ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জেলখানার সম্বল থালা বাটি কম্বল শুধু নয়, বালিশও মিলছে

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ১০ জুলাই ২০১৮

জেলখানার সম্বল থালা বাটি কম্বল শুধু নয়, বালিশও মিলছে

মশিউর রহমান খান ॥ কারাগারের ২২৮ বছরের ইতিহাস ভেঙ্গে বন্দীর সুবিধার্থে এই প্রথমবারের মতো প্রতিটি কারাবন্দীকে ব্যবহারের জন্য একটি করে কভারযুক্ত বালিশ দেবে কারাকর্তৃপক্ষ। চলতি জুলাই থেকেই ঘুমানোর জন্য মাথার নিচে পূর্বের দেয়া কম্বলের পরিবর্তে নরম শিমুল তুলার কভারযুক্ত বালিশ প্রদান করা হবে। প্রাথমিকভাবে অধিকসংখ্যক আটক বন্দী ও গুরুত্বপূর্ণ কারাগার বিবেচনায় দেশের সকল কেন্দ্রীয় কারাগার ও অধিকসংখ্যক বন্দীর কারাগারগুলোতে এসব বালিশ দেয়া হবে। বর্তমানে শুধু ডিভিশনপ্রাপ্ত ও অসুস্থ হয়ে কারা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন এমন বন্দীদেরই বালিশ দেয়া হয়। এই উদ্যোগের মাধ্যমে দীর্ঘবছর যাবত প্রচলিত ‘জেলখানার সম্বল, থালা বাটি কম্বল’ কথাটির কিছুটা পরিবর্তন করা হচ্ছে। এবার থালাবাটি কম্বলের সঙ্গে বালিশেরও ব্যবস্থা করা হবে। বন্দীদের আরামে ঘুম ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা চিন্তা করেই বর্তমান কারা প্রশাসন অতিরিক্ত কোন প্রকার সরকারী ব্যয় না করেই একটি করে বালিশ দেবে বলে কারাসূত্রে জানা গেছে। দেশের ৬৮ কারাগারে আটক প্রায় ৮০ হাজার বন্দীকেই বালিশ প্রদান করা হবে। ইতোমধ্যে এই কাজের অংশ হিসেবে কারা অধিদফতর ই-টেন্ডারের মাধ্যমে ৪৮ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে ১৬ হাজার ৪শ’ ২০ বালিশ ক্রয় করেছে। বাকি ৫০ হাজার ৩শ’ ৫৫ বালিশ কেনার প্রক্রিয়া চলমান রেখেছে। বাকি বালিশগুলো চলতি অর্থবছরেই ক্রয় করা হবে যার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে। প্রতিটি বালিশ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে এক বছরের জন্য বালিশের ওয়ারেন্টি প্রদান করতে হবে। এর মধ্যে বালিশ নষ্ট হয়ে গেলে তা প্রতিস্থাপন করবে ওই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি কভারযুক্ত বালিশ ক্রয়ে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩শ’ টাকা। কারাগার শুধু বন্দীর শাস্তি কার্যকরেরই স্থান; শত শত বছরের এমন ধারণা বদলে দিতে ও কারাগারকে সংশোধনাগার হিসেবে রূপান্তরের অংশ হিসেবে কারাকর্তৃপক্ষ বন্দীর শান্তি ও সুস্থতাকে প্রাধান্য দিয়েই এমন উদ্যোগ নিয়েছে। আটক বন্দীর কল্যাণের কথা চিন্তা করে বন্দীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আটককালীন বন্দীকে স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ করতেই এই বিশেষ উদ্যোগ হাতে নিয়েছে কারাকর্তৃপক্ষ। সূত্র জানায়, বর্তমানে আদালত নির্দেশিত হয়ে কারাগারে নতুন কোন বন্দী প্রবেশ করার পর তার পরিচয় শেষেই থাকা ও খাওয়ার জন্য হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় তিনটি কম্বল, একটি থালা ও একটি বাটি। একটি কম্বল গায়ে দেয়ার, একটি বিছানোর জন্য অপরটি ভাঁজ করে মাথার নিচে বালিশ হিসেবে ব্যবহার করতে দেয়া হয়। তবে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দী ও হাসপাতালে ভর্তি বন্দীরা আগে থেকেই বালিশ ও মশারি ব্যবহার করতে পারতেন। এ উদ্যোগের ফলে কারাগারে আটক সকল শ্রেণীর বন্দীই ব্যবহারের জন্য বালিশ বরাদ্দ পাবেন। কারাসূত্র জানায়, বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বেশি বন্দী আটক রয়েছে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। যেখানে ৬ থেকে ৭ হাজার বন্দী সবসময়ই আটক থাকেন। কোন আসামি কিছুটা অসুস্থ হয়ে কারাগারে প্রবেশ করলে কম্বলের তৈরি মাথার নিচে বালিশের ন্যায় প্রচলিত পদ্ধতিতেই ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হয়। এতে অনেক মানুষ রাতে ঘুমাতে পারেন না। ফলে বেশিরভাগ আসামি শুধু সঠিক পরিমাণ আরামদায়ক ঘুম না হওয়ায় কারাভ্যন্তরে দিনভর মানসিক বিষয়াদগ্রস্ত থাকতে দেখা যায়। যার ফলে যে কোন সময় কারাভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিরও আশঙ্কা থেকে যায়। এছাড়া অনেক সময় এই বিষাদগ্রস্থতার কারণে কোন কোন আসামিকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে যেতেও দেখা যায়। পরবর্তীতে এমন অসুস্থ ব্যক্তিদের কারাকর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েই কারা হাসপাতাল বা বাইরের হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। যা কারা কর্তৃপক্ষের জন্য বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে। এসব সমস্যা চিহ্নিত করে এ থেকে উত্তরণের জন্য কারাকর্তৃপক্ষ শত শত বছর ধরে চলে আসা কারাগারের নিয়মানুযায়ী বর্তমান বালিশের পরিবর্তে কম্বল পদ্ধতি বাতিল করে বন্দীদেরকে তুলার কভারযুক্ত বালিশ প্রদানের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কারাকর্তৃপক্ষের ধারণা, বন্দীরা বালিশ পেলে আরামদায়ক বালিশে ঘুমাতে পারবেন। যার ফলে বন্দীর স্বাস্থ্যও সুরক্ষা অনেকটা সহজ হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন,স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বন্দী নয় যে কোন মানুষেরই রাতের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত আরামদায়ক ঘুম অতি প্রয়োজনীয় একটি অনুসঙ্গ। আর ঘুমের জন্য বালিশ অন্যতম একটি উপাদান। আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে দৈনন্দিন কাজের স্বাভাবিকভাবেই সমস্যার সৃষ্টি হয়। আর কারাগারে আটক বন্দীদের ক্ষেত্রে যার প্রভাব সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। রাতে পর্যাপ্ত ও আরামদায়ক ঘুম না হওয়ায় অনেক বন্দীই অসুস্থ হয়ে পড়েন। মূলত বন্দীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আরামদায়ক ঘুমের জন্য কারাগারের ইতিহাসে শত বছর ধরে চলে আসা কম্বলের তৈরি বালিশ পদ্ধতি নির্বিঘেœ ঘুমের জন্য সহায়ক নয়। মানবাধিকার রক্ষায় ও বন্দীর সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবে আমরা বন্দীর ঘুমানোর জন্য কম্বলের বর্তমান পদ্ধতির পরিবর্তে এই প্রথমবারের মতো আরামদায়ক কভারযুক্ত বালিশ প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছি। আটক বন্দীর কল্যাণের কথা চিন্তা করে বন্দীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আটককালীন বন্দীকে স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ করতেই এই বিশেষ উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আমরা ই-টেন্ডারের মাধ্যমে সারাদেশের প্রায় ৮০ হাজার বন্দীকে একটি করে বালিশ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইতোমধ্যেই আমরা ৪৮ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ১৬ হাজার ৪২০টি বালিশ ক্রয় করেছি। কভারযুক্ত প্রতিটি বালিশের ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩ শ’ টাকা। অধিকসংখ্যক বন্দী ও গুরুত্বপূর্ণ কারাগার বিবেচনায় দেশের সকল কেন্দ্রীয় কারাগার ও অধিকসংখ্যক বন্দীর কারাগারগুলোতে চলতি জুলাই মাস থেকেই বালিশ প্রদান করা হবে। পর্যায়ক্রমে সকল কারাগারের বন্দীদের জন্য প্রায় ৫০ হাজার বালিশ ক্রয়ের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সকল বন্দীকেই বালিশ প্রদান করা হবে। আশা করি, এসব বালিশ বন্দীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
×