ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ঘোলা পানিতে শিবিরের মাছ শিকার

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ৯ জুলাই ২০১৮

ঘোলা পানিতে শিবিরের মাছ শিকার

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসলামী ছাত্রশিবির তাদের পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘের ধারাবাহিকতায় নানারকমের অন্যায়, অনাচার, নাশকতা ও হত্যাকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে। একাত্তর সালে ছাত্রসংঘ আলবদর বাহিনী গঠন করে শিক্ষক, সাংবাদিক, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকসহ পেশাজীবী হত্যায় নারকীয় উল্লাসে মেতে উঠেছিল। পুরো নয়মাস পাকিস্তানী হানদার সেনাবাহিনী, রাজাকার, শান্তি কমিটি ও আল শামস বাহিনীর পাশাপাশি পাকিস্তানের কথিত ‘সংহতি’ রক্ষায় মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুষ্কৃতকারী’ বা ‘ভারতীয়চর’ অভিহিত করে নিধনে সশস্ত্র পন্থা অবলম্বন করেছিল। পাকিস্তানী হানাদারদের কাছ থেকে তারা প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। বেয়নেট চার্জ করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করার মধ্য দিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ত। এই কসাইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার সময় এরা ধর্মীয় লেবাস জড়াত। অথচ পুরো কাজটাই ছিল অধর্মের। এদের মুখে ধর্মের গীত বেশি বেশি করা শোনা যেত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হল, বকশিবাজারের আলিয়া মাদ্রাসা ছিল এদের প্রধান ঘাঁটি। রাইফেল, বেয়নেট ও কিরিচে ঠাসা ছিল এ দুটি স্থান। যে কাউকে হুমকি-ধমকি প্রদান করা ছিল তাদের কর্তব্যকর্ম। গোড়াতে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হলেও ক্রমান্বয়ে এরা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিক্ষক, ছাত্ররা বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং সংখ্যালঘুরা ছিল এদের হত্যাযজ্ঞের প্রধান ‘টার্গেট’। বুলেট খরচ না করার দিকে ঝোঁক ছিল বলে বেয়নেট, কিরিচ ব্যবহার করে শান্তি স্বস্তি পেত এই কারণে যে, নির্মমতার যতটা প্রয়োগ সম্ভব সবটুকু করা যেত এইভাবে। কখনও সখনও নিরীহ নারী-পুরুষকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে হানাদার সেনাদের হাতে তুলে দিত, যাতে বুলেট খরচ করে হত্যা করতে পারে। পাকিস্তানী বর্বর সেনারা আলবদরদের জন্য ‘কোটা’ বেঁধে দিয়েছিল, দৈনিক কতজনকে হত্যা করবে। কোটা তারা সংস্কার নিজেরাই করে নিয়ে কোটাতিরিক্ত হত্যাকান্ড সম্পন্ন করত। এ নিয়ে কারও কাছে জবাবদিহি করতে হত না। বেয়নেট চার্জ করে হত্যার পর কারও কারও মরদেহ বাঁশের ডগায় ঝুলিয়ে দিত। কিন্তু তারা অনেক সময় মুখোশ ধারণ করত। এই মুখোশধারী দুর্বৃত্তদের বাংলার মানুষ দেখেছে একাত্তর সালে। শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে এসে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এরা সবাই ছিল মুখোশধারী। এদের উত্তরসূরিরা গত ৮ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে নারকীয় তান্ডব চালানোর সময়ও ছিল মুখোশ পরা। এরা মূলত মুখোশপরা অমানুষ। মানবিকতার কোন ছাপ এদের মধ্যে দেখা যায় না। চেহারায় খুনীর ছাপ। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পরাজিত হওয়ার পর আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু আলবদর, আল শামস, রাজাকাররা পালিয়ে যায়। ওরা আত্মসমর্পণ করেনি। পালিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে বদর বাহিনী তোপখানা রোডের সচিবালয়ের দেয়ালে লিখে গিয়েছিল, ‘আমরা আবার ফিরে আসব- আল বদর।’ ওরা কথা রেখেছে, আবার ফিরে এসেছে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর। ক্ষমতা দখলকারী জান্তা শাসক জিয়াউর রহমান রাজাকার, আলবদরসহ স্বাধীনতাবিরোধী ও বাঙালী নিধনকারী রাজনৈতিক দলগুলোকে পুনর্বাসন শুধু নয়, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠান করে ‘ মানি ইজ নো প্রবলেমের’ আড়ালে। আর মুক্তিযোদ্ধারা হতে থাকে নিষ্পেষিত। পাকিস্তানী চেতনা ও ভাবধারায় দেশ পরিচালিত হতে থাকে। আইয়ুব ও ইয়াহিয়া খানের প্রেতাত্মারা জিয়ার ঘাড়ে ভর করে। একাত্তরে মহিলা রাজাকার ও আলবদরও ছিল। সংখ্যায় কম হলেও এদের দাপট কম ছিল না। এদেরই উত্তরসূরি আজকের ইসলামী ছাত্রী সংস্থার মেয়েরা। শিবিরের ছাত্রী সংগঠনটি গোপনে গোপনে সাংগঠনিক কাজ করে আসছিল। কথিত কোটা আন্দোলনের নামে এরা মাঝরাতে হল থেকে ছাত্রীদের নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরও এরা জঙ্গী রূপ ধারণ করে রাজপথে নেমে আসে। এদের অনেকেরই সশস্ত্র প্রশিক্ষণ যে রয়েছে, আচরণই তা প্রমাণ করে। ছাত্রীদের হলগুলোতে এরা সাধারণ ছাত্রীদের প্রভাবিত করতে পেরেছে নানাভাবে। সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নামে এরা মেয়েদের হলগুলোতে ৬১ সদস্যের কমিটিও করেছে। এদের লক্ষ্য কোটা সংস্কারের আবরণে সরকারের পতন ঘটানো। এই সংগঠনের সঙ্গে জঙ্গী সংগঠনগুলোর কোন যোগসূত্র রয়েছে কি না তা এখনও স্পষ্ট নয়। এদের মূল সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রকাশ্য কোন কর্মকান্ডের নজির দেখা যায় না। যুক্তরাষ্ট্র এই সংগঠনটিকে বিশ্বের দশটি সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠনের অন্যতম বলে অভিহিত করেছে ক’বছর আগে। শিবিরের হাজার হাজার নেতা-কর্মী তাহলে কোথায় আত্মগোপন করেছে, তার হদিস কেউ নেয় না। এক সময় ছাত্রদলে তারা অবস্থান নিয়েছিল। সেই সংগঠনটিকে গিলে খেয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এরা ক্রমশ ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করে। এক সময় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে যেমন, তেমনি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়েও শক্ত অবস্থান নেয়। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও এরা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও বিতার্কিক সংগঠনের নামে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এদের অনেকেই জেএমবি, নব্যজেএমবি, আনসার আল ইসলামের সঙ্গেও সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। জঙ্গী হিসেবে যেসব ছাত্র ধরা পড়েছে, তারা প্রাথমিকভাবে শিবির কর্মী হিসেবে হাতেখড়ি দেয়। ক্রমান্বয়ে জঙ্গীতে রূপান্তরিত হয়েছে। এদের আর্থিক যোগান আসে জামায়াতী অনুসারীদের কাছ থেকে। এই যে এত সহস্র শিবির নেতা-কর্মী ‘হাওয়া’ হয়ে গেল, তারা আসলে কোথায় গেল? তাদেরই একটা অংশ আজ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ নাম ধারণ করে বিএনপি-জামায়াত-জঙ্গীদের নাশকতা ও অরাজকতার লক্ষ্যকে সফল করে তুলতে সক্রিয়। এদের জন্য মোক্ষম অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলন। সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে তা সম্প্রসারণের কাজটি সুনিপুণ করতে পেরেছে ছাত্রলীগে থাকা তাদের অনুসারীদের সহায়তায়। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের প্রশ্রয়ে-আশ্রয়ে এরা নাশকতাকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে সারাদেশে। অর্থ বলে বলীয়ান হতে পেরেছে বলেই এই সংগঠনটি গত রমজান মাসে সারাদেশে দুই শতাধিক ইফতার পার্টির আয়োজন করতে পেরেছে। দেশের সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে কমিটি গঠন করতে সক্ষম হয়েছে। এসব কমিটি পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে যেমন তেমনি আঞ্চলিক বিএনপি-জামায়াত এমনকি আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী জামায়াতীরাও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে আসছে। ইফতার পার্টিগুলোতে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল ঈদের পর সারাদেশে একযোগে আন্দোলনের নামে সরকারবিরোধী মনোভাব সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে সম্প্রসারিত করে দেশকে বিপর্যয়ের দিকে এমনভাবে ঠেলে দেয়া হবে, যাতে সরকারের পতন ঘটানো যায়। ঈদের পর সারাদেশে সভা, সমাবেশ করার পরিকল্পনা নিয়েছিল তারা। এই আন্দোলন কিভাবে করা হবে, তা সাড়ে ১৮ মিনিটের ভিডিওতে সংরক্ষণ পরিষদের শিবিরপন্থী নেতা রাশেদ খান যেভাবে বর্ণনা করেছিলেন, তা হুবহু আল কায়েদা নেতাদের অনুরূপ। কীভাবে ধাপে ধাপে সরকারবিরোধী আন্দোলন তথা নাশকতা গড়ে তোলা যায়, তার রূপরেখা বর্ণনা করা হয়েছিল। গত ১১ জুন সোমবার ‘বিএনপি-জামায়াতের ভরসা এখন বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ শীর্ষক উপ-সম্পাদকীয়তে লিখেছিলাম এদের নাশকতার পরিকল্পনার প্রস্তুতি সম্পর্কে। ঈদের পর তাই দেখা গেল, এরা সরকারী প্রজ্ঞাপন জারির নামে অরাজকতা তৈরি করছে। সাধারণ ছাত্ররা তাদের সেই হীন উদ্দেশ্য বানচাল করে দেয়ার পর এরা ছাত্রলীগের কাঁধে দায়ভার চাপাচ্ছে। আড়াই মাস আগে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়ে যাবার পর নয়া কমিটি এখনও হয়নি। পুরনো কমিটি বিলুপ্ত। সুতরাং ছাত্রলীগ নেতৃত্ব দিয়ে হামলা চালিয়েছে, এমনটা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য জামায়াত-শিবিরের প্রতি সহানুভূতিশীল শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীরা মাঠে নেমেছে। এদের উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সরকারের পতন ঘটিয়ে পাকিস্তানী ভাবধারা ফিরিয়ে আনা। কোটা আন্দোলনকারীদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল। আজ তাই বাংলাদেশ বিরোধীরা এক হয়েছে। ঘোলাজলে ওরা শিবিরের হাত ধরে মাছ শিকার করতে চায়।
×