ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের তরুণ প্রজন্মের বিপথগামী একটা বড় অংশকে পচন থেকে রক্ষা করা সম্ভব

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১১ জুলাই ২০১৮

আমাদের তরুণ প্রজন্মের বিপথগামী একটা বড় অংশকে পচন থেকে রক্ষা করা সম্ভব

হঠাৎ সিলেট থেকে টেলিফোন পেলাম। মাঝে মাঝেই সিলেট থেকে আমার কাছে টেলিফোন আসে। তাতে বিস্মিত হইনি। বিস্মিত হলাম, যখন টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো, ‘আমি সিলেট ছাত্রদলের একজন নিষ্ক্রিয় নেতা। সাবেক নেতা বলতাম, কিন্তু দল আমাকে পদত্যাগ করতে দিচ্ছে না। বলছে, দল করতে না চাও, চুপচাপ থাক, দল ছাড়তে পারবে না। তাহলে বিপদ হবে।’ বলেছি, আমার কাছে কেন টেলিফোন করেছেন? তিনি বললেন, মনের কিছু দুঃখের কথা বলার জন্য। আর একটা সাজেশন জানানোর জন্য। আমার সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে কিছু লেখার জন্য অনুরোধ করছি না। তবে আমার সাজেশনটি নিয়ে যদি কিছু লেখেন, তাহলে অনুরোধ, আমার নাম প্রকাশ করবেন না। এমনিতেই ছাত্রদলের নেতা হিসেবে র‌্যাব ও পুলিশের নজরে আছি। তারপর ছাত্রদল আমার বর্তমান অবস্থানের কথা জানলে হয়তো গুম-খুন করে খেলবে। আমি তার কথা শোনার জন্য দারুণ আগ্রহী হলাম। প্রায় আধ ঘণ্টা আলাপের পর টেলিফোনের লাইন কেটে গেল। তিনি আবার টেলিফোন করলেন। বললেন, লাইন কেটে গিয়েছিল। পয়সা ফুরিয়ে গেছে। আবার তিনশ’ টাকা ঢেলেছি। আমাকে দয়া করে একটু সময় দেবেন। তারপর আরও আধঘণ্টা কথা। এই দীর্ঘ ফোনালাপ এখানে লেখা যাবে না। তার সারমর্ম এখানে লিখছি। ছাত্রদল নেতা বললেন, আমরা একদল ছাত্র আরও তরুণ বয়সে যখন ছাত্রদলে যোগ দেই, তখন কোন লোভ-লালসায় যোগ দেইনি। আদর্শবাদে উদ্দীপ্ত হয়ে যোগ দিয়েছি। তখন বিএনপি ক্ষমতায়। আমাদের শেখানো হয়েছিল। ‘দেশ স্বাধীন করেছেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। শেখ মুজিব যখন যুদ্ধ ঘোষণার পর পাকিস্তানের সামরিক জান্তার কাছে আত্মসমর্পণ করে পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে চলে গেলেন, তখন জিয়াউর রহমান কালুরঘাট থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তার নেতৃত্বে জেড ফোর্স হানাদারদের হটিয়ে দেশ স্বাধীন করেন। আমরা তখন অপরিণত বয়স্ক ছাত্র। ইতিহাসের এই জঘন্য বিকৃতি বোঝার বয়স হয়নি। আমাদের আরও বোঝানো হয়েছিল, দেশ স্বাধীন করেছে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী। কিন্তু শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে ভারতীয় সৈন্যের সাহায্যে ক্ষমতা দখল করেন এবং দেশটাকে ভারতের তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করেন। তিনি দেশ থেকে গণতন্ত্র উচ্ছেদ করেন এবং একদলীয় শাসন প্রবর্তিত হয়। দেশে তারই আমলে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ঘটানো হয়। দেশের বিক্ষুব্ধ জনগণ এবং সামরিক বাহিনীর তরুণ অংশ মিলে তার স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটায়। আমাদের সামনে তখন যে ইতিহাস খোলা ছিল তাতে বলা হয়েছে, জিয়াউর রহমান সিপাহী-জনতার বিপ্লব দ্বারা ক্ষমতায় বসার পর বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন এবং ভারতের তাঁবেদারি থেকে দেশকে মুক্ত করেন। এই পর্যন্ত বলে ছাত্রদল নেতা একটু বিরতি নিলেন। আবার বললেন, আমরা তখন যারা ছাত্রদলে যোগ দিয়েছি, তখন কোন লোভ-লালসা, লাইসেন্স পারমিটবাজির জন্য যোগ দেইনি। এই বিকৃত ইতিহাসের শিক্ষায় বিভ্রান্ত হয়ে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে আমাদের অর্থাৎ ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের এক বিরাট অংশের চোখ খুলে যায়। আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ এই সময় প্রকাশ্য রাজনীতির মাঠে নেমে এসেছে। আওয়ামী লীগ সমর্থক তরুণ ও প্রবীণ বুদ্ধিজীবীরা সাহস করে কথা বলা শুরু করেছেন। ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের এক বিরাট অংশের মধ্যে বিভ্রান্তি ঘুচে যায়। ইতিহাসের সত্য তারা জানতে পারেন। কিন্তু তাদের অনেকের তখন কিছু করার ছিল না। লাইসেন্স পারমিটবাজির লোভ দেখিয়ে, মন্ত্রিত্ব ও অন্য সুযোগ সুবিধার টোপ দিয়ে তাদের এক বিরাট অংশের চরিত্র ধ্বংস করা হয়। ছাত্রদলে সশস্ত্র ক্যাডার তৈরি করা হয়। যাদের চোখ খুলেছে তাদের দল ছাড়ার উপায় ছিল না। সশস্ত্র ক্যাডারদের তাদের ওপর চোখ রয়েছে। তাছাড়া কলেজ, ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি হলে তাদের জায়গা হবে না। আমরা অনেকেই ছাত্রদল ছাড়তে চাইলেও সময় ও পরিস্থিতি অনুকূল ছিল না। ছাত্রদল নেতা বললেন, এই ব্যাপারে আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। যখন বুঝতে পারলাম, জিয়াউর রহমান নন, বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছেন এবং পাকিস্তানীমনা দেশদ্রোহীরাই তাকে হত্যা করেছে তখন সিলেটে ছাত্রদলের এক সভায় বঙ্গবন্ধুর নিন্দা করা শুরু হয় এবং বলা হয়, ছাত্রদলের এখন থেকে স্লোগান ও লক্ষ্য হচ্ছে ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’। আমি বলেছিলাম, বিএনপি বলে বঙ্গবন্ধু-হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমান ও বিএনপির কোন যোগ ছিল না; তাহলে দেশে আবার পঁচাত্তরের পুনরাবৃত্তি ঘটাবার এবং আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতাদেরও হত্যা করার এই কর্মসূচী ও স্লোগান বিএনপির কি করে হয়? এটাতো কোন গণতান্ত্রিক দলের কর্মসূচী হতে পারে না। একথা বলার পর আমি দলে কোণঠাসা হই এবং নিশ্চুপ হতে বাধ্য হই। ধৈর্য্য ধরে অনেকক্ষণ তার কথাটি শুনেছি। বলেছি, আমার কাছে আপনি কি কথা বলতে চান? তিনি বললেন, স্যার, মনের দুঃখের কথা বলতে চাই। আমাকে দয়া করে একটু বলতে দিন। একটু থেমে বললেন, আওয়ামী লীগ একুশ বছর পর ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রদলের তো দুর্দিন শুরু। ছাত্রলীগের তখন দাপট। ছাত্রদলের যেসব নেতা-কর্মীর কোন চরিত্র ছিল না। তাদের অনেকে নানা কৌশলে ছাত্রলীগে ঢুকে যায়। তাদের দৌরাত্ম্যেই আজ ছাত্রলীগের এত দুর্নাম। কিন্তু আমরা যারা ছাত্রদলের ওপর আগেই আস্থা হারিয়েছিলাম, তাদের হলো, আরও বিপদ। আমরা সহসা রঙ বদলাতে পারিনি। ছাত্রদলের কাছে আমরা অস্পৃশ্য। ছাত্রলীগের কাছে ঘৃণ্য। পুলিশের খাতায় ছাত্রদলের নেতা-কর্মী বলে আমাদের নাম আছে। বড় রকমের কোন ধরপাকড় হলে আমরাও গ্রেফতার হই। আমিও র‌্যাব ও পুলিশের হাতে বহুবার নির্যাতিত হয়েছি। আমি সন্ত্রাসী, আমার ঘরে অস্ত্র আছে এই অভিযোগ সাজিয়ে আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, স্যার, আপনাকে কি বলব, এখন জেলে শ’য়ে শ’য়ে ছাত্রদলের যেসব নেতাকর্মী নানা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে পড়ছে, তারা সুযোগ ও নিরাপত্তা পেলে বহু আগে ছাত্রদল ছেড়ে দিত। দেশের তারুণ্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এমন করে জেলে পচত না। জেলে বসে তাদের চরিত্র আরও ধ্বংস হচ্ছে। জেল থেকে কোন দিন বের হলে তারা দেশের ক্ষতি করবে ভাল কিছু করতে পারবে না। বললাম, আপনি কি চান, তারা অনেকে নানা রকম গুরুতর অপরাধ করা সত্ত্বেও তাদের ছেড়ে দেয়া হোক? যে রকম বিএনপি দাবি তুলেছে, বেগম জিয়া দুর্নীতির দায়ে জেলে গেলেও তাকে মুক্তি দেয়া হোক। ছাত্রদল নেতা বললেন, আমি তা বলছি না। আমার কথা হচ্ছে, এই বিপথগামী তরুণদের সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার কি একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে না? নইলে একটা অংশ সন্ত্রাসী হয়েছিল, অন্য অংশও চিরদিনের জন্য অপরাধী হয়ে থাকবে। বলেছি, এই ব্যাপারে আপনার প্রস্তাবটা কি? তিনি বললেন, স্যার প্রস্তাব নয়, আমার একটা আবেদন। শুনেছি, বিলাতের জেলে তরুণ দাগি আসামিদের জন্যও ‘সংশোধন-কক্ষ’ আছে। বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে তাদের চরিত্র সংশোধনের সুযোগ দেয়া হয়। বাংলাদেশেও বিকৃত ইতিহাসের শিকার হয়ে জেলবন্দী তরুণ প্রজন্মের যে বড় একটা অংশ রাজনৈতিকভাবে বিপথগামী, চিরদিনের জন্য তাদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে না রেখে জেলেই তাদের দেশের প্রকৃত ইতিহাস জানার ও নিজেদের ভুলভ্রান্তি সম্পর্কে সচেতন হওয়ার সুযোগ দেয়া যায় না? এ জন্যে তাদের প্রকৃত ইতিহাস জানার জন্য বইপত্র পড়ার এবং সৎ বুদ্ধিজীবীদের জেল গমনের সুযোগ দিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা চক্রে বসার ব্যবস্থা করা যায় না? আপনি আমার কথাগুলো একটু ভেবে দেখুন। সরকারকে এ আবেদনটা জানান। দেশের তরুণ প্রজন্মের একটা বিরাট অংশকে পচন থেকে বাঁচান। তিনি টেলিফোন ছেড়ে দিলেন। কিন্তু আমার মনে একটা চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল। সেটা অতীতের চিন্তা। ব্রিটিশ আমলে চল্লিশের দশকে আমি যখন স্কুলের ছাত্র, তখন আমার জেলা বরিশালে বাম রাজনীতির আন্দোলন খুব জোরালো। কম্যুনিস্ট পার্টি, বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল (আরএসপি), সোস্যালিস্ট দল খুব শক্তিশালী। আরএসপি’র নেতা দেবেন্দ্র ঘোষ ছিলেন প্রবীণ বিপ্লবী। তার ভাগ্নে অথবা ভাইপোও ছিলেন বামপন্থী নেতা। নাম দেবকুমার ঘোষ। আমরা ডাকতাম মনা দা, প্রায়ই আমাদের ডেকে বামপন্থী রাজনীতির কথা বলতেন। কৈশোরে তিনি ব্রিটিশবিরোধী টেরোরিস্ট আন্দোলনের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। জেলে বসেই তিনি মার্কসবাদ ও কম্যুনিজম সংক্রান্ত বইপত্র পড়ে টেরোরিজমের অসারতা বুঝতে পারেন এবং কমিউনিজমের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। মনাদা খুব সাদাসিধে লোক ছিলেন, কিন্তু মাঝে মধ্যে দামী দামী পোশাক পরতেন। একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি সোস্যালিস্ট হয়ে এত দামী কাপড় পরেন কেন? তিনি হেসে বলেছিলেন, এগুলো আমার কেনা নয়। কেনার সাধ্যও নেই। এগুলো জেলে থাকতে ব্রিটিশ সরকারের দেয়া। আমরা জেলে যারা টেরোরিজমের অনুসারী যুবক ছিলাম, তাদের খুব ভাল খাবার-দাবার দেয়া হতো। দামী কাপড়-চোপড় দেয়া হতো। সেই সঙ্গে পড়তে দেয়া হতো এন্তারকমুনিস্ট লিটারেচার। আমরা ধীরে ধীরে টেরোরিজমের বদলে কম্যুনিজমের দিকে ঝুঁকে পড়ি। মনা দা বলেছিলেন, পরে বুঝেছি, এটা ছিল ব্রিটিশ-রাজের চতুর পলিসি। টেরোরিজমের দিকে ঝুঁকে পড়া তরুণ বন্দীদের জেলে ভাল খাইয়ে দাইয়ে, ভাল কাপড় পরিয়ে, বিলাসী বানিয়ে দাও। আর কম্যুনিজমের বই পড়িয়ে টেরোরিজমের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে দাও। তাহলে ওরা আর টেরোরিজমের দিকে ঝুঁকবে না। মার্কসবাদের দিকে ঝুঁকবে। আর ভারতে তখন মার্কসবাদী দল নেই। দল গড়ে উঠলেও ব্রিটিশ-রাজের ক্ষতি নেই। পরে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কম্যুনিস্টরা ব্রিটিশদের কোলাবরেটর ছিল। মনা দা বলেছিলেন, ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের এই পলিসি ব্যর্থ হয়নি। কমরেড মুজাফফর আহমদের মতো বড় বড় টেরোরিস্ট নেতারা জেল থেকে বেরিয়ে কম্যুনিস্ট পার্টি গঠন করেন। ভারতে ব্রিটিশবিরোধী সন্ত্রাসী আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায়। মনাদার কথাটা দীর্ঘকাল পর সিলেটের এক ছাত্রদল নেতার ফোনালাপ থেকে মনে পড়ল। সেই সঙ্গে মনে পড়ল, পাকিস্তান আমলেও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে প্রথমে জড়িত ছিলেন এমন নেতারা, যেমন মহিউদ্দীন আহমদ (পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ নেতা), এমাদুল হক লালা মিয়া (ইয়ুথ লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা), অলি আহাদ প্রমুখ জেলে বসে কম্যুনিস্ট রাজবন্দীদের সাহচর্যে বামপন্থী রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন। বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশে ইতিহাস বিকৃতির শিকার, বিপথগামী ও সন্ত্রাসী যে বিপুলসংখ্যক তরুণ, যারা নিজেদের ইচ্ছায় নয়, স্বাধীনতার শত্রুদের কবলে পড়ে, নানা প্রলোভনে বা পরিস্থিতির চাপে বিপথগামী হয়েছে, তাদের কেবল শাস্তি দিয়ে নয়, তাদের জন্য সংশোধন ও পুনর্বাসন পরিকল্পনা গ্রহণ করলে অবশ্যই ভাল হয়। সিলেটের ছাত্রদল নেতার প্রস্তাবটা তাই আমার কাছে খুবই ভাল মনে হয়েছে। এজন্যে মনস্তত্ত্ববিদ ও বুদ্ধিজীবীদের সাহায্য প্রয়োজন হবে। প্রয়োজন হবে কারাবিধি সংশোধনের। আমি বিশেষ করে জেলে বন্দী তরুণদের কথা বলছি। এদের জন্য জেলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, তাতে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের ভূমিকা, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের কুফল, গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের অভ্যুদয় ও বিকাশ, বাংলা ভাষা সংস্কৃতির ইতিহাস সংক্রান্ত বই রাখতে হবে এবং পড়তে দিতে হবে। ইতিহাস বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীরা সপ্তাহে অন্তত একদিন কারাকক্ষে এদের নিয়ে আলোচনাচক্রে বসতে পারেন। কারাকক্ষের বাইরের বিভ্রান্ত তরুণদের জন্যও এই ধরনের ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। দেশের স্কুল-কলেজের তরুণদের ‘মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের’ জন্য জামায়াতের যে পরিকল্পিত অভিযান, জামায়াতী লিটারেচারে তরুণদের ঘর ভর্তি করে দেয়া তা থেকে তরুণ প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে এই ধরনের একটি পরিকল্পনা দেশের শিক্ষা পরিকল্পনার অংশ করা উচিত। তাই বলে এটা যেন জামায়াতীদের মস্তিষ্ক ধোলাই পরিকল্পনার মতো কোন পরিকল্পনা করা না হয়। অর্থাৎ তরুণ প্রজন্মের সকলকেই আওয়ামী লীগার বা ছাত্রলীগার বানাবার চেষ্টা না হয়। সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। জাতির ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সচেতনতা ছাড়া আওয়ামী লীগে কেহ ঢুকলে তাতে লাভ হয় না, ক্ষতি হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যে অগুনতি লোক রঙ পাল্টে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করেছে, তাদের দ্বারা সংগঠন দু’টি উপকৃত হয়নি। বরং তার সুনাম নষ্ট হচ্ছে। হাসিনা সরকারের উচিত, ইতিহাস-বিকৃতির ফলে বিপথগামী ও ভ্রান্ত তরুণদের সুপথে ফিরিয়ে আনা এবং দেশের সুস্থ ভবিষ্যৎ গঠনের কাজে লাগানোর জন্য অদলীয়ভাবে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের সঠিক ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া। জাতির প্রকৃত ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হলে এবং তার অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তার হাজার বছরের ইতিহাস সম্পর্কে তাদের সচেতন করে তুলতে পারলে বিপথগামী প্রজন্মের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকেই সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস। বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হলে তখন তারাই ঠিক করে নেবেন তারা স্বাধীনতার পক্ষের কোন দল বা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে চান। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর দু’জনেই প্রগতিশীল, সংস্কৃতিমনা মানুষ। তারা এই ধরনের একটি পরিকল্পনার কথা ভেবে দেখতে পারেন। এই ধরনের একটি পরিকল্পনা তৈরি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিলে তিনি যে তা অনুমোদনে দেরি করবেন না, এটাও আমার দৃঢ় বিশ্বাস। লন্ডন, ১০ জুলাই, মঙ্গলবার, ২০১৮
×