ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মানুষ মানুষের জন্য... সুখের সন্ধান মিলল ফরিদাদের

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ১২ জুলাই ২০১৮

মানুষ মানুষের জন্য... সুখের সন্ধান মিলল ফরিদাদের

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে ফুটপাথে তিন সন্তান আর অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে নিদারুণ কষ্টে জীবন যাপন করছিলেন ফরিদা বেগম। কলাবাগান ফুটওভার ব্রিজের নিচে তাদের সংসার। ফরিদার স্বামী আনসার আলী হৃদরোগে আক্রান্ত। তিন সন্তানের মধ্যে এক মেয়েও প্রতিবন্ধী। সম্প্রতি ফুটপাথে শুয়ে থাকা অসুস্থ মায়ের মাথায় দুটি শিশুর পানি ঢালার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এক মহৎপ্রাণ মানুষের চোখে পড়ায় তার আপাতত চিকিৎসা হয়েছে। অনেকে তাদের পাশে থাকার ঘোষণাও দিয়েছেন। ফরিদা ও তার পরিবারের দুরবস্থার কথা ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় নিঃস্ব ফরিদার পাশে দাঁড়ালেন কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোছাঃ সুলতানা পারভীন। অসহায় ফরিদার পরিবারকে কুড়িগ্রামে আবাসনের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি পরিবারের উপার্জনের ব্যবস্থা এবং সন্তানদের পড়ালেখার ব্যবস্থার কথা বলেছেন জেলা প্রশাসক। বুধবার সকাল দশটার দিকে কলাবাগানে ফরিদাদের ঝুপড়ি ঘরে গিয়ে দেখা করেন জেলা প্রশাসক সুলতানা। তাদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সরকারীভাবে সব ধরনের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন। তারা বৃহস্পতিবার কুড়িগ্রাম যাবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়। এই জেলা প্রশাসক জনকণ্ঠকে বলেন, দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে তাদের দেখতে গিয়েছি এবং তাদের সার্বিক ব্যবস্থার কথা বলেছি। তিনি আরও বলেন, গণমাধ্যমের খবর এবং ফেসবুক থেকে ফরিদার করুণ অবস্থার কথা জানতে পেরে ঢাকায় দাফতরিক কাজ শেষে পরিবারটির সঙ্গে দেখা বলতে যাই। খুব খারাপ লেগেছে তাদের জন্য। কুড়িগ্রামের মানুষ তারা ঢাকায় ফুটপাথে এভাবে জীবন যাপন করবে আর আমরা কিছু করব না, এটা হয় না। তাদের জন্য সবকিছুর ব্যবস্থা করা আমাদের দায়িত্ব। কারণ, সেখানে সরকারের সিদ্ধান্তে শত শত মানুষকে আমরা বাড়িঘর করে দিচ্ছি। ডিসি বলেন, এই পরিবারের সব ধরনের দায়িত্ব আমি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়েছি। তাদের জন্য ঘরের ব্যবস্থা করব। উপার্জনের জন্য যেটা তাদের জন্য সুবিধা হয় সেটা করব। প্রয়োজনে দোকান করে দেব। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দেব। এটাই এখন প্রথম কাজ। স্বয়ং ডিসিকে এভাবে কাছে পেয়ে ফরিদারা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন বলেও জানান জেলা প্রশাসক। ফরিদার পরিবারের করুণ দশার কথা আলোচিত হয়েছে এক ভিডিওচিত্রের কারণে। রাস্তার পাশে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকা ফরিদার মাথায় পানি ঢালছিল তার ১১ বছরের মেয়ে আকলিমা। পাশে সাড়ে তিন বছর বয়সী ছেলে ফরিদুল। ভিডিও চিত্রটি ধারণ করেছিলেন পারভেজ হাসান। পেশায় একজন অনলাইন ফ্রিল্যান্সার। জ্বরে আক্রান্ত মায়ের মাথায় পানি দেয়া আকলিমার কাছে মায়ের অবস্থা জানতে চাইলে আকলিমা জানায়, ‘ওষুধ কিনার টাকা নেই।’ পরে দায়িত্ব নিলেন পারভেজ হাসান। এরপর চিকিৎসার জন্য ফরিদাকে নেয়া হয় গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসায় সুস্থ হন তিনি। পারভেজ হাসান নামে আরেক পথচারীও অসুস্থ মায়ের ভিডিও ধারণ করে ফেসবুকে পোস্ট করেন। বুধবার দুপুরে জেলা প্রশাসকসহ কয়েকজন পরিবারটির সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন এমন একটি ছবি পোস্ট করেন সাংবাদিক ও লেখক সাইফুল ইসলাম জুয়েল। মায়ের মাথায় ফরিদার সন্তানরা পানি দিচ্ছেন যে ছবিটা ভাইরাল হয়েছে সেটা জুয়েলের হাতে তোলা। পোস্টে জুয়েল বলেন, আলহামদুলিল্লাহ! অবশেষে সেই মা তার সন্তানদের একটা স্থায়ী গতি হলো। গতকালই জেনেছিলাম, কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক তাদের দায়িত্ব নিচ্ছেন। ঢাকায় পুলিশের দুজন উর্ধতন কর্মকর্তাও তাদের জন্য স্থায়ী কোন ব্যবস্থা করে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। আজ কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক তাদের দায়িত্ব বুঝে নেন। ইনশা আল্লাহ! আগামীকাল রাতেই এই পরিবারটি নীড়ের পথ ধরবে। তিনি আরও বলেন, কুড়িগ্রামের এই পরিবারটি নদীভাঙ্গনে সব হারিয়ে ঢাকায় এসে একটি ফুটওভার ব্রিজের নিচে বসবাস শুরু করে। তাদের আপন গন্তব্যে ফিরে যাবার কথা শুনে খুব ভাল লাগছে। মানবতার জয় হোক। ফরিদাদের বাড়ি ছিল কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর থানার ইসলামপুর গ্রামে। ক্রমাগত নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে যায় তাদের মাথাগোঁজার ঠাঁইটুকু। দুই বছর আগে উদ্বাস্তু হয়ে ৯ বছরের মেয়ে ও দেড় বছরের ছেলেকে কোলে তুলে ঢাকায় এসেছিলেন ফরিদা ও আনসার আলী। কিন্তু এই দুই বছরে মানসম্মত জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত টাকা আর মাথা গোঁজার ঠাঁই যোগাড় করা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে রোগশোক হলে চিকিৎসা হয় বুঝি? সেটা হয়নি আর এ কারণেই ফরিদা এখন পরিচিত হয়ে উঠেছেন। গত শুক্রবার সোবহানবাগ মসজিদের কাছে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। প্রচণ্ড জ্বর আর শরীর ব্যথা নিয়ে ফুটপাথে পড়ে থাকেন। শনিবার সারা দিনও ফরিদা রাস্তায় পড়েছিলেন। এদিন সন্ধ্যায় দেখা যায়, মাকে বাঁচাতে প্রাণান্ত চেষ্টা করছে ছোট দুই শিশু। তারা প্লাস্টিকের বোতলে করে পানি এনে মায়ের মাথায় ঢালছিল। দৃশ্যটিই ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এরপর থেকে অনেক হৃদয়বান ব্যক্তিই ফরিদার পরিবারকে সাহায্য করেছেন।
×