞ্চের পর থেকেই অস্থিরতা যেন আরও বাড়তে থাকে কখন ৫টা বাজবে। কখন বাসায় যাবে? সেখানে কি হচ্ছে? বাচ্চাটা কি করছে? মেয়েটাও বার বার ফোন করে আবদারের পর আবদার করতে থাকে। ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বাজতেই ছুটে বেরিয়ে আসতে চায় তরু। আবার সেই বাসের জন্য অপেক্ষা। ফেরার পথে দরকারি বাজার বা কোন সদাই কিনতেও ভুল করে না। বাসায় ফিরতে ফিরতে সেই সাতটা সাড়ে সাতটা বেজেই যায়। ঘরে ঢুকতেই গলা জড়িয়ে ধরে মেয়ের কত না অভিযোগ অভিমান আবদার। মেয়েকে কিছুটা সময় দিয়ে আদর আবদার মিটিয়ে পড়তে বসিয়ে আবার সেই রান্নাঘর। রাতের খাবার তৈরি করতে হবে। এক চুলায় চায়ের পানি আর একচুলায় ভাতের চাল চড়িয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই মেয়ের পড়াটা দেখিয়ে দেয়। এর ফাঁকে ফাঁকেই চলে রাতের রান্নার ব্যবস্থা। রান্নার ফাঁকে মেয়ের পড়া, ঘর গোছানো, রফিকের আগামী দিনের অফিসের পোশাক রেডি করতে করতেই রাত বেজে যায় ১০টা। মেয়েকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে একটু টিভির সামনে বসতে না বসতেই চোখের পাতা দুটো ভারি হয়ে আসে। তাড়াতাড়ি রাতের খাবার রেডি করে। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে একজন মানুষের জীবনযাপন করতে। বড় ইচ্ছে করে গভীর রাতে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে পুরনো দিনের গান শুনতে। কিন্তু ইচ্ছেগুলোকে গলা টিপে জোর করেই চলতে হয় এই গৎবাধা একঘেয়ে জীবনে। শখগুলোকে বাক্সবন্দী করে বিছানায় যেতে হয়। না হলে যে আবার ভোর পাঁচটায় ওঠা যাবে না। নিয়মের হেরফের হলেই পুরো দিনের, পুরো সংসারের রুটিন চেঞ্জ হয়ে যাবে। যার ধকলটা সামলাতে হবে তরুকেই। তাই তো ইচ্ছার বিরুদ্ধেও মানুষ নামী রোবটের জীবনটাকেই মেনে নিতে হয় তরুকে। তরুর মতো সবাইকে। খিলগাঁও, ঢাকা থেকে
×