ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সংরক্ষিত ৫০ নারী আসনের মেয়াদ আরও ২৫ বছর বাড়ল

সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনী পাস

প্রকাশিত: ০৫:১২, ৯ জুলাই ২০১৮

  সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনী পাস

সংসদ রিপোর্টার ॥ জাতীয় সংসদে ২৯৮ : শূন্য বিভক্তি ভোটে অর্থাৎ সর্বসম্মতিক্রমে রবিবার জাতীয় সংসদে সংবিধান (সপ্তদশ সংশোধন) বিল-২০১৮ পাস হয়েছে। দু’দফা বিভক্তি ভোটে সরকার ও বিরোধী দলের অধিবেশনে উপস্থিত ২৯৮ এমপির সবাই ’হ্যাঁ’ ভোট দিয়ে বিলটিতে সমর্থন জানান। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী এই বিভক্তি ভোট চলার পর ভোট গণনা শেষে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ২৯৮ : শূন্য ভোটের ব্যবধানে সর্বসম্মতিক্রমে বিলটি পাসের ঘোষণা করলে সবাই তুমুল টেবিল চাপড়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। বিলটি পাসের ফলে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত ৫০ নারী আসনের মেয়াদ আরও ২৫ বছর বাড়ল। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে রবিবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে বিলটি পাসের উত্থাপন করেন আইন. বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক। কোন সংবিধান সংশোধনী বিল পাস করতে হলে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যদের সমর্থনের প্রয়োজন হয়। বর্তমান সংসদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও এই বিলে সমর্থন দিয়েছে। এর কারণে বিলটি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। তবে বিলটি পাসের আগে বিলটির ওপর জনমত যাচাই-বাছাই ও সংশোধনী প্রস্তাব এনে বিরোধী জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র ৯ জন সংসদ সদস্য বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের মধ্যে রোলমডেল। পৃথিবীর মধ্যে একটি দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ যার প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, উপনেতা ও স্পীকার হচ্ছেন নির্বাচিত নারী। নারীর এই ক্ষমতায়নের যুগে সংরক্ষিত আসন বৃদ্ধি করতে আনা এই বিলটি উল্টো পেছনে ঠেলে দেবে। তারা বলেন, বর্তমান সময়ে নারীরা এখন আর সংরক্ষিত অর্থাৎ করুণা নিয়ে সংসদে থাকতে চান না, বরং নির্বাচনে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়েই সংসদে আসতে চান। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশে নির্বাচনে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকে ৪০ ভাগ নারীকে মনোনয়ন দেয়ার বিধান থাকলেও কোন দলই তা মানেন না। আর এ বিলটি সংবিধানের ২৮ (৪) ও ৬৬ (১) ধারার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাই এই বিলটি পাস করা হলে সংবিধান লঙ্ঘন করা হবে। তবে জাতীয় পার্টির বেগম রওশন আরা মান্নান সংরক্ষিত নারী আসনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নারীর ক্ষমতায়নে ৫০ নয়, সংরক্ষিত আসন ৭৫-এ উন্নীত করার দাবি জানান। জবাবে আইনমন্ত্রী কাজী নজরুল ইসলামের ’নারী’ কবিতার কিছু পঙক্তি তুলে ধরে বলেন, ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সংবিধানে সংসদে ১৫ আসন সংরক্ষিত রাখায় নারীর ক্ষমতায়নের সিঁড়ি তৈরি হয়। আজ তারই কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ নারীর ক্ষমতায়নে সারাবিশ্বের কাছে রোলমডেল। তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই জাতীয় সংসদ। যেখানে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিরোধী দলের নেত্রী, স্পীকার ও সংসদ উপনেতাও নারী। তাই এই আইনটি গত ৪০ বছর ধরে নারীর ক্ষমতায়নকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। আর জনগণের সমর্থন রয়েছে, জনপ্রতিধিদের সমর্থন রয়েছে। তাই বিলটি নিয়ে কোন জনমত যাচাই-বাছাইয়ের কোন প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, এই বিলটি পাস হলে সংবিধানের কোন ধারায় লঙ্ঘন হবে না। সংরক্ষিত আসন সংরক্ষণ করা হলেও যে কোন নারী সরাসরি ভোটে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণে এই সংবিধান সংশোধনটি কোন বাঁধাই সৃষ্টি করবে না। এই সংসদে ৭৩ জন নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন, এর মধ্যে ২২ জনই সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। মেয়াদ বৃদ্ধি অনেকবারই করা হয়েছে। তাই সংশোধনী প্রস্তাবগুলো গ্রহণযোগ্য নয়। এরপরই কার্যপ্রণালী বিধির ৯৯ (গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দু’দফা বিভক্তি ভোটে যান স্পীকার। দু’মিনিটের ঘণ্টা বাজানোর পর স্পীকার ভোট প্রদানের ঘোষণা করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদসহ সব সংসদ সদস্যরা হ্যাঁ লেখা লবিতে ভোট প্রবেশ করে তাদের ভোট দেন। না ভোট লেখা লবিতে একজন সংসদ সদস্যও প্রবেশ করেন নি। দু’দফা ভোটগ্রহণ শেষে স্পীকার ভোটের ফলাফল ঘোষণা করে বিলটি সর্বসম্মতিক্রমে পাসের ঘোষণা দেন। উল্লেখ্য, আইন প্রণয়ন কাজে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সংবিধানে সংরক্ষিত নারী কোটা চালু হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে ১৯৭২ সালে। সেই থেকে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের পরই সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন বরাদ্দ থাকছে। কিন্তু সংবিধানে বিদ্যমান সময় অনুযায়ী সংরক্ষিত নারী আসনের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই আজ সংসদে বিলটি পাসের জন্য উত্থাপন করা হবে। এর আগে গত ১০ এপ্রিল সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে সংরক্ষিত আসনে নির্বাচনের বিধানে সংশোধনী এনে সংসদে বিল উত্থাপন করা হয়। উত্থাপিত সংবিধান (সপ্তদশ সংশোধন) বিল-২০১৮ তে আরও ২৫ বছর সংরক্ষিত আসন রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। গত ৫ জুলাই আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা এই বিল পাসের সময় সব সংসদ সদস্যদের উপস্থিত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন এবং কীভাবে সংবিধান সংশোধনী বিলে ভোট দিতে হয় তাও শিখিয়ে দেন নতুন সংসদ সদস্যদের। রবিবার সরকার ও বিরোধী দলের বিপুল সংখ্যক সংসদ সদস্য উপস্থিত থেকে সংবিধান সংশোধনী এই বিলে ভোট দিয়ে সমর্থন জানান। সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের (৩) উপ-দফায় সংশোধনী এনে বলা হয়েছে- ‘সংবিধান (সপ্তদশ সংশোধন) আইন-২০১৮ প্রবর্তনকালে বিদ্যমান সংসদের অব্যবহিত পরবর্তী সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে পঁচিশ বছর অতিবাহিত হওয়ার অব্যবহিত পরবর্তীতে সংসদে ভেঙ্গে না যাওয়া পর্যন্ত পঞ্চাশটি আসন শুধু নারী সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে এবং তারা আইনানুযায়ী আগের সদস্যদের মাধ্যমে সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির ভিত্তিতে একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন।’ বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে- স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আইন প্রণয়নে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তদানীন্তন গণপরিষদ প্রণীত ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৫-এর দফা (৩)-এর বিধানে জাতীয় সংসদে নারী সদস্যদের জন্য সংবিধান প্রবর্তন থেকে ১০ বছর সময় অতিবাহিত হওয়ার অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে সংসদ ভেঙ্গে না যাওয়া পর্যন্ত ১৫টি আসন সংরক্ষণ করা হয়। সংরক্ষিত নারী আসনের ধারাবাহিকতা বজায় থাকার কারণে সমাজে সবক্ষেত্রে নারীদের অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। সর্বশেষ সংশোধনী অনুযায়ী সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৫-এর দফা (৩)-এর বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী বর্তমানে সংরক্ষিত নারী আসনের ১০ (দশ) বছর মেয়াদ ২৮ জানুয়ারি ২০১৯ শেষ হবে। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে মেয়াদ বৃদ্ধি করা না হলে ওই সময় অতিবাহিত হওয়ার পর জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য কোন আসন সংরক্ষিত থাকবে না। সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজনীয়তা এখনও বিদ্যমান রয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদেরকে নিয়ে গঠন করতে হলে দশম সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় সংবিধানে এ সংক্রান্ত বিধান সংশোধন করা আবশ্যক।
×