ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুড়িধান- আবাদে নতুন বিপ্লব

কৃষকের চোখে আশার আলো, স্বল্প ব্যয়ে বেশি লাভ

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১১ জুলাই ২০১৮

কৃষকের চোখে আশার আলো, স্বল্প ব্যয়ে বেশি লাভ

রফিকুল ইসলাম আধার ॥ এবার ‘বোনাস ধান’ চাষে আশার আলো দেখছেন শেরপুরের কৃষকরা। বোরোর আবাদ কাটার পর পতিত জমিতে রয়ে যাওয়া ধান গাছের পুরনো মোথা বা গোড়া থেকে গজানো চারা থেকে উৎপাদিত ওই ‘বোনাস ধান’ বা মুড়িধান চাষে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। বিনা খরচে একরপ্রতি ১০-১২ মণ বোনাস ধান উৎপাদিত হওয়ায় বাড়তি ওই আয়ের পথকে কৃষিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এজন্য এলাকার অনেকেই এখন ওই ধানচাষে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, মুড়ি ফসলকে ইংরেজীতে বলে ‘রোটেন ক্রপ’। বিশেষত ধান, আখ, কলায় মূল ফসল কাটার পর অবশিষ্টাংশ গোড়া থেকে পুনরায় গাছ হয় ও ফলন পাওয়া যায়। একেই মুড়ি ফসল বলে। জেলায় প্রতিবছর বোরো আবাদ হয় প্রায় ৯২ হাজার ৬১০ হেক্টর জমিতে। ওই আবাদের পর আউশ আবাদ হয় মাত্র ৩ হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে। বাকি বেশিরভাগ জমি থাকে পতিত অবস্থায়। পূর্ব পুরুষদের ধারাবাহিকতায় নালিতাবাড়ীসহ জেলার কিছু কিছু এলাকায় মুড়ি ধানের আবাদ হয়ে আসছিল। নামমাত্র খরচে এ আবাদে কৃষকের লাভবান হওয়ার বিষয়টি চিন্তা করে কৃষি বিপ্লবের চিন্তক, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর নির্দেশনায় স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শে চলতি মৌসুমে ওইসব পতিত জমিতে অনেকেই মুড়ি ধানের আবাদ করেছেন। তবে জেলার অন্যান্য উপজেলায় নামমাত্র আবাদ হলেও চলতি মৌসুমে এর আবাদ সবচেয়ে বেশি হয়েছে সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী উপজেলায়। এ উপজেলার পোড়াগাঁও, নন্নী, রামচন্দ্রকুড়া, কাকরকান্দি, নালিতাবাড়ী, মরিচপুরান ও বাঘবেড় ইউনিয়নে মুড়িধান আবাদ করেছেন স্থানীয় কৃষকরা। এতে চাষীরা ফলনও পেয়েছেন আশানুরূপ। এছাড়া স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শে উৎপাদিত ধানের পরিমাণ বাড়াতে বোরো ধান কেটে ফেলার পর ওই জমিতে বিঘাপ্রতি ৫ কেজি ইউরিয়া এবং ৫ কেজি পটাশ সার প্রয়োগ করে মাত্র ৭শ’ হেক্টর আউশ জমির বিপরীতে এ উপজেলায় মুড়িধান আবাদ হয়েছে প্রায় ১২শ হেক্টর জমিতে। একর প্রতি ফলন হয়েছে ১০-১২ মণ হারে। ফলে সহজেই বাড়তি লাভবান হচ্ছেন স্থানীয় কৃষকরা। সরেজমিনে গেলে কথা হয় হাতিবান্দা গ্রামের চাষী আবুল হাশেমের সঙ্গে। তিনি জানান, বোরো ধান কাটার পরই বোরো ধানের চারার গুছি থেকে যে চারা গজায় তা রেখে দিলেই মাত্র দেড় মাসে কোনপ্রকার পরিচর্যা ছাড়াই মুড়িধান এর ফলন কাটা যায়। নেই মাড়াইয়ের ঝমেলাও। ধান কাটার পর শুধু রাস্তায় ছড়িয়ে দিলেই ওই ধান সংগ্রহ করা যায়। কাজেই এটা পুরোটাই ফাউ। কৃষক ফরহাদ হোসেন জানান, যে সময় তার জমি পতিত থাকত, সেসময় এক একর জমিতে মুড়িধান আবাদ করে তার ফলন হয়েছে ১২ মণ। আর ব্যয় হয়েছে মাত্র ২ হাজার টাকা। ফলে এটা তিনি ‘ফাউ লাভ’ করেছেন। চাষী মোশারফ হোসেন জানান, তিনি ২২ কাঠা জমিতে মুড়িধান আবাদ করে ১৫ মণ ধান পেয়েছেন। শুধুমাত্র কাটানোর ব্যয় ছাড়া পুরোটাই তার লাভ হয়েছে। এছাড়া কিষানি জামিনা খাতুন জানান, তিনি বন্ধক নেয়া ৫ কাঠা জমিতে বোরো আবাদের পর মুড়িধান আবাদ করে ৩ মণ ফলন পেয়েছেন। তারই ছেলে জহুরুল ৬ কাঠা জমিতে একই ধান আবাদ করে ফলন পেয়েছেন ৪ মণ ১০ কেজি। নালিতাবাড়ীর রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের কালাকুমা গ্রামের মোঃ মোস্তফা বলেন, সাত কাডা (৩৫ শতক) জমিতে ‘পাইওনিয়ার’ জাতের বোরো ধান লাগাইয়া ২০ মণ ফলন পাইছিলাম। অহন কাটা ধানের গোড়া থাইক্কা কোনো যতœ ছাড়াই ধান পাইছি আরও ৫ মণ। অহন এই ধান বেচার টাকা দিয়া আমন ধানের বীজতলা তৈয়ারি করছি। এতে আমায় প্রায় এক একর আমন ক্ষেত চাষাবাদের জন্য খরচের চিন্তা করতে অইতাছে না। নালিতাবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শরিফ ইকবাল জানান, নালিতাবাড়ী উপজেলায় বোরো ধানের জমিতে মুড়ি ফসল দেখে স্থানীয় সাংসদ ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর নির্দেশনায় ইতোমধ্যে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকগণ নালিতাবাড়ী থেকে মুড়ি ফসলের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। বিশেষ করে হাইব্রিড জাতের বোরো ধানের জমিতে ব্যাপক আকারে মুড়ি ফসল পাওয়া গেলে তা হবে কৃষকের জন্য আশীর্বাদ। যদি সঠিক পরিচর্যা করে এর ফলন আরও বাড়ানো যায়। তাছাড়া মুড়ি ধান এ অঞ্চলে আউশ ধানের বিকল্প ফসল হতে পারে বলে আশা করা যায়। এতে করে শুধু কৃষকরা লাভবানই হবেন না, পতিত জমির মুড়ি ফসল কিছুটা হলেও যোগান দিবে দেশের খাদ্য ভা-ারে। শেরপুর খামারবাড়ির উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আশরাফ উদ্দিন জানান, কৃষি বিভাগ ওই আবাদকে আউশের বিকল্প হিসেবে লাভজনক ফসল হিসেবে মনে করছে। চলতি মৌসুমে মুড়ি ধান আবাদে কৃষকদের উৎসাহিত করতে লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। এতে ফলন আশানুরূপ হওয়ায় বাড়তি লাভবানও হচ্ছে স্থানীয় কৃষকরা। ফলে আগামীতে এ অঞ্চলে মুড়ি ধান আবাদের পরিমাণ আরও বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
×