ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হারুণ চৌধুরী

ফিরে দেখা ॥ ২০০১ খালেদা-নিজামীর শাসনকাল

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১০ জুলাই ২০১৮

ফিরে দেখা ॥ ২০০১ খালেদা-নিজামীর শাসনকাল

(গতকালের পর) ৩১ জানুয়ারি ২০০২ অষ্টম জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশনের প্রথম দিন নতুন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী তার প্রথম ভাষণ দেবেন। বঙ্গবন্ধুকে জাতীয় নেতাদের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তার নাম লিখে। জিয়াউর রহমানকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে উচ্চ স্থান দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ভাষণের খবরটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন না দিয়ে নতুন করে লেখার নির্দেশ দেয়া হয়। সভায় এক মন্ত্রী নাকি খালেদা জিয়াকে খুশি করার জন্য বলেন, শেখ মুজিবের নাম সবার আগে থাকতে পারে না। নামের সিরিয়ালের প্রস্তাব দেন তিনি। এতে সবাই সম্মতি দেন (২৩ জানুয়ারি ২০০২ জনকণ্ঠ)। চট্টগ্রামে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে বলেন, আওয়ামী লীগ রাজপথে আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টির মতলব করছে। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতার কোন স্থান নেই। অথচ ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মহীনতার সঠিক অর্থ সাঈদী নিজেই জানে না। আজকের কাগজ ও ইনকিলাব ২৩ জানুয়ারি ২০০২)। ইতিহাস বিকৃতির পক্ষেও যশোরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী রেদওয়ান আহাম্মদ বলেন- ১৯৭১ সালে ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমানই প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তার ঘোষণায় মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল (২৩ জানুয়ারি ২০০২ জনকণ্ঠ)। স্কুলের পাঠ্য পুস্তকে কোমলমতি শিশুদের ইতিহাস বিকৃতি শেখানো হয়। ’৭১-এ সুপ্রিম কমান্ডার ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। ইতিহাসের এই ভাষণ দেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়েছে। অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তকের ‘সাহিত্য কণিকায়’ হুবহু এ কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। অভিভাবক শিক্ষার্থী ও সচেতন মহল রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করে এতে। নিবন্ধের রচয়িতা দৈনিক দিনকাল পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কাজী সিরাজুদ্দীন আহাম্মদ, প্রথম আলোর প্রতিবেদক তার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করলে তিনি তথ্যটির উৎস হিসেবে সৈয়দ আলী আহসানের একটি স্মৃতিচারণের কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু তথ্য প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হন তিনি। পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে, নবম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে বোর্ডের সকল সংশোধিত পাঠ্য পুস্তকে ইতিহাস বিকৃতি স্থান পায়। কোমলমতি শিশুদের কাছে আসল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয় (২৩ জানুয়ারি ২০০২ দৈনিক প্রথম আলো)। আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ : নবম ও দশম শ্রেণীর মাধ্যমিক বাংলা গদ্যে সংশোধিত ২৬ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন এ কথা বিএনপি প্রমাণ করতে পারলে স্বেচ্ছায় দেশ ছেড়ে চলে যাব। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক আবু সাঈদ (২১ জানুয়ারি ২০০২ জনকণ্ঠ)। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় যাবার পর পরই স্বতঃস্ফূর্ততায় ঘাপটি মেরে থাকা জামায়াত জেগে ওঠে। নাস্তিক মুরতাদ ও দেশদ্রোহীর তালিকা প্রস্তুত করে ইসলামী ঐক্য জোট। রাজধানীর একটি হোটেলে মুফতি আমিনীর নেতৃত্বে ইসলামী ঐক্যজোটের সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন, বিগত সরকারের সামনে যে সব অতি উৎসাহী সরকারী কর্মকর্তা বাড়াবাড়ি করছেন তাদের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রদ্রোহী ও মুরতাদ কর্মকর্তাদেরও তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। ইসলামবিরোধী সংস্কৃতি বাতিল, রাষ্ট্রীয় কর্মকা-ে এনজিওদের হস্তক্ষেপ বন্ধের দাবি জানান (দৈনিক প্রথম আলো)। মানবাধিকার নেত্রী এ্যাডভোকেট সিগমা হুদা বগুড়ার গাবতলী উপজেলার বাগবাড়িতে গতকাল শনিবার জিয়া মঞ্চে আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথির ভাষণে বলেনÑযারা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল Ñতাদের ভাল গুণকে কাজে লাগাতে পারলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও তার জীবদ্দশায় এক অনুষ্ঠানে তাকে একই কথা বলেছিলেন (দৈনিক প্রথম আলো)। একুশে টিভির লাইসেন্স বাতিল : জোট জামায়াত ক্ষমতায় এসেই ’৫২’র ভাষা আন্দোলনের নামকরণে একুশে টিভি জামায়াতের নেতারা কোনক্রমেই মেনে নিতে পারেনি। কারণ একুশের টিভি সাধারণ মানুষের কথা বলে। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে। সরকারের বেআইনী কার্যকলাপ প্রকাশ করে। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে তৎকালীন বিএফইউজের একাংশের সভাপতি গিয়াস কামাল চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুর রব এবং ফার্মেসী বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী মাহমুদ হাসান একুশে টিভির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন মামলা দায়ের করেন। বিতর্কিত বিচারপতি এম. এ. আজিজ ও বিচারপতি সিকদার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ একুশে টিভির লাইসেন্স কেন বাতিল ঘোষণা করা হবে না, এই মর্মে সংশ্লিষ্টদের প্রতি কারণ দর্শানোসহ রুলনিশি জারি করেন। এসব জোট সরকারের ইঙ্গিতেই হয়। এরপর দেশের সকল সম্মানিত দর্শক ও বুদ্ধিজীবীদের অনুরোধ উপেক্ষা করে ২৬ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের ঐ বেঞ্চে একুশে টিভির সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ ঘোষণা করে। লাইসেন্স বাতিলের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিল শুনানির পর হাইকোর্ট ও সর্বোচ্চ আদালত তা খারিজ করে দেয়। এরপরই আইনমন্ত্রী মওদুদ আহামদের অতি উৎসাহে একুশে টিভির সকল যন্ত্রপাতি জব্দ করা হয় ও সংবাদ পাঠক ডালিমের আবেগ জড়িত কণ্ঠের ঘোষণার মধ্য দিয়ে একুশে টিভির সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। জামাতের প্রথম পদক্ষেপ সফল হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি : রাজনৈতিক কারণে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষকে অপসারণ করা হয়। শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিকারুন নিসা নুন স্কুল এ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হামিদা আলী, উদয়ন স্কুল এ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী, মিরপুর গালর্স আইডিয়াল ল্যাবরেটরী ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ রাজিয়া হোসেন, তেজগাঁ কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুর রশিদ, ডেমরা দনিয়া কলেজের অধ্যক্ষ সাহাদত হুসাইন রানাÑ তারা সবাই চার দলীয় জোটের রাজনৈতিক শিকার। অথচ তারা সবাই মেধা ও শ্রম দিয়ে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন শিক্ষাঙ্গনকে (জনকণ্ঠ ১৮ জুলাই ২০০২) রাজনৈতিক শিকারের প্রমাণ পাওয়া যায় শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে। শিক্ষামন্ত্রী ড. এম ওসমান ফারুক টেলিভিশনকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেনÑ হামিদা আলী সরকারের সিদ্ধান্ত না মানলে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। ২০০১ সালে জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর ভেবেছিল দেশের সর্বস্তরে ইসলাম কায়েম করবে। কিন্তু দেশের প্রগতিশীল মানুষ তা মেনে নেয়নি। তার প্রমাণ পাওয়া যায় বুয়েটের ইউকসুর বার্ষিকীতে সম্পাদক তাবাসসুম মাহাজাবীন মুমু রাজাকারদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া সম্পর্কে তার সম্পাদকীয়তে সমালোচনা করায় বিএনপি-জামায়াতের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রদল ও ছাত্র শিবির মুমুকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে ও তাকে ক্ষমা চাইতে বলে। মুমু ক্ষমা না চেয়ে প্রতিবাদস্বরূপ ছাত্র সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। বিবৃতিতে মুমু ছাত্র ইউনিয়নকে তার পদত্যাগের কারণ হিসেবে বলেন, ইউকসু রাজাকারদের সমর্থন করে জামায়াত শিবিরের পক্ষ অবস্থান নেয় এবং ভিপি জিএস হামলাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়Ñ সেই ছাত্র সংসদে তিনি থাকবেন না। তাছাড়া এই বুয়েটের মধ্যেই একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যায় ছাত্রদলের ক্যাডারদের দ্বারা। ৮ জুন ২০০২ টেন্ডারবাজি নিয়ে সরকারী দলের ছাত্রফ্রন্ট ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের দু’গ্রুপের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে বুয়েটের মেধাবী ছাত্রী সনি মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় দুপুরে মসজিদের ভেতর কোরআন শরীফ তেলায়াতের সময় কৃষক লীগ নেতা এসএম আজমকে ক্ষমতাসীন দলের যুবদল ছাত্রদলের সন্ত্রাসী ক্যাডাররা মসজিদের ভেতরে ধারালো দা দিয়ে উপর্যুপরি কুপিয়ে হত্যা করে। সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটায় জোট সরকারের পুলিশ বাহিনী। গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলে ঢুকে পুলিশের নজিরবিহীন হামলা চালায় ছাত্রীদের ওপর। পুরুষ পুলিশেরা হল কক্ষের বাইরে থাকা মেয়েদের শুধু নির্যাতনই করেনি, গভীর রাতে কক্ষে বা বাগানে লুকিয়ে থাকা মেয়েদের চুল ধরে টানতে টানতে গাড়িতে ওঠানোর সময় বলেছেÑগৃহিণীরা তোমাদের তেজ গেল কোথায়? পত্রিকার সংবাদে জানা যায়, ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ বছরের বেশি সময় শান্তিপূর্ণভাবে পার হলেও ছাত্রী হলে পুলিশের হামলার ঘটনা সেটাই প্রথম। হলের ভেতরে এই অভিযানের নেতৃত্ব দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আবদুর রহিম। তিনি পুলিশের বিতর্কিত কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। সেদিন ধর্ষণ ছাড়া পুলিশ সব কিছুই করেছে। পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদলের কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসীও অংশ নিয়েছিল। এই হামলা ছিল নিজামী-মুজাহিদীর ’৭১-এর ২৫ মার্চের টেস্ট কেস। সেই কহিনুর মিঞা, শক্তি সঞ্চয় করে বিএনপির ক্যাডার হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত (এডিসি ডিবি)। চলবে... লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও আমেরিকা প্রবাসী
×