ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

ভিয়েতনাম ॥ পূর্ব এশিয়ার অনুসরণীয়

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১০ জুলাই ২০১৮

ভিয়েতনাম ॥ পূর্ব এশিয়ার অনুসরণীয়

এই বছরের মার্চের ৪ থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত আমি ছিলাম ভিয়েতনামেÑ বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের আমন্ত্রণে। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল তাদের সদস্য দেশসমূহের সংসদ সদস্যদের এই দুটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে স্ব স্ব দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক সাহায্য ও উন্নয়ন-অর্থায়ন এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিষয়সমূহে ইপ্সিত মাত্রায় গণসংবেদনশীলতা সৃজন ও প্রসারণে একটি আন্তঃসংসদীয় নেটওয়ার্ক ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত করে। এই নেটওয়ার্কের মোড়কে এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ এবং আফ্রিকার ৩০টি দেশের ৩০ জন সংসদ সদস্য ভিয়েতনামের সমকালীন আর্থ-সামাজিক প্রগতি সরেজমিনে প্রত্যক্ষ ও অনুধাবন করতে সে দেশের রাজধানী হ্যানয়ে মিলিত হন। এদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আমিও আমন্ত্রিত হয়ে যোগ দিয়েছিলাম। ভিয়েতনামের আয়তন প্রায় ১ লাখ ২৮ হাজার বর্গমাইল, সমকালীন লোক সংখ্যা ৯ কোটি ৬ লাখ বা প্রতি বর্গমাইলে ৭১৪ জন। মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি) প্রায় ২৫০ বিলিয়ন ও মাথাপিছু আয় ২৫৪৬ মার্কিন ডলার। এ দেশের সমকালীন গড় জীবন প্রত্যাশা ৭৫ বছর। লোক সংখ্যার ৭৩% ধর্মে অবিশ্বাসী, ১২% বৌদ্ধ ও ৮% খ্রীস্টান। এদের মধ্যে ৮৫% ফিনহ ও হুয়া সম্প্রদায়ভুক্ত এবং ১৫% বিভক্ত ৫৩টি নৃগোষ্ঠীতে। সমকালে লোক সংখ্যার ৭০% ৩৫ বছরের চেয়ে কম বয়সী। প্রশাসনিক ভাবে ভিয়েতনাম ৬৩টি প্রদেশে বিভক্ত। ভিয়েতনামের মুক্তির সংগ্রাম, হোচি মিনের অপরাজেয় বিপ্লবী নেতৃত্ব, যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও জনগণের বিজয় এবং উত্তর-দক্ষিণ ভিয়েতনামের একীভূত হওয়া ১৯৬০-এর দশক থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত আমাদের তরুণ জীবনে সবকিছুর ওপরে মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের নিলয় হিসেবে স্থান দিয়েছে। তেমনি ভিয়েতনামের নিরিখে ১৯৬০-এর দশক ও ১৯৭০-এর দশকের প্রথম ভাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম অপরাজেয় ও অনুসরণীয় বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এই সময়ে ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট ট্রান দাই কোয়াং ও প্রধানমন্ত্রী নওয়েন জুয়ান ফিক। দেশটির একক রাজনৈতিক দলÑ ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নগুয়েন ফু ট্রং সরকারের ও দলের প্রধান নির্বাহী হিসেবে প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী। আমি যখন ভিয়েতনামে তখন প্রেসিডেন্ট কোয়াং বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে সফর করছিলেন। এই প্রেক্ষিতে হ্যানয়ে রাজনৈতিক পর্যায়ে আলোচনার সময় দুই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন দিক, জনগণের দেশাত্ববোধ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও হোচি মিনের নেতৃত্ব, ত্যাগ ও তিতিক্ষা আমরা সকলে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছি। আমি অবাক হয়ে সুখকর বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছি ভিয়েতনামের সমকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুকে সারা পৃথিবীর জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণের অপরাজেয় সারথী হিসেবে মনে রাখছেন এবং তার কন্যা এদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সম্মান করছেন। আমাদের পরিদর্শন ও আলোচনার মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছেন, ভিয়েতনামে বিশ্বব্যাংকের দেশ-পরিচালক ওসমান ডিওন এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ভিয়েতনামস্থ আবাসিক প্রতিনিধি জোনাথান ডান। এরা দু’জনেই এই পদে যোগ দেয়ার আগে এক সময়ে ঢাকায় বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের আবাসিক অফিসে কাজ করেছেন। এই সুবাদে দু’জনেই আমার পূর্ব পরিচিত উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ও পরিচালক। তাদের অভিজ্ঞান, এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামে অনুসরণীয় আর্থ-সামাজিক কার্যক্রম শনাক্তকরণে আমাদের ধারণা অধিকতর শাণিত করতে পেরেছে। গত ৩০ বছরে ভিয়েতনামের দর্শনীয় উন্নয়ন অর্জন বিষয়ে তারা উভয়েই পরম শ্রদ্ধাশীল বলে আমার কাছে প্রতিভাত হয়েছে। তাদের কথা, ১৯৮০-এর দশকের পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশের পর্যায় থেকে ভিয়েতনাম সমকালীন পর্যায়ে মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত হয়ে একটি আধুনিক, সমৃদ্ধশালী ও অন্তর্ভুক্তীয় অর্থ ব্যবস্থায় উন্নীত হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে এ দেশের সমকালীন উন্নয়ন উদ্যম ও সফলতা আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের জন্যই অনুসরণীয় বলে বলা যেতে পারে। ভিয়েতনাম সফরে আন্তঃসংসদীয় প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিউনিসিয়া সংসদের অর্থ বিষয়ক কমিটির সভাপতি ওলফা সুকরি শেরিফ (মহিলা)। অন্যান্যের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসেছিলেন সংসদ সদস্য ইউনুস করিম, ইউক্রেন থেকে এসেছিলেন সংসদ সদস্য ওলগা বিয়েলকভা (মহিলা), ফিলিপিন্স থেকে এসেছিলেন জুয়ান এদগার্ডো আংগারা আর মিসর থেকে এসেছিলেন নেইলা তাজি (মহিলা)। এরা সবাই আমার পূর্ব পরিচিত। উন্নয়ন বিষয়ক অধিকাংশ কার্যক্রম বিষয়ে আমরা আগে থেকে ঐকমত্য পোষণ করে এসেছি। ভিয়েতনামের সমকালীন উন্নয়ন সমস্যা ও কার্যক্রম নিয়ে আমাদের মাঝে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে সে দেশের শিক্ষামন্ত্রী ফংজুয়ান নাহা, অর্থমন্ত্রী দিন তিয়েন দুং, জাতীয় সংসদের সভাপতি নগুয়েন থি কিম নাগান (মহিলা) এবং শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী ত্রাণ তুয়ান আনের সঙ্গে। সমকালীন অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি), মাথাপিছু আয় ও অন্যান্য আর্থ-সামাজিক সূচকের বিবেচনায় ভিয়েতনাম জাতিসংঘ কর্তৃক ইতোমধ্যে মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০০৮ ও ২০১৩-এর মধ্যে ভিয়েতনামের মাথাপিছু আয় প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। এই দেশের জনগণের সমকালীন গড় জীবন প্রত্যাশা প্রায় ৭৫ বছর এবং গড় সাক্ষরতার হার ৯২%+। ১৯৮০-এর দশকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ভিয়েতনাম এক কালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে অনুসরণ করে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার দর্শন নিয়ে পরিচালিত হয়ে আসছিল। ১৯৮৬ সাল থেকে ‘দইমই’ সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় ভিয়েতনাম বাজার অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী সব অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি উদ্যমকে উৎসাহিত ও প্রযুক্ত করে আসছে। সমকালে ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধির হার বার্ষিক ৮% এ প্রাক্কলিত হয়েছে। ভিয়েতনাম এই সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কাজুবাদাম ও কালোজিরা উৎপাদন করে। বিশ্ব রফতানিতে ভিয়েতনামের কফি ও চাল এখন দ্বিতীয় স্থানে। চা ও রবার উৎপাদনেও ভিয়েতনাম সামনের কাতারের দেশ। ভিয়েতনাম দেশের সিংহভাগ প্রয়োজন মেটানোর মতো পরিমাণে তেল উৎপাদন করে। খনিজ দ্রব্যাদির মধ্যে ভিয়েতনাম বকসাইট রফতানি করে। সমকালে ভিয়েতনামের শিল্প উৎপাদন বার্ষিক প্রায় ১৩% হারে বেড়ে চলছে। তৈরি পোশাক ও ইলেক্ট্রনিকস সামগ্রী উৎপাদনে সমকালে ভিয়েতনামের ভূমিকা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে। রোবট নির্মাণ ও মহাকাশ কার্যক্রমেও ভিয়েতনাম এগিয়ে এসেছে। সমকালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ভিয়েতনামের বার্ষিক বিনিয়োগ ব্যয় মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) প্রায় ০.৫০%-এ উন্নীত হয়েছে। ভিয়েতনামের রফতানির বড় অংশ যায় যুক্তরাষ্ট্রে আর আমদানির বড় অংশ আসে চীন থেকে। এদেশে সেবা খাতের সমকালীন প্রবৃদ্ধি বার্ষিক ৭.৫% হারে বেড়ে চলছে। মুদ্রাস্ফীতির হার বার্ষিক ২% এর চেয়ে নিচে রয়েছে। ভিয়েতনাম সমকালে ২০১৬-২০২০ এর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করে যাচ্ছে। এই পরিকল্পনার মৌল লক্ষ্য হলো সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন, উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতা বাড়ানো, অবকাঠামো উন্নয়ন, মানব-মূলধন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রসারণ। ভিয়েতনামের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে প্রতিভাত হয়েছে যে এই দেশের উন্নয়নে তিনটি মৌল উপকরণ কাজ করে এসেছে। এক. ভিয়েতনাম বিদ্যুত উৎপাদন ও বিতরণকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। বর্তমানে ভিয়েতনাম ৩৫ গিগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করছে এবং দেশের সকল গৃহস্থালিতে বিদ্যুত সংযোগ দিতে সক্ষম হয়েছে। এই পরিমাণ বিদ্যুতের ৪০% জল বিদ্যুত, ৪০% কয়লাভিত্তিক এবং ২০% গ্যাস দিয়ে উৎপাদিত। বার্ষিক বিদ্যুত উৎপাদনের ৩১% ব্যক্তি খাত উৎসারিত। বিদ্যুত উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের দ্রুত প্রসারণ ভিয়েতনামের শিল্প ও সেবা ক্ষেত্রে প্রক্ষেপিত উৎপাদন বাড়ানোর মৌল ভিত্তি হিসেবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। ২০০৪ সাল থেকে সুনির্দিষ্ট আইনের আওতায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পূর্বেকার উলম্বিক ব্যবস্থাপনায় থমকে যাওয়া বিদ্যুত উৎপাদনের বিকল্পে তারা ব্যক্তি খাতকে টেনে এনেছে। নিপুণতর ও মিতব্যয়ী ব্যবস্থাপনার আওতায় সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে এবং আপেক্ষিকভাবে বিদ্যুতের দাম কমিয়ে ভিয়েতনাম সারাদেশে বিদ্যুত উৎপাদন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে সফলতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ২০০৬ সালে বিদ্যুত নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত করে ভিয়েতনাম ব্যক্তি মালিকানায় বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য লাইসেন্স প্রদান, বিদ্যুত খাতের সম্প্রসারণ কার্যক্রম সংস্কার, প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থায়নের ব্যবস্থাকরণ এবং বিদ্যুতের মূল্য বিন্যাস করার দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করে আসছে। বিশ্বব্যাংক ব্যক্তি খাতে বিদ্যুত উৎপাদন বাড়ানোয় প্রভূত সহায়তা দিয়ে আসছে। ২০০৮ সালে উৎপাদন থেকে বিদ্যুতের সঞ্চালন ও বিতরণ পৃথকীকৃত করা হয়েছে। সার্বিকভাবে এক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির যে কার্যক্রম ভিয়েতনামে গ্রহণ করা হয়েছে তা ২০২০ সালের মধ্যে অতিরিক্ত ৫০ গিগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করতে পারবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। সাম্প্রতিককালে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী বাংলাদেশে বিদ্যুত উৎপাদন বাড়ানো ও এর ব্যবহার নিপুণতর করার কার্যক্রম ভিয়েতনামের মতো সফলতা দেবে বলে আমাদের স্থির বিশ্বাস। এ বিষয়ে আলোচনাক্রমে ভিয়েতনামী নেতাদের আমি তাই বলেছি। দুই. কৃষি উৎপাদন বাড়ানোয় ভিয়েতনাম কাঠামোগত পরিবর্তন ও প্রযুক্তিক বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে গেছে। ফলত দারিদ্র্য কমেছে, রফতানি বেড়েছে, জনস্বাস্থ্যের পুষ্টিতে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। আমাদের দেশের কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রযুক্তির উপকরণ প্রয়োগ ও রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বাড়ানোর কার্যক্রম ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতার আলোকে অধিকতর শাণিত করা এক্ষেত্রে আমাদের সফলতাকে আরও বিস্তৃত করতে পারবে বলে মনে হয়েছে। আমার সঙ্গে আলোচনাক্রমে এক্ষেত্রে ভিয়েতনামের নীতি-নির্ধারকরা বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবেন বলে বলেছেন। তিন. ভিয়েতনাম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সড়ক ও রেল যোগাযোগ সৃষ্টি করে ও বাড়িয়ে সারাদেশকে একটি একক বাজারে রূপান্তরিত করেছে এবং ফলত কৃষি, শিল্প ও সেবা সামগ্রীর উৎপাদন বেড়েছে। জাপানের সহযোগিতায় এই দেশ সত্বর বুলেট ট্রেন প্রতিষ্ঠা করনে এগিয়ে চলছে। সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিশেষত সড়ক অবকাঠামোর প্রসারণÑ এক্ষেত্রে ভিয়েতনামে অর্জিত সুফলের পথ ধরে ইপ্সিত উপযোগ দেবে বলে আমার বিশ্বাস। অবশ্য বলা প্রয়োজন, ভিয়েতনামের সড়ক নির্মাণ ব্যয় আমাদের দেশের নির্মাণ ব্যয়ের চেয়ে বেশ কম এবং তাদের সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের কার্যক্রম অধিকতর স্বয়ংক্রিয় ও ফলপ্রসূ বলে আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়েছে। আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপকরা সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারবেন বলে আমার মনে হয়েছে। চার. ভিয়েতনাম প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারণে এবং উচ্চ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা প্রসারণে গুরুত্ব দিয়ে জাতির চেতনাবোধ ও সক্ষমতাকে বাড়িয়েছে। জরিপে দেখা গেছে যে, দেশের ৫ বছর বয়স্ক সব শিশুর ৯৫% সংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। এদের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায় থেকে উত্তীর্ণ ৮৫% সংখ্যক নি¤œ মাধ্যমিক এবং ৬৫% উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা লাভ করছে। শিক্ষার বিস্তারণের এই বিন্যাস আমাদের দেশে এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক অর্জনের অনুরূপ। অবশ্য ভিয়েতনামের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার মান আমাদের কাছে অধিকতর শাণিত বলে প্রতিভাত হয়েছে। ভিয়েতনামের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়, কিনহ ও হুয়ার বাইরে বিদ্যমান ৫৩টি নৃগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এই মাত্রার শিক্ষার সর্বজনীনতা এখনও অর্জন করা সম্ভব হয়নি। আমাদের দেশকে আমরাও শিক্ষার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পথে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি বলে আমাদের আলোচনায় সবাই স্বীকার করেছেন। ভিয়েতনামে বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার বাণিজ্য উদারীকরণ ও প্রসারণ বিষয়ে আলোচনা করেছি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আন্তঃপ্রশান্ত মহাসাগরীয় অংশীদারিত্ব বা টিপিপি থেকে সরে যাওয়া ভিয়েতনামকারীদের কাছে উদ্বেগজনক বলে মনে হয়েছে। তাদের ধারণাÑ এবং ওই ধারণার আমরাও অংশীদারÑ এর ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব তীরবর্তী অঞ্চলে চীনের প্রভাব দ্রুত বাড়বে। ফলত জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালেয়শিয়া পাশ্চাত্যের প্রভাবের ও সহায়তার বলয় থেকে ক্রমান্বয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। এই বিষয়ে পারস্পরিক আলোচনায় বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য উদারীকরণ সব দেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে বলে আমরা সকলে একমত হয়েছি। ১৯৮৬ সাল থেকে ভিয়েতনামে ব্যক্তি খাতের গুরুত্বের ফলপ্রসূ বিষয়ে আলোচনাক্রমে একটি বিষয়ে তারা আমাদের সচেতন করতে চেয়েছেন। তারা বলেছেন যে, প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যক্তি খাতের প্রসারণে তাদের সরকার সময়ান্তরে প্রশাসন পরিচালনায় ব্যক্তি ও সরকার পর্যায়ে কিয়দংশে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও চুক্তিনির্ভরতার প্রতিফলক এমনকি শিকার হয়ে সার্বিকভাবে জনগণের স্বার্থ এবং রাজনৈতিক দর্শন ও প্রতিষ্ঠান অবহেলা করার পর্যায়ে নেমে গিয়েছিল। ফলত জনসমর্থন ও জনআনুগত্যের বাইরে গণতন্ত্রের প্রতিকূলে সরকার কিয়দংশে ব্যক্তি-উদ্যোগ উৎসারিত চুক্তি বা সমঝোতার প্রভাবে পরিচালিত হচ্ছিল। অন্যান্য দেশে ব্যক্তি-উদ্যমকে প্রদানীয় গুরুত্ব যাতে এই ধরনের অসঙ্গতির সৃষ্টি না করে সে বিষয়ে তারা আমাদেরকে যথা ইপ্সিত সতর্ক থাকার প্রয়োজন বিষয়ে সতর্ক করেন। এক্ষেত্রে তাদের চেতনাবোধ আমাদের দেশে সমকালীন আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রম অধিকতর শাণিত ও লক্ষ্যানুগ করবে বলে মনে হয়েছে। আমাদের ইচ্ছা ছিল আমরা হো চি মিন নগরে যাব। এক কালের সায়গন এখন এদেশের প্রধান নগরী হিসেবে হো চি মিন নাম ধারণ করেছে। এ দেশের জনগণের তাদের স্বাধীনতার সারথী হো চি মিনের জন্য রয়েছে অপরিসীম শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধ। দেশের প্রতি এদেশের সকল মানুষের প্রশ্নাতীত আনুগত্য আমাদের মুগ্ধ করেছে। এদেশের লিঙ্গ সমতা আমাদের অন্যান্য সকল দেশের জন্য অনুকরণীয়। আমরা রাজধানী হ্যানয় বা অন্য কোন শহর গ্রামে কোন ভিক্ষুক দেখিনি। তেমনি অনুপার্জিত আয় উৎসারিত আলস্যে কর্মহীনতাকে প্রশ্রয় দেয়ার কোন দৃশ্য বা উদাহরণ আমাদের সামনে ধরা দেয়নি। ভিয়েতনামীদের সঙ্গে আলোচনার উপসংহারে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রের বাইরে ও রাজনৈতিক আনুগত্যের ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম থেকে আমাদের এশিয়া ও আফ্রিকার সকল উন্নয়নকামী দেশের অনুসরণিকা গ্রহণ কর্মানুগ মনে হয়েছে। লেখক : সাবেক মন্ত্রী
×