ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চাঁপাইয়ে গাছে গাছে ঝুলছে নাবি জাতের আম

আশ্বিনায় আশাবাদী-ক্ষতি পুষিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে চাষী

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১০ জুলাই ২০১৮

আশ্বিনায় আশাবাদী-ক্ষতি পুষিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে চাষী

ডি.এম তালেবুন নবী ॥ গাছে গাছে, থোঁকায় থোঁকায় আম ঝুলছে। কিন্তু বাজারে মূল্যহীন, দাম নেই। কানসাটসহ ৪১ বাজার খাঁ খাঁ করছে ক্রেতার অভাবে। তারপরেও আশা ছাড়েননি আম চাষীরা। তাদের আশা, এই বছরই ক্ষতি পুষিয়ে তারা ঘুরে দাঁড়াবে। আর সেই আশা জুগিয়েছে গাছে গাছে ঝুলে থাকা ‘নাভিজাত’ আম। আরও মাস খানেক সময় নিয়ে পাকন ধরবে আশ্বিনাসহ ১১২ ধরনের গুটি আম। এদিকে বাজারে বিভিন্ন জেলার পাইকার ও ব্যাপারী নামতে শুরু করেছে। প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়ছে আমের দাম। মৌসুমের শুরুতে দাম না থাকায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম ব্যবসায়ীরা ক্ষক্ষিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় আড়াই শত কোটি টাকার। জেলার ৪টি বড় আম বাজারে দেড় লাখ শ্রমিক কাজ করত। তাদের সংখ্যা এবার নেমে ৩০ হাজার ঠেকেছে। এই দেড় লাখ শ্রমিক মাত্র তিন মাসে সারাবছরের আয় ঘরে তুলত। বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী ব্যাংক মিলিয়ে ৬১টি শাখা আম মৌসুমে বাড়তি কর্মচারী দিয়ে আম ব্যবসায়ীদের টাকা লেনদেন করত। সেখানে এখন মাত্র ৫টি প্রধান ব্যাংকের শাখা এই কাজ করছে। প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে হাজারেরও অধিক আম ভর্তি ট্রাক ছেড়ে যেত। সেখানে এবার দেড়শত ট্রাক আম ভর্তি হয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছে। উচ্চশিক্ষা দিত তারাও এখন এসব বড় শহর ছেড়ে দেশের সর্ববৃহৎ আম বাজার কানসাটে প্রতিবছর প্রায় চারশত আড়ত থাকলেও এবার তা কমে শতাধিকে এসেছে। এত সবের পরেও হঠাৎ করে মৌসুমের শেষ সময়ে উৎকৃষ্ট মানের ক্ষিরশাপাত আমের দাম কিছুটা বেড়েছে। মৌসুমের শুরুতে মাত্র আটশত টাকায় ৪৫ কেজি ধরে এক মণ আম পাওয়া যেত তা এখন দুই হাজারে গিয়ে ঠেকেছে। এছাড়া জৈষ্ঠ্য মাসে উঠা গোপাল ভোগসহ প্রায় শতাধিক গুটি আম বিক্রি হয়েছে পানির দামে। দুই থেকে আড়াইশত টাকা মণ। এছাড়াও এবার সর্বশ্রেষ্ঠ গুটিজাত আম ক্ষিরশাপাত আমে অধিক পচন ধরায় আম চাষীরা বিব্রত কর পরিস্থিতির মধ্যে ছিল। এক বেসরকারী পরিসংখ্যানে জানা যায় এবার ক্ষিরশাপাতসহ প্রায় দুই শতাধিক গুটি জাত আম পচেছে দেড়শত কোটি টাকার। দেশে এ বছর কত লাখ টন আম উৎপাদিত হয়েছে সে তথ্য পেতে আরও সময়ের প্রয়োজন হবে। তবে ধারণা করা হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও নওগাঁ জেলায় এবার আমের উৎপাদন ১০ লাখ টনের আশপাশে থাকবে। কৃষি সম্প্রসারণের ধারণা এই জেলায় এবার সাড়ে তিন লাখ টনের আশে পাশে থাকবে আমের উৎপাদন। তবে বেসরকারী হিসাবে এবার জেলায় সাড়ে চার লাখ টন আম উৎপাদিত হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভিমত এর পরিমাণ আরও বেশি। প্রতিবছর আম থেকে আয় হয় আনুমানিক আড়াই হাজার কোটি টাকা। জেলায় ৩০টি আমের বাজার থাকলেও ৪টি বড় বাজার সকলের নজর কেড়েছে। দেশের সর্ববৃহৎ আম বাজার কানসাট, তারপর ভোলাহাট আম ফাউন্ডেশান বাজার, রহনপুর রেল স্টেশন আম বাজার ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর ঘাট আম বাজার। উল্লেখ্য, ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বড় আকারের ও পরিমাণে অধিক আম উৎপাদিত হয় পশ্চিম বাংলার মালদহে। শিবগঞ্জ উপজেলার একটি বড় অংশ, ভোলাহাট উপজেলার পুরোটা ও গোমস্তাপুরের আংশিক আমের স্বাদে গন্ধে মালদহ আমের প্রভাব রয়েছে। ভোলাহাট থেকে মালদাহ ইংরেজ বাজার দূরত্ব মাত্র কয়েক কিলোমিটার। তাই ভোলাহাট আম ফাউন্ডেশানের আম বাজারে এসে যুক্ত হয়ে থাকে মালদহের আম। পাশাপাশি আসে মুর্শিদাবাদের আম। এখানকার বহু আম ব্যবসায়ী মালদহ এলাকার আম বাগান কিনে থাকে। এক হিসাবে জানা গেছে, প্রতি আম মৌসুমে ভারতের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ থেকে সহস্রাধিক টন আম বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এছাড়াও বৈধ পথেও ভারতের আম আমদানি করে থাকে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী সোনামসজিদ স্থল বন্দর দিয়ে। যার কারণে শিবগঞ্জ ও ভোলাহাট অঞ্চলে প্রতি আম মৌসুমে যে ভারতীয় আম বৈধ, অবৈধ পথে আসে তা থেকে বোঝার উপায় থাকে না এখানকার ব্যবসায়ীরা কী ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। এবারও এত সঙ্কটের মধ্যেও ভারতীয় আম আসা অব্যাহত রয়েছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার আম গাছকে জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে ঘোষণা করে। আম গাছকে জাতীয় বৃক্ষ ঘোষণা করার ৪ বছরের মাথায় ২০১৪ সালে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার আম বাণিজ্য হয়েছিল। ২০১১ সালে সাড়ে তিনশত কোটি টাকা, আর আগের বছর ২৫০ কোটি টাকার আম বাণিজ্য হলেও এ বছর পাঁচ হাজার কোটিার বাণিজ্য হবার কথা। কিন্তু মৌসুমের কারণে এবং অনেক পরে মুকুল আসায় সময় মতো আমের বাজার ধরা সম্ভব না হবার কারণে ইতোমধ্যেই ক্ষতি হয়ে গেছে কয়েকশত কোটি টাকার। বিশ্বের আম উৎপাদনে বাংলাদেশ নবম স্থান থেকে কিছুটা ওপরে উঠে আসলেও এ বছর শুধু এখন পর্যন্ত তিন হাজার পাঁচশত কোটি টাকার ক্ষতি গুণতে হয়েছে আম ব্যবসায়ীদের। কৃষিবিদরা বলছেন আমকে ঘিরে কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, ভিটামিন ও হরমোন জাতীয় নানা ধরনের রাসায়নিক ব্যবসা হয়ে থাকে একশত কোটি টাকার। কিন্তু এবার ব্যবসা হয়েছে ঠিকই। তবে যারা এটা ব্যবহার করেছে তারা আমের দর না থাকায় সমপরিমাণ অর্থ হারিয়েছে। শুধু তাই নয় আম বাগানে কর্মরত ব্যক্তি, আম পরিবহন, খুচরা পর্যায়ের বিক্রি মিলিয়ে এখানে কর্মসংস্থান হয়ে থাকে দেড় থেকে দুই লাখ মানুষের। সারাদেশ থেকে কত টাকার আম বাণিজ্য হয় এর কোন সঠিক তথ্য আম ব্যবসায়ীদের কাছে নেই। তবে বিভিন্ন পর্যায়ের আম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এ বছর তারা চাঁপাই থেকে শুধু পাঁচ হাজার কোটি টাকার আম বাণিজ্য করার আশা করেছিল। কিন্তু প্রথম চটেই আম থেকে বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হবার কারণে ব্যবসায়ীরা হাত পা ছেড়ে দিয়েছে। শিবগঞ্জের ব্যবসায়ী এমরান আলি জানান, তিনি শুধুমাত্র ক্ষিরশাসহ ২১ গুটি জাত আম থেকে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার পুঁজি হারিয়েছে। একই চিত্র সহস্র্রাধিক ব্যবসায়ীর। এরপরেও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের আসা তারা এ বছরই ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। তাদের আশার মধ্যে রয়েছে নাভীজাত আম। তারা আশা করছেন ফজলী, সুরমা ফজলী, কুমা পাহাড়ী, আশ্বিনা, আম্রপালিসহ প্রায় সাড়ে তিনশত গুটি জাতের আম আগস্ট সেপ্টেম্বরে বাজারে আসবে। এসব আমের চড়ামূল্য তারা পাবে। আর তাদের লোকসান পুষিয়ে নিবে এসব আম থেকে। জেলায় দেড় হাজার জাতের আম রয়েছে। তবে তারা বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আম রফতানি বন্ধ হবার কারণে। মৌসুমের এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী নিম্নমানের কাচা আমে ফরমালিন মিশিয়ে পাকিয়ে রফতানি করায় বিদেশীদের কাছে ধরা খেয়েছে। তারা বাংলাদেশ থেকে ইতোমধ্যে আম রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। তারপরেও প্রক্রিয়াজাত আম থেকে নানান ধরনের জুস, ড্রিঙ্কস ও চাটনি, আচার তৈরি করে তা পুষিয়ে নিতে পারবেন। যার কারণে ২০১২-১৩ অর্থ বছরে এ দেশ থেকে ১ কোটি ৩১ লাখ ৩৫ হাজার ডলার মূল্যের আম ছয় লাখ ৪০ হাজার ডলারে আচার ও চাটনি রফতানি হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, দুবাই, সৌদি, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন ওমান, মালয়েশিয়া, ভারত, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ানভুক্ত দেশে রফতানি হয়। তাই চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে হলে যে আম রয়েছে এখন গাছে রয়েছে তা থেকে প্রক্রিয়াজাত করে পণ্য রফতানি করলে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। জানা গেছে, জেলায় ৬০ হাজার আশ্বিনা আমের গাছ রয়েছে। এসব গাছে এবার প্রচুর আম এসেছে। ফজলী ও সুরমা ফজলীর গাছ রয়েছে সমপরিমাণ, আম্র্রপালি ও মল্লিকার গাছ রয়েছে লক্ষাধিক। এছাড়াও গুটি জাতের আম গাছ রয়েছে ২০ হাজারের মতো। লক্ষণ ভোগ গাছ রয়েছে ৮০ হাজারের মতো। এছাড়াও রয়েছে গৌড় মতির মতো (অনেকটা ল্যাংড়ার কাছাকাছি) আম। যা নামলা ও নাভী জাত। বাজারে আসবে মাসখানেক পরে ও তার মধ্যে, শুধুমাত্র আশ্বিনার প্রক্রিয়াজাত পণ্য বিক্রি করে এবারের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। এজন্য সরকারীভাবে এগিয়ে আসতে হবে বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়কে। এবারের আম চাষীদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে না পারলে আম চাষীরা বিরুপ হতে পারে। কমিয়ে দিতে পারে আম চাষ। যেমন মাত্র ১০ বছরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের আবাদ ১৯ হাজার হেক্টর থেকে ৩০ হাজার হেক্টরে উন্নতি হয়েছে। এ ধারা বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা দরকার।
×