ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারের বিধান রেখে কৃষি নীতি অনুমোদিত

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১০ জুলাই ২০১৮

ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারের বিধান রেখে কৃষি নীতি অনুমোদিত

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ কৃষি ক্ষেত্রে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার, প্রতিকূল পরিবেশ অঞ্চলের জন্য কৃষি কর্মসূচী গ্রহণ, সঙ্কটাপন্ন অঞ্চলের পানি উত্তোলনের সতর্কতা অবলম্বনের বিষয় যুক্ত করে নতুন ‘জাতীয় কৃষিনীতি-২০১৮’ এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। কৃষকদের জন্য কৃষিকে নিরাপদ এবং লাভজনক করে তুলে জনগণের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্যে এই কৃষিনীতির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ শিশু একাডেমি আইন-২০১৮ এর খসড়াও অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভা বৈঠকে এ খসড়ার অনুমোদন দেয়া হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের একথা বলেন। তিনি বলেন, আমাদের আগের কৃষিনীতি ২০১৩ সালের। এর মধ্যে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। সেটাকে আরেকটু হালনাগাদ করে নিয়ে আসা হয়েছে। ওটাকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করা হয়েছে। অনেক বিষয় এখানে এ্যার্ড্রসে করা হয়েছে যেগুলো আগের নীতিতে নেই। এটা বেশ ডিটেইল ও রিচ বলতে পারেন। নতুন কৃষিনীতিতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। আগে ছিল ১৮টি অধ্যায় ও ৬৩টি অনুচ্ছেন। সেখানে এখন ২২টি অধ্যায় ও ১০৬টি অনুচ্ছেদ ও উপ-অনুচ্ছেদ হয়েছে। নতুন কৃষিনীতির অধ্যায়গুলো তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, প্রথমে রয়েছে ভূমিকা, দ্বিতীয় অধ্যায়ে জাতীয় কৃষিনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে কৃষি উন্নয়নে গবেষণা। গবেষণার ক্ষেত্রে ১৯টি ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, অন্যান্য অধ্যায়ের মধ্যে রয়েছে প্রযুক্তি হস্তান্তর ও কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষি উপকরণ, খামার যান্ত্রিকীকরণ, জ্ঞান ও দক্ষতা উন্নয়ন, কৃষির পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা, বিশেষ আঞ্চলিক কৃষি, বিশেষায়িত কৃষি, নিরাপদ খাদ্য ও কৃষি পণ্য উৎপাদন, কৃষি বিপণন, নারী ক্ষমতায়ন, কৃষিতে যুবশক্তি, কৃষিতে বিনিয়োগ, কৃষি সমবায়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, কৃষি খাতে শ্রম, সমন্বয় ও সহযোগিতা, বিবিধ বিষয়- এর মধ্যে মেধাস্বত্ব, জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) এগুলো আছে। এছাড়া রয়েছে বাংলা ভাষার প্রাধান্য ও উপসংহার অধ্যায়। শফিউল আলম বলেন, আগে যেটা ছিল না, ন্যানো প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়টি এখানে আনা হয়েছে। মান ঘোষিত বীজ উৎপাদন ও নগরকেন্দ্রিক কৃষি সম্প্রসারণ সেবা- এ বিষয়টিও আগে ছিল না নতুন নীতিমালায় তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ন্যানো প্রযুক্তিকে গবেষণা বিষয় হিসেবে দেখানো আছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ফসলের রোগ, ফসলের জাতভিত্তিক পুষ্টি চাহিদা নির্ণয়, পুষ্টি আহরণ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। ন্যানো সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভূমির গুণাগুণ পর্যবেক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। এগুলো সবই গবেষণা অংশ। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সেবা, উদ্ভাবনী সম্প্রসারণ প্রযুক্তি, প্রযুক্তি ব্লক স্থাপন, বছরব্যাপী ফল উৎপাদন ইত্যাদি এগুলো আগে ছিল না, নতুনভাবে সংযোজন করা হয়েছে। প্রতিকূল পরিবেশ অঞ্চলের জন্য কৃষি কর্মসূচী গ্রহণের বিষয়টি একটি অনুচ্ছেদে আলাদাভাবে অধ্যায় করে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। কৃষি উপকরণের বিষয়টিও নীতিতে সংযোজন করা হয়েছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তিনি আরও বলেন, ‘সুষম জৈব-জীবাণু সার ব্যবহারের বিষয়টি সাধারণভাবে বর্ণিত ছিল, এটা আরও একটু বিস্তারিত বলা হয়েছে। উপকারী পোকা ও জৈব বালাইনাশক বিষয়ে উল্লেখ ছিল না। সেটা নতুনভাবে সংযোজন করা হয়েছে। সম্পূরক সেচ ও পানি পুনর্ব্যবহারযোগ্য পদ্ধতি অনুসরণ করার বিষয়টি নতুনভাবে সংযোজন করা হয়েছে। এছাড়া পাতকুয়া, ফিতা পাইপ ব্যবহার ও রাবার ড্যাম নির্মাণের বিষয়ে কোন বিষয় অন্তর্ভুক্তি ছিল না, সেটা এই নীতিমালায় আনা হয়েছে। শফিউল আলম আরও বলেন, সঙ্কটাপন্ন অঞ্চলের পানি উত্তোলনের সতর্কতা অবলম্বনের কোন ইঙ্গিত ছিল না আগের নীতিতে, এটা নতুনভাবে নিয়ে আসা হয়েছে। কৃষি যন্ত্রপাতির মান পরিবীক্ষণ, দক্ষ জনশক্তি উন্নয়ন ও সেবা প্রদানকারী উদ্যোক্তা গঠন বিষয়টিও নতুন নীতিমালায় সংযুক্ত করা হয়েছে। দক্ষতা উন্নয়নে জিআইএস (জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেমস), রিমোট সেন্সিং, ক্রপ মডেলিং, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার, স্থানীয় ও জাতীয় সমস্যা ভিত্তিক উচ্চশিক্ষা নেয়ার বিষয়টিও নতুনভাবে নীতিমালায় আনা হয়েছে বলেও জানান তিনি। সামুদ্রিক শৈবাল কৃষির ধারণায় নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এমন বেশ কিছু জিনিস অন্তর্ভুক্ত করে কৃষিনীতি সমৃদ্ধ করা হয়েছে। আর মন্ত্রিসভার আলোচনাতে পাট নিয়ে একটি আলাদা অধ্যায় এখানে সংযোজন করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া তিল, তিশি- এখানে যাতে আসে সেটা নিশ্চিত করার জন্য বলা হয়েছে। আর সমবায়কে যেন একটু গুরুত্ব দেয়া হয়। সমবায়ভিত্তিক খামার ব্যবস্থাপনা সেটার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। নতুন কৃষিনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, লক্ষ্য হচ্ছে নিরাপদ ও লাভজনক কৃষি এবং টেকসই খাদ্য পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন। প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে ফসলের উৎপাদনশীলতা, উৎপাদন ও কৃষকের আয় বৃদ্ধি, শস্য বহুমুখীকরণ, পুষ্টি সমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন, লাভজনক কৃষি ও দক্ষ প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন। শিশু একাডেমি আইন ॥ মন্ত্রিসভা বাংলাদেশ শিশু একাডেমি আইন-২০১৮ এর খসড়াও অনুমোদন দেয়। ১৯৭৬ সালের একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে এতদিন বাংলাদেশ শিশু একাডেমি পরিচালিত হচ্ছিল উল্লেখ করে শফিউল আলম বলেন, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এবং মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সামরিক শাসনামলে জারি করা অধ্যাদেশগুলোকে বাংলায় রূপান্তর করে নতুন আইন প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা থেকেই এটি বাংলায় অনুবাদ করে নতুন আইন হিসেবে নিয়ে আসা হয়েছে। নতুন আইনে বড় রকমের কোন পরিবর্তন নেই। একটি নতুন ধারা এখানে সন্নিবেশন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সেটি হচ্ছে পরিচালনা ও প্রশাসন সম্পর্কিত একটি ধারা। সেই ধারা মোতাবেক সাধারণ পরিচালনা ও প্রশাসনের দায়িত্ব বোর্ডের ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং একাডেমি যে সকল ক্ষমতা প্রয়োগ ও কার্যসম্পাদন করতে পারবেÑ বোর্ড ও সকল ক্ষমতার প্রয়োগ ও কার্যসম্পাদন করতে পারবে। তিনি বলেন, এটি পরিচালনার জন্য ১৭ সদস্যের একটি বোর্ড গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। যেখানে একাডেমির চেয়ারম্যান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের একজন প্রতিনিধি, অর্থ এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন করে প্রতিনিধি, তথ্য এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একজন করে প্রতিনিধি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য বিভাগ এবং শিশুকল্যাণ বিভাগের একজন করে প্রতিনিধি, শিশুদের কল্যাণে অবদান রাখেন এমন ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে সরকার মনোনীত চারজন ব্যক্তি-যাদের দুজন হবেন মহিলা এবং একাডেমির মহাপরিচালক। এর সঙ্গে আইসিটি বিভাগের একজন প্রতিনিধি যুক্ত করার জন্যও নতুনভাবে বলা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, একাডেমিক কার্যাবলী আগে যা ছিল প্রায় তাই থাকবে, কেবল সামান্য কিছু পরিমার্জন করা হয়েছে। শিশুর বিকাশ ও কল্যাণে ভূমিকার জন্য শিশু একাডেমি থেকে সাম্মানিক ফেলোশিপ প্রদানেরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, একটি বিধি অনুযায়ী চেয়ারম্যানের নিয়োগের হবে, যে বিধি প্রণয়নের কাজ এখনও চলছে। ভাষা, সাহিত্য বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সামাজিক বিষয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে এমন ব্যক্তিবর্গই সরকার কর্তৃক চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন। যিনি সরকারী কর্মচারীও হতে পারেন বলে সাংবাদিকদের এ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। এই আইনের ১০ ধারায় মহাপরিচালক নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে- মহাপরিচালক একজন সার্বক্ষণিক কর্মকর্তা হবেন এবং তার চাকরির শর্তাবলী অনুযায়ী পরিচালিত এবং বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে। প্রতি ছয় মাসে কমপক্ষে একবার বোর্ডেও সভা হতে হবে এবং এই সভা কোথায় কখন কীভাবে হবে তা চেয়ারম্যান কর্তৃক নির্ধারিত হবে। আর কোরামের জন্য এক-তৃতীয়াংশ সদস্যের উপস্থিতি থাকতে হবে। চেয়ারম্যান সার্বক্ষণিক হবেন না, বোর্ডসভা যখন থাকে তখন তিনি দায়িত্ব পালন করবেন।
×