ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এম. এম. শাহরিয়ার রুমী

স্মরণ ॥ সংগ্রামী জননেতা শামসুদ্দীন মোল্লা

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১০ জুলাই ২০১৮

স্মরণ ॥ সংগ্রামী জননেতা শামসুদ্দীন মোল্লা

মরহুম শামসুদ্দীন মোল্লা ছিলেন এদেশের নির্যাতিত নিপীড়িত জনগণের প্রকৃত বন্ধু। তাদের সকল ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন আপোসহীনভাবে। ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার স্বনামধন্য ও প্রাচীনতম স্কুল ভাঙ্গা পাইলট হাই স্কুলে পড়ার সময় তার যাত্রা শুরু। শামসুদ্দীন মোল্লা তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। ইতিহাস পড়ানোর সময় শিক্ষকের সঙ্গে মতের অমিল হওয়ায় তিনি প্রতিবাদ করলেন। সারা স্কুল তথা ভাঙ্গা উপজেলায় দেখা দিল ভীষণ উত্তেজনা। এর সমাধান করার জন্য গোপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর প্রতিবাদী ছাত্র জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভাঙ্গা নিয়ে এসে সেই শিক্ষকের ভুল ধরিয়ে দিলেন। শিক্ষক তা মেনে নেয়ায় পরিস্থিতি শান্ত হলো এরং ছাত্রদের জয় হলো। সেই থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর শামসুদ্দীন মোল্লা পরস্পর বন্ধুত্বে রূপান্তরিত হলেন। সেই বন্ধুত্ব অটুট অবস্থায় চলতে থাকল নিবিড়ভাবে। বিশেষ করে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে একসঙ্গে ভর্তি হয়ে পুরোদমে রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন। বেকার হোস্টেলে ছিলেন একই সঙ্গে। শামসুদ্দীন মোল্লা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন ব্যবসায় পাস করে বাংলা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখার পর চলে গেলেন ফরিদপুরে। আইন পেশায় নিয়োজিত থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখে নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষকে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরে তাদের দলে যোগদানের জন্য ভূমিকা রাখেন। এখানে উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামী মুসলীম লীগ, পরবর্তীতে যা বর্তমানে আওয়ামী লীগ জন্ম নিয়েছে। সেই থেকে শামসুদ্দীন মোল্লা বিভিন্ন সময় বৃহত্তর ফরিদপুরের জেলা আওয়ামী লীগের কখনও সহ-সভাপতি, কখনও সাধারণ সম্পাদক বা সভাপতি হিসেবে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। একদিকে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য বাংলার মুক্তি সনদ ৬-দফা দাবির ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা দিয়ে জনগণকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বোঝাতেন অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য জোর দাবি তুলতেন। আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ এই মানুষটি ছিলেন বহু প্রতিভার অধিকারী। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান। ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক সমিতির সভাপতি, ছিলেন ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি। বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন আর সংগঠনের নেতৃত্ব দিতেন। কিন্তু তার প্রধান কর্মকা- আবর্তিত হতো আওয়ামী লীগ রাজনীতি নিয়ে। শামসুদ্দীন মোল্লা বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান রচয়িতার অন্যতম সদস্য ছিলেন, ছিলেন কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের অন্যতম সদস্য। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের (এম.এন.এ) ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে জেলা গবর্নর মনোনীত হন। শামসুদ্দীন মোল্লার রাজনৈতিক জীবনে এই যে সাফল্য তা একদিনে আসেনি। দিনের পর দিন রাতের পর রাত সদ্য গঠিত পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছতে যে কি নিরলস পরিশ্রম করতে হয়েছে, বর্তমান যুগের রাজনীতিবিদরা তা কল্পনাও আনতে পারবেন না। আওয়ামী লীগের বক্তব্য, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য কখনও মাইলের পর মাইল রাস্তা হেঁটেছেন, কখনও ঘোড়ায়, কখনও বাইসাইকেলে বা নৌকায় করে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত হেঁটে বেড়িয়েছেন খাওয়া-দাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে। এমন কি পরিবার পরিজনদের কথা মনেও থাকত না। সে সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই ভঙ্গুর এবং যারপরনাই সমস্যা সঙ্কুল। ভাবতে অবাক লাগে তখনকার সময় বঙ্গবন্ধু এমন ১৭ জন শামসুদ্দীন মোল্লাকে তৈরি করেছিলেন ১৭ জেলার জন্য। শামসুদ্দীন মোল্লা ডায়রিতে একটি জায়গায় উল্লেখ করেছেন, ‘১৯৩৯ সন হতে ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট কালরাত্রি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পর্যন্ত আমি ছিলাম তাঁর সবচেয়ে পুরনো সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। বঙ্গবন্ধু বলতেন, দগড়ষষধয রং সু ড়ষফবংঃ পড়ষষবধমঁব ধহফ পষড়ংবংঃ ভৎরবহফ’. তাই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য দেশের মধ্যে যেমন চেষ্টা করেছেন, আবার দেশের মধ্যে স্বৈরশাসকদের অত্যাচারে যখন থাকতে পারেননি, তখন আরও অনেক নেতা আমাদের মতো কিছু নেতাদের নিয়ে ওই বয়সে আবার ভারতে রওয়ানা হলেন। নানান জটিলতায় তাৎক্ষণিক প্রতিশোধ নেয়া যায়নি। এখানে আমি বলতে চাই। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা আত্মীয়স্বজন ছেড়ে তিনি উল্কার মতো হেঁটেছেন জাতির পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। আওয়ামী লীগ গড়তে গিয়েও যেমন ভাবেননি সংসার-পরিজনের কি হবে?Ñ ঠিক তেমনি বৃদ্ধ বয়সেও ভাবেননি নিজের কথা বা সংসারের কথা। তার সেই ইচ্ছা তিনি না দেখে গেলেও আমার বিশ্বাস তার আত্মা শান্তি পাচ্ছে এই ভেবে যে, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী সফল রাষ্ট্রনায়ক ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা এক এক করে সকলের বিচার করে ফেলেছেন। লেখক : সাবেক ছাত্রলীগ নেতা
×