ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হরতাল ডাকা অন্যায় ॥ ডাক্তারদের ভুল হতে পারে, মানুষ মাত্রই ভুল হয়

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১০ জুলাই ২০১৮

হরতাল ডাকা অন্যায় ॥ ডাক্তারদের ভুল হতে পারে, মানুষ মাত্রই ভুল হয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কতিপয় দুর্বৃত্তের কারণে চিকিৎসা পেশার সুনাম নষ্ট হচ্ছে। চিকিৎসা পেশা কিছু দুর্বৃত্তের কাছে বন্দী হয়ে পড়েছে। বিপদে পড়লে মানুষ তিনজনের কাছে যায়। পুলিশ, আইনজীবী ও ডাক্তার। এই তিনটা পেশা যদি ধ্বংস হয় তাহলে মানুষ কোথায় যাবে? ওই মেয়েটাকে তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। ডাক্তার দেবতা নন। আমাদের ভুল হবে সেটা স্বাভাবিক। আমাদের ভুল হলে উচ্চ আদালত আছে। ভুলটা অন্যায় নয়। কিন্তু ভুলটা জাস্টিফায়েড (গ্রহণযোগ্য, বৈধ) করার জন্য হরতাল ডাকা হলে সেটা অন্যায়।’ ডাক্তারি একটি মহান পেশা। এই পেশাটি কতিপয় দুর্বৃত্তের কাছে বন্দী। দেশের বেসরকারী হাসপাতালগুলোর পাবলিক পারসেপশন ভাল না এবং ডাক্তারদের ব্যবহারও ভাল না। কী ঘটছে আপনারা দেখেন। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। আমাদেরও ভুল হয়। আমাদের ভুলের বিচারের জন্য সর্বোচ্চ আদালত আছে। কিন্তু ডাক্তাররা ভুল করলে এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলে তার প্রতিবাদ হিসেবে হরতাল ডাকা অনৈতিক। সোমবার চুয়াডাঙ্গার ইম্প্যাক্ট মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে চক্ষু শিবিরে চিকিৎসা নিতে আসা চোখ হারানো ২০ জনের ক্ষতিপূরণের রুল শুনানিতে ডাক্তারদের বিষয়ে এমনই মন্তব্য করেছেন বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ। আদালতে শুনানি করেন রিটকারী আইনজীবী অমিত দাস গুপ্ত। তার সঙ্গে ছিলেন সুভাষ চন্দ্র দাস। অন্যদিকে, ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার এম আমিনুল ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল এবিএম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ। এ সময় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডাক্তার আবুল কালাম আযাদ ও চুয়াডাঙ্গা জেলার সিভিল সার্জন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। সম্প্রতি চট্টগ্রামের বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে অবরোধ ডাকা প্রসঙ্গ টেনে আদালত বলে, ‘মানুষ বিপদে পড়লে ডাক্তার, পুলিশ ও আইনজীবীদের কাছে যায়’। কিন্তু এ পেশার কতিপয় দুর্বৃত্তের কারণে পেশার সুনাম নষ্ট হয়। নিজেদের ভুল ঢাকতে ধর্মঘটের ডাক দেয়া অন্যায়। ডাক্তারদের ভুলে যদি সাধারণ মানুষকে কষ্ট ভোগ করতে হয়, তা হবে আমাদের জন্য অশনিসংকেত। স্বাস্থ্য অধিদফতর থাকতে র‌্যাবকে কেন অভিযান চালাতে হবে। তাহলে অধিদফতরের কাজ কি এমন প্রশ্নও তোলে হাইকোর্ট। দেশে অনেক স্বনামধন্য চিকিৎসক এবং ভাল মানের চিকিৎসা সেবার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কতিপয় ভুল চিকিৎসার ভয়ে রোগীরা পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যাচ্ছে। এতে দেশীয় মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। তাই আদালত এ ধরনের পরিস্থিতি কমিয়ে আনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডাঃ আবুল কালাম আজাদকে নির্দেশনা দেন। ভুল চিকিৎসায় চোখ হারানো ২০ জনকে ক্ষতিপূরণ দিতে জারি করা রুলের জবাব না দেয়ায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ও চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জনকে তলব করে গত ৩ জুলাই আদেশ দেয় হাইকোর্ট। আদালতের আদেশে তারা সোমবার হাজির হলে আদালত তখন এ মন্তব্য করে। গত ২৯ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে ‘চক্ষু শিবিরে গিয়ে চোখ হারালেন ২০ জন!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন যুক্ত করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন এ আইনজীবী অমিত দাস গুপ্ত। গত ৪ মার্চ থেকে চুয়াডাঙ্গার ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে তিন দিনের চক্ষু শিবিরের দ্বিতীয় দিনে ২৪ জন নারী-পুরুষের চোখের ছানি (ফ্যাকো) কাটা হয়। ওই অস্ত্রোপচারের দায়িত্বে ছিলেন চিকিৎসক মোহাম্মদ শাহীন। একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়, পরদিন বাসায় ফেরার পর ওই রোগীদের চোখে সংক্রমণ দেখা দেয়। চোখে জ্বালাপোড়া নিয়ে তারা যোগাযোগ করেন ইম্প্যাক্ট হাসপাতালে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রথমে বিষয়টি গুরুত্ব না দিলেও পরে কয়েকজন রোগীকে স্থানীয় এক চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। ওই চক্ষু বিশেষজ্ঞ তাদের জরুরীভিত্তিতে ঢাকায় যাওয়ার পরামর্শ দেন। এদের মধ্যে চারজন রোগী নিজেদের উদ্যোগে স্বজনদের সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় আসেন। পরে ইম্প্যাক্ট থেকে ১২ মার্চ একসঙ্গে ১৬ জনকে ঢাকায় পাঠানো হয়। কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে যাওয়ায় ১৯ জনের একটি করে চোখ তুলে ফেলতে হয়। আরেক নারীর অপারেশন করা বাম চোখের অবস্থাও ভাল নয়। ঢাকায় দ্বিতীয় দফায় অপারেশন করলেও দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসেনি তার। প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ২০ রোগীর সবাই দরিদ্র। কেউ স্বজনের কাছে ধারদেনা করে, কেউ বাড়ির ছাগল-মুরগি বিক্রি করে, কেউ এনজিও থেকে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ইম্প্যাক্ট হাসপাতালে গিয়েছিলেন চোখ সারাতে। আইনজীবী অমিত দাস গুপ্ত জানান, সোমবার এ মামলার শুনানি শুরু হলে প্রথমেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে এক সপ্তাহ সময় চান তারা। তখন আদালত স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ও চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জনকে উদ্দেশ্য করেন বলেন, আপনারা লিখিত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় পাবেন। কিন্তু যেহেতু আপনাদের ডাকা হয়েছে আমরা আপনাদের কাছ থেকে শুনি। প্রথমে চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জনকে ডেকে আদালত জানতে চায়, চক্ষুশিবির হওয়ার আগে কোন অনুমতি নেয়ার বিধান আছে কি না? সিভিল সার্জন তখন জানান, আমার সঠিক জানা নেই। আদালতের প্রশ্ন, কোথাও কোনো চক্ষু শিবির হয় তাহলে অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন আছে কি সেটি আপনার জব ডেসক্রিপশনে আছে কি না? জবাবে সিভিল সার্জন বলে, আমার জব ডেসক্রিপশনে নেই। তবে চুয়াডাঙ্গার এ ঘটনার পরে আমরা একটা নির্দেশনা দিয়েছি যে, আমাদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। সিভিল সার্জন আদালতকে জানায়, স্থানীয় একটি পত্রিকায় এ ঘটনাটি প্রকাশ হওয়ার পর ২৮ মার্চই আমি ঘটনাস্থলে যাই এবং ওই চক্ষু শিবির ও হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ করে দেই। এ ঘটনাটি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে জানানোর পর দুইটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। প্রথম যে তদন্ত কমিটি গঠন করে তারা সেখানে গিয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে তারা বলেছে যে, এটা বিনামূল্যে চক্ষুশিবির ছিল না। স্বল্প মূল্য নিয়েছে। তিন দিনের চক্ষু শিবিরের মধ্যে ৫ মার্চ দ্বিতীয় দিনের ঘটনায় ২০ জনের চোখ নষ্ট হয়ে যায়। ওইখানে যে অপারেশন থিয়েটার ছিল সেটি সঠিক ছিল। যিনি ডাক্তার ছিলেন তিনি নাকি ৭০ হাজার চোখ অপারেশন করেছেন। সুতরাং অপারেশনে তার দক্ষতা রয়েছে। ওষুধে কোন ত্রুটি ছিল কিনা এটা জানার জন্য তদন্ত কমিটি ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছেন। কিন্তু সেই ওষুধের কোন ত্রুটি সরকারের তদন্ত কমিটি পায়নি। কিন্তু ইম্প্যাক্ট কর্তৃপক্ষ যে ওষুধ ব্যবহারের কথা বলেছে, সে ওষুধের নমুনা আইসিডিডিআরবিতে পাঠালে তাতে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পেয়েছে। যেটি চোখের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। দুটি প্রতিবেদন দুই রকম কেন জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক জানায়, আইসিডিডিআরবি যেটা করেছে সেটি আরলি (শিগগিরই) অব টাইম করা হয়েছে। সুতরাং তখন ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি থাকতে পারে। আর মন্ত্রণালয় যেটা করেছে সেটা সাবসিকোয়েন্টলি হয়েছে। ততদিনে ব্যাকটেরিয়া মরে যেতে পারে স্বাভাবিক নিয়মে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। কিন্তু প্রকৃত কারণ কি সেটি এখন পর্যন্ত তারা বের করতে পারেননি। এ সময় আদালত বলে, প্রকৃত কারণ কী, দোষী কে, কী কারণে ঘটনা ঘটেছে সেটি নির্ধারণ করে আগামী ১৬ জুলাইয়ের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। সেটি দেখে আদালত ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করবে। যাদের চোখ গেছে তাদের চোখ ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। এই ক্ষতি আর্থিক মানদ-ে নির্ধারণ করা সম্ভব না। তা সত্ত্বেও যাতে তারা ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন এমন কোন ফান্ড সরকারের আছে কি না তা আদালত জানতে চেয়েছে। তখন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক জানায়, এমন কোন ফান্ড সরকারের নেই। তখন আদালত বলে, সরকারের এ ধরনের ফান্ড না থাকলে কী উপায়ে তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া যায় সে বিষয়েও যথাযথ আদশে থাকবে।
×