ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিভিন্ন পর্যায়ের চাপ, চিকিৎসা বঞ্চিতদের কঠোর মনোভাব

অবৈধ ধর্মঘট স্থগিত ॥ চট্টগ্রামে হাসপাতাল মালিকদের

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১০ জুলাই ২০১৮

অবৈধ ধর্মঘট স্থগিত ॥ চট্টগ্রামে হাসপাতাল মালিকদের

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যাপক চাপ, সচেতন সাধারণ মহল এবং চিকিৎসা বঞ্চিতদের কঠোর মনোভাবের জের হিসেবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রবিবার দুপুর থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রামজুড়ে বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের অন্যায় ও অবৈধ ধর্মঘট স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। রবিবার দুপুর ১২টার দিকে মালিক পক্ষের তাৎক্ষণিক ডাকা এই অবৈধ ধর্মঘটে সৃষ্ট অচলাবস্থার পর বিষয়টি কোন পক্ষই মেনে নেয়নি। খোদ বিএমএ ও স্বাচিবের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকেও কোন সমর্থন মিলেনি। অচলাবস্থা অব্যাহত রাখা হলে ক্ষোভে ফুঁসে উঠা চিকিৎসা প্রত্যাশী ও সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে বিষয়টি আরও জটিল রূপ নিতেও পারেÑ এমন ধারণা আঁচ করতে পেরেই ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পিছুটান দেন মালিকরা। ঘোষণা দেন আন্দোলন স্থগিতের। এর ফলে বৃহত্তর চট্টগ্রামজুড়ে বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিকে চিকিৎসারত ও চিকিৎসা গ্রহণ প্রত্যাশীদের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান সমিতির সভাপতি ডাঃ আবুল কাশেম সোমবার দুপুরে প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, পরিবেশ পরিস্থিতি ও রোগীদের দুর্ভোগের বিষয় চিন্তা করে তারা চট্টগ্রামে সকল বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ধর্মঘট সাময়িক স্থগিত করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তারা অনেক কষ্টের মাধ্যমে বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক প্রতিষ্ঠা করেছেন। তারা সেগুলো সুষ্ঠুভাবে চালাতে চান। এসব প্রতিষ্ঠানের ভুল ভ্রান্তি সংশোধন করবেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি লাখ লাখ টাকা জরিমানা করা হয় তা তারা কিভাবে পরিশোধ করবেন? এ বিষয়টি বিবেচনায় এনে ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল। এ ধর্মঘটে সাময়িক দুর্ভোগের জন্য তারা রোগীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। উল্লেখ্য, গত ২৮ জুলাই সাংবাদিক রুবেল খানের একমাত্র শিশু কন্যা গলাব্যথা ও জ্বর নিয়ে চট্টগ্রামের মেহেদীবাগস্থ ম্যাক্স হসপিটালে ভর্তি হয়। ২৯ জুলাই রাতে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনা নিয়ে রুবেল খান ও পরিবারের পক্ষে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসা ও অবহেলার অভিযোগ উঠলে চট্টগ্রামের সাংবাদিক সমাজ ঘটনার তদন্ত ও দায়ীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনে নামে। পক্ষান্তরে, ডাক্তারদের পক্ষে তাদের সংগঠন বিএমএ ও বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত ড্যাব নেতারাও সভা সমাবেশ, সড়ক অবরোধ ডেকে আন্দোলনসহ সব ধরনের হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়। শুধু তাই নয়, ড্যাব-এর একজন নেতা সাংবাদিকদের প্রয়োজনে ‘মাইর’ দেয়ার হুমকিও প্রদান করেন। এছাড়া বিএমএর একজন নেতা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অশোভন বক্তব্য দান ছাড়াও সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকেও হুমকি প্রদান করে। এ ঘটনা দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন, অনলাইন রেডিও টিভি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। এ ঘটনা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিফতরের পক্ষে একটি ও স্থানীয় পর্যায়ে দুটি তদন্ত কমিটি হয়। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনসহ স্থানীয় পর্যায়ে দুটি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ইতোমধ্যে পেশ করা হয়েছে। এতে সাংবাদিক কন্যার মৃত্যুর মূল কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট তিন চিকিৎসকের অবহেলা এবং আনুষঙ্গিক অব্যবস্থাপনার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। চট্টগ্রামের সাংবাদিকরা রুবেল খানের কন্যার অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুকে ‘হত্যাকা-’ হিসেবে দাবি করে বিচার চেয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। পক্ষান্তরে বিএমএ ও ড্যাব নেতারা সহকর্মীদের ত্রুটি ঢাকতে সোচ্চার ভূমিকা গ্রহণ করে, যা সাধারণ মানুষ কোনভাবে সমর্থন দেয়নি। উপরন্তু দোষী ডাক্তারদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ভূমিকা গ্রহণ করে। এ অবস্থায় গত রবিবার র‌্যাব, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও ওষুধ প্রশাসনের যৌথ অভিযান হয় চট্টগ্রামের কয়েকটি বেসরকারী ক্লিনিক ও হাসপাতাল। প্রথমে সকাল ১০টার পর অভিযান হয় সেই বহুল আলোচিত ম্যাক্স হসপিটালে। সেখানে অভিযানে নেতৃত্বদানকারী ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্য কর্মকর্তারা অজ¯্র অনিয়মের চিত্র উদঘাটন করেন। ফলে হসপিটালটিকে তাৎক্ষণিকভাবে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এরপর চলে সিএসসিআর নামক আরেকটি ক্লিনিকে। সেখানেও অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের নানা চিত্র পাওয়ায় সেটিকে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এরপর অভিযান চলে আরও কয়েকটি ক্লিনিকে। কিন্তু এর আগেই বেসরকারী হসপিটাল এন্ড ল্যাব ওনার্স সংগঠনের পক্ষে আকস্মিকভাবে বৃহত্তর চট্টগ্রামে বেসরকারী পর্যায়ে সব ধরনের স্বাস্থ্য সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। শুরু হয় অচলাবস্থা। বাড়তে থাকে রোগীদের দুর্ভোগ। অনাকাক্সিক্ষত এ ঘটনার জন্ম নেয়ায় চাপ পড়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং মা ও শিশু হাসপাতাল। চমেক হাসপাতালে রোগী ধারণের ক্ষমতা যেখানে ১৩শ’ সেখানে নিয়মিতভাবে ৩ থেকে ৪ হাজার সমাগম ঘটে থাকে। বেসরকারী ক্লিনিক হাসপাতালে চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়ায় সরকারী এ হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি হয়। রোগীর সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৬ হাজারে। অন্যান্য বেসরকারী হাসপাতালগুলো ইমার্জেন্সি বিভাগ খোলা থাকলেও রোগীদের পরামর্শ দেয়া ছাড়া কাউকে ভর্তি করানো হয়নি। তবে আগে থেকে যারা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তাদের নামমাত্র চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। কেননা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা শুধু হাসপাতালে যাওয়া বন্ধ করেননি, তারা নিজেদের চেম্বারও নিজেরা বর্জন করেছেন। পুরো বিষয়টি গোটা দেশকে প্রচ- ঝাঁকুনি দেয়। রবিবার রাতে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিব, বিএমএ ও স্বাচিব এবং সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পুরো বিষয়টি অবহিত হয়ে সরকারী-বেসরকারী পর্যায় থেকে ধর্মঘটে যাওয়া সংগঠন নেতাদের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেন। ফলে সোমবার দুপুর ১২টার মধ্যে আহূত ধর্মঘট স্থগিত রাখার ঘোষণা আসে। শুরু হয় পূর্বের মতো রোগী ভর্তি ও চিকিৎসা সেবা প্রদান। এদিকে চট্টগ্রামে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাংবাদিক সমাজের পক্ষে আহূত সোমবার দুপুরের সমাবেশটিও স্থগিত ঘোষণা করা হয়। চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌস জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। রাইফার মৃত্যু নিয়ে ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটির যে রিপোর্ট দিয়েছে তার ভিত্তিতে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। রাইফার পরিবারের পক্ষ থেকে মামলার প্রস্তুতি চলছে। তিনি দাবি করেন, সাংবাদিক সমাজ আন্দোলন করেছে শান্তিপূর্ণ। পক্ষান্তরে ডাক্তারদের পক্ষে আন্দোলনের নামে নিজেদের দোষ ঢাকতে রীতিমতো সন্ত্রাসী মনোভাব প্রদর্শন যে করা হয়েছে, তা এখন সকলের কাছে পরিষ্কার। তাদের সব কর্মকা-ের ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এছাড়া অতীতে ডাক্তারদের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় যারা স্বজন হারিয়েছেন তারাও ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন। সকলের মুখে এক কথা, ভুল বা অপচিকিৎসা এবং অবহেলার জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থায় যে অরাজক পরিস্থিতি চলছে তার কোন উন্নতি হবে না। তিনি এ ব্যাপারে সমাজের বিবেকবানসহ সরকারী পর্যায়ের সকল মহলকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আবারও দাবি জানান। তিনি আরও জানান, এ ঘটনা নিয়ে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১১ জুলাই চট্টগ্রাম সাংবাদিক সমাজ কালো ব্যাজ ধারণ কর্মসূচী পালন করবে। জানা গেছে, চট্টগ্রামে বেসরকারী পর্যায়ে ল্যাব, ডায়াগনস্টিক, ক্লিনিক হাসপাতাল ও রোগ নির্ণয় কেন্দ্র কত এর কোন সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে তা ৪ হাজারেরও বেশি বলে প্রচার রয়েছে। চট্টগ্রামে রোগী মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্বজনদের মামলা ও বিভিন্ন সমাবেশের ঘটনা নিয়ে তিনবার চিকিৎসা সেবা বন্ধ রাখার ঘটনা রয়েছে। বিভিন্ন অজুহাতে কথায় কথায় চিকিৎসকরা চিকিৎসা সেবা থেকে বিরত থেকেছেন। যা দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলোর মতো রূপ নিয়েছে। যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী চিকিৎসকরা রোগীদের চিকিৎসা দিতে বাধ্য। এ কথাটি তারা কোনভাবেই মনে রাখেন কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক ও মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে আগ্রাসী ভূমিকার কারণে তারা ধর্মঘটে গেছে। পক্ষান্তরে, বিএমএ নেতাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রবিবার বিভিন্ন ক্লিনিকে সশস্ত্র র‌্যাব সদস্যদের উপস্থিতি তাদের কাছে কাম্য ছিল না। এটা অভিযান নয়, মনিটরিং বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রামের বিএমএ নেতা ফয়সাল ইকবাল। এই ফয়সাল ইকবাল রাইফার মৃত্যুর পর চকবাজার থানায় সাংবাদিক ও পুলিশ সদস্যদের প্রতি অশোভন আচরণ করেছেন। যার ভিডিও ক্লিপ সরকারী পর্যায়েও নেয়া হয়েছে। এছাড়া বিএমএর সমাবেশে জামায়াত-বিএনপি সমর্থিত ড্যাব নেতারাও উস্কানিমূলক বক্তব্যের পাশাপাশি সাংবাদিকদের মারধর করারও প্রকাশ্য বক্তব্য দিয়েছেন, যা ছিল সম্পূর্ণ অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। এদিকে রবিবার দুপুর থেকে আকস্মিকভাবে বেসরকারী সকল সেবা প্রতিষ্ঠানে রোগী ভর্তি ও চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসা প্রত্যাশীদের মাঝে শুরু হয় আহাজারি। অনেকে হাসপাতাল ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। অনেকে ভর্তি হতে এসে ভর্তি হতে পারেননি। অনেকে রোগ নির্ণয়ের রিপোর্ট যথাসময়ে গ্রহণ করতে পারেননি। এ নিয়ে বিভিন্ন ক্লিনিক ও হাসপাতালে চরম উত্তেজনাকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পুলিশ সবকটি সেবা সংস্থায় নজরদারি বাড়িয়ে দেয়। তবে অনাকাক্সিক্ষত কোন ঘটনা ঘটেনি। শুধু রোগীদের চিকিৎসা কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে। রোগীদের জিম্মি করে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকরা এ ধরনের অবৈধ ধর্মঘট ডেকে নিজেদের অপকর্ম ঢাকার যে অপতৎপরতা গ্রহণ করেন তার নেপথ্যে চট্টগ্রাম বিএমএ নেতাদের ইন্ধন ও প্রকাশ্য সমর্থন ছিল। ধর্মঘট প্রত্যাহার হলেও এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িতরা সমাজে চরমভাবে যেমন ঘৃণিত হয়েছেন তেমনি পেশার ক্ষয়িষ্ণু ভাবমূর্তিকে আরও ভূলুণ্ঠিত করেছেন বলে জল্পনা-কল্পনা, আলোচনা ও নানা প্রশ্নের জাল ক্রমবিস্তৃিত লাভ করছে।
×