ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শক্তিময়ী সর্বংসহা

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ১২ জুলাই ২০১৮

শক্তিময়ী সর্বংসহা

আমরা নারীরা বধূ, মাতা, কন্যারূপে নন্দিত ও স্বীকৃত; কিন্তু ‘ব্যক্তি’ হিসেবে বা ‘মানুষ’ রূপে চরম উপেক্ষিত! বিশেষ বিশেষ দিনে প্রতিবছরই নারীর সম-অধিকার, বৈষম্য, নারী-জাগরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, অগ্রগতি নিয়ে সভা-সেমিনারে উচ্চকিত ভাষণ দিয়ে নারীর উন্নতির কথা বলা হয়। তবে বাস্তব দৃশ্যপট ভিন্ন। একজন কর্মজীবী নারী যত উচ্চপদে আসীন হোন না কেন বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা দায়িত্বশীল পদে দায়িত্ব পালন করুন না কেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার স্বামী (ব্যতিক্রমও আছে) চান যে, তার স্ত্রী অফিস থেকে ক্লান্ত-ঘর্মাক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গৃহকর্ম সুনিপুনা হোক, শ্বশুরবাড়ির সেবা করুক, হেঁশেলে প্রবেশ করে সুস্বাদু পঞ্চব্যঞ্জন রান্না করুক ও সংসারের যাবতীয় কাজ দেখভাল করুক। অর্থাৎ যাকে বলেÑ ‘জুতা সেলাই থেকে চন্ডী পাঠ’... ঘর-গৃহস্থালির সব কাজই করতে হবে স্ত্রীকেই। অথচ বাড়ির অফিস-ফেরত পুরুষ ব্যক্তিটি তখন আরাম-আয়েসে-বিনোদনে-বিশ্রামে সুন্দর সময় অতিবাহিত করছেন! আত্মপ্রত্যয়ী কর্মজীবী নারী যে এক একজন শক্তিময়ী দশভুজ! তাদের সহ্যশক্তি অসীম আর সংসারের প্রতি দায়বদ্ধতাও সীমাহীন; তাই সংসারের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি এবং সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নীরবে নীলকণ্ঠ হয়ে সকল দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন ও অমানুষিক পরিশ্রম করে যান নিরন্তর। একজন নারী তার গুরুত্বপূর্ণ পেশাগত কাজের বাইরেও সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে নিজেকে উজাড় করে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করে সংসারের ঘর-গৃহস্থালির সব কাজ দশহাতে সামলান! অনেকদিনই ওই নারী কাজের চাপে খাওয়া-দাওয়া করার সময় পান না; ফলে স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা থাকে। আত্মনির্ভরশীল পেশাজীবী একজন নারী তার শিক্ষা-দীক্ষা, মেধা-মনন, জ্ঞান-গরিমার বিকাশ ঘটিয়ে কর্মক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে দেশের সেবা করে যাচ্ছেন; তার আছে একটি আত্মপরিচয় বা ‘আইডেন্টিটি’Ñ তেমনি যিনি গার্মেন্টস কর্মী বা ইটভাঁটির ইটভাঙ্গা নারী শ্রমিক, তারও আছে আত্মপরিচয়, তিনিও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী! পেশাজীবী নারীটি এখন আর অমুকের কন্যা, অমুকের স্ত্রী বা অমুকের মা নন; তিনি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষিকা, বিজ্ঞানী, সরকারী কর্মকর্তা, গার্মেন্টস কর্মী বা নারীশ্রমিক। তিনি ঘরে-বাইরে কিভাবে এত অক্লান্ত প্ররিশ্রম করেন, সেটা এক বিস্ময়! তিনি তার কাজে দুর্জয় সংকল্প নিয়ে ও দৃপ্ত প্রত্যয়ী হয়ে আত্মনিবেদিত, তাই তিনি জয়ী হন! আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথাই বলি। আমি সরকারী কলেজে অধ্যাপনা পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা, তার বিদ্যাবত্তায় থাকবে না কোন ত্রুটি, তার থাকবে বাকশৈলী, থাকবে রুচিশীল পোশাক, সর্বোপরি পাঠদানের প্রস্তুতি! কলেজ থেকে ফিরে সংসারের সব কাজ সেরে বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে, আমি রাত বারোটা নাগাদ বসতাম পরের দিনের অনার্স-মাস্টার্স শ্রেণীতে পাঠদানের প্রস্তুতির জন্য! বিজ্ঞানের কঠিন বিষয়গুলো তন্নিষ্ঠ সাধনায় সহজ-সরল-প্রাঞ্জল ভাষায় কিভাবে আকর্ষণীয় করে ঝর্ণাধারার মতো শিক্ষিকার কণ্ঠ থেকে উৎসারিত হবেÑ শিক্ষার্থীর কাছে হবে আকর্ষণীয় ও শ্রেণীকক্ষ হবে প্রাণবন্ত ও উজ্জ্বল! আর থাকব নির্ভার, উৎকণ্ঠাহীন ও আত্মবিশ্বাসী, সেই চেষ্টাই চলত রাত দুটো-তিনটে পর্যন্ত! পাঠপ্রস্তুতি শেষে আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে ঘুমাতে যেতাম। তবে এখন সময় এসেছে, পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটানো। সংসারে, কাছের পুরুষ মানুষটি যদি উদার মনোভাব নিয়ে নারীকে ঘর-গৃহস্থালির কাজে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন; তাহলে সম্মিলিত অংশগ্রহণে সেই সংসার হয়ে উঠবে সুখ ও আনন্দের আবাস; গড়ে উঠবে আদর্শ এক পরিবার। সন্তানরা হবে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সত্যিকারের আদর্শ মানুষ। মিরপুর, ঢাকা থেকে
×