ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সেমিতে প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড

শেষ চারে ক্রোয়েশিয়া- রুশ রূপকথার অবসান

প্রকাশিত: ১০:২২, ৮ জুলাই ২০১৮

শেষ চারে ক্রোয়েশিয়া- রুশ রূপকথার অবসান

রুমেল খান ॥ শনিবার রাতে দুটি ম্যাচের মধ্য দিয়ে যবনিকাপাত ঘটল একবিংশ ফিফা বিশ্বকাপের তৃতীয় পর্ব অর্থাৎ কোয়ার্টার ফাইনাল অধ্যায়ের। তৃতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড ২-০ গোলে সুইডেনকে এবং চতুর্থ কোয়ার্টার ফাইনালে ক্রোয়েশিয়া টাইব্রেকারে ৪-৩ (২-২) গোলে রাশিয়াকে হারিয়ে নিশ্চিত করে সেমিফাইনালে খেলা। ইতোধ্যেই চূড়ান্ত হয়ে গেছে শেষ চারের লড়াইয়ের লাইনআপ। আগামী ১০ জুলাই সেন্ট পিটার্সবার্গের ক্রেসতোভস্কি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত প্রথম সেমিতে ফ্রান্স মোকাবেলা করবে বেলজিয়ামকে। পরের দিন ১১ জুলাই মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সেমিতে ক্রোয়েশিয়া মুখোমুখি হবে ইংল্যান্ডের। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে স্বাগতিক ফ্রান্সের কাছে সেমিফাইনালে হার। ২০১৪ বিশ্বকাপে স্বাগতিক ব্রাজিলের কাছে নিজেদের প্রথম গ্রুপ ম্যাচে হার। কিন্তু এবার স্বাগতিক রাশিয়ার কাছেও হার নয়, বরং ঘাম ঝরানো শ্বাসরুদ্ধকর-রোমাঞ্চকর জয়ে স্বাগতিক দলের কাছে হারের চিত্রনাট্যটা পাল্টে দিল ক্রোয়েশিয়া। সেই সঙ্গে সমাপ্তি ঘটল অবিশ্বাস্য রুশ-রূপকথার। শনিবার রাশিয়ার সোচির ফিস্ত অলিম্পিক স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত চতুর্থ ও শেষ কোয়ার্টার ফাইনালে স্বাগতিক রাশিয়া মুখোমুখি হয় ক্রোয়েশিয়ার। পূর্ণ সমর্থনপুষ্ট দল রাশিয়া খেলতে নামে উজ্জীবিত হয়ে। যদিও শক্তির নিরিখে ক্রোয়েশিয়ার চেয়ে অনেক পিছিয়ে তারা। শক্তির নিরিখে ‘দ্য ন্যাশনাল টিম’ খ্যাত এবং ৭০ নম্বর র‌্যাঙ্কিংধারী রাশিয়ার চেয়ে অনেক এগিয়ে ‘দ্য ব্লেজার্স’ খ্যাত এবং ২০ নম্বর র‌্যাঙ্কিংধারী ক্রোয়েশিয়া। যেখানে রাশিয়া চারবার বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলে এবারই প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে, সেক্ষেত্রে ক্রোয়েশিয়ার পাঁচবার মূলপর্বে অংশ নিয়ে একবার তৃতীয় স্থান অধিকার করার (১৯৯৮) অভিজ্ঞতা আছে। এর আগে দু’দলের হেড টু হেড হয়েছে ৩ বার। এতে একবার জিতেছে ক্রোয়াটরা, বাকি ২ ম্যাচ ড্র হয়। দেখাই যাচ্ছে, সবকিছুতেই পিছিয়ে রুশরা। কিন্তু এবার তারা যেভাবে রূপকথা রচনা করে এ পর্যন্ত এসেছে, সেটার জন্যই তাদের উড়িয়ে দিতে পারেনি ক্রোয়েশিয়া। পুরো খেলায় উভয় দলই আক্রমণাত্মক, গতিশীল এবং উপভোগ্য ফুটবল খেলে। যদিও বল নিয়ন্ত্রণসহ বাকি সব পরিসংখ্যানে সুস্পষ্ট ব্যবধানে এগিয়ে ছিল ক্রোয়াটরাই, তারপরও রুশদের আক্রমণগুলো ছিল বেশ গোছানো এবং ভয়-জাগানিয়া। ম্যাচের ৩১ মিনিটে কাউন্টার এ্যাটাক থেকে গোলে হজম করে বসে ক্রোয়েশিয়া। মাঝমাঠে বল পেয়ে সেটা ‘কাট’ করে পাস দেন সতীর্থ মিডফিল্ডার দেনিস চেরিশেভকে। সেই বল খুব দ্রুতই ক্রোয়েশিয়ার ডি-বক্সের কাছকাছি চলে যান ২৫ বছর বয়সী চেরিশেভ। বিপদ বুঝে তাকে বাধা দিতে এগিয়ে আসেন ক্রোয়েশিয়ার মিডফিল্ডার লুকা মডরিচ এবং ডিফেন্ডার দোমাগোজ ভিদা। তাদের বাধা দেয়ার কোন সুযোগই দেননি ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার চেরিশেভ। এমনকি সুযোগও দেননি গোলপোস্ট ছেড়ে অনেকটাই সামনে এগিয়ে আসা ক্রোয়াট গোলরক্ষক দানিয়েল সুবাসিচকেও। মডরিচ-ভিদার মাঝখান দিয়েই চলন্ত বলে ২৫ গজ দূর থেকে বা পায়ের উঁচু এবং চমৎকার প্লেসিং শটে গোলরক্ষককে ফে বোকা বানিয়ে চেরিশেভ বল জড়িয়ে দেন জালে, গো-ও-ল! সুবাসিচ একটু নড়ারও সময় পাননি (১-০)! এটা এই বিশ্বকাপে স্প্যানিশ ক্লাব ভিলারিয়ালের হয়ে খেলা চেরিশেভের ব্যক্তিগত চতুর্থ গোল। মজার ব্যাপার- ১২তম আন্তর্জাতিক ম্যাচেও তার গোল এই চারটিই! গোল খেয়ে তেতে ওঠে ক্রোয়েশিয়া। মুহুর্মুহু আক্রমণ শাণাতে থাকে তারা। অবশেষে ৩৯ মিনিটে সফলকাম হয় তারা। বল নিয়ে বা প্রান্ত দিয়ে রাশিয়ার ডি-বক্সের মধ্যে ঢুকে পড়েন ফরোয়ার্ড মারিও মানদুকিচ। বা পায়ের উঁচু ক্রস করেন। সেই বল হেড করে জালে পাঠিয়ে ক্রোয়েশিয়াকে আনন্দের উপলক্ষ এনে দেন ফরোয়ার্ড আন্দ্রে ক্রেমারিচ (২-০)। জার্মান ক্লাব ১৮৯৯ হোফেনহেইমে খেলা, ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার অধিকারী এবং ২৭ বছর বয়সী ক্রেমারিচের এটা বিশ্বকাপে ব্যক্তিগত প্রথম এবং ক্যারিয়ারে সার্বিকভাবে দশম গোল (৩৬তম ম্যাচে)। নির্ধারিত ৯০ মিনিট এবং সংযুক্তি ৫ মিনিটেও খেলার ফলের নিষ্পত্তি না হলে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। ১০০ মিনিটে আবারও গোল করে এগিয়ে যায় ক্রোয়েশিয়া। কর্নার পায় তারা। জটলা থেকে কর্নারের বল হেড করে জালে পাঠান ডিফেন্ডার দোমাগোজ ভিদা (২-১)। ১১৫ মিনিটে গোল করে নাটকীয়ভাবে সমতায় ফেরে রাশানরা। মিডফিল্ডার এ্যালান জাগোয়েভ উঁচু করে বল ফেলেন ডি-বক্সের মধ্যে। চমৎকার কৌনিক হেডে গোল করেন ডিফেন্ডার রাইট ব্যাক মারিও ফার্নান্দেজ (২-২)। এরপর আর কোন গোল না হলে শেষ পর্যন্ত খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। তাতে গোল করেন ক্রোয়েশিয়ার ব্রোজোভিচ, মডরিচ, ভিদা এবং রাকিটিচ। গোল মিস করেন কোভাসিচ। পক্ষান্তরে রাশিয়ার হয়ে গোল করেন জাগোয়েভ, ইগনাশভিচ এবং কুযইয়ায়েভ। গোল মিস করেন স্মলোভ এবং ফার্নান্দেজ। পঞ্চম ও শেষ শটে ক্রোয়েশিয়ার জয নিশ্চিত করেন বার্সেলোনায় খেলা ইভান রাকিটিচ। ব্রাজিলিয়ান রেফারি সান্দ্রো রিক্কি খেলা শেষের বাঁশি বাজালে ১৯৯৮ সালের পর আবারও সেমিতে ওঠার আনন্দ নিয়ে মাঠ ছাড়ে জøাতকো দালিচের শিষ্যরা শেষ চারে খেলার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই ২৮ বছর আগে। এরপর পাঁচবার খেলেও সেমিফাইনালে উঠতে পারেনি ‘ফুটবলের জনক’ খ্যাত ইংল্যান্ড। তবে এবার পেরেছে। শনিবার কোয়ার্টার ফাইনালে তারা ২-০ গোলের অনায়াস জয় কুড়িয়ে নেয় সুইডেনের বিরুদ্ধে। সামারার কসমস এ্যারানায় অনুষ্ঠিত এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচের প্রথমার্ধেই ১-০ গোলে এগিয়ে ছিল বিজয়ী দল। ম্যাচের ৩০ মিনিটে এগিয়ে যায় ইংল্যান্ড। কর্নার পায় তারা। মিডফিল্ডার এ্যাশলে ইয়ংয়ের কর্নারের বল সুইডেনের ডিফেন্সকে ফাঁকি দিয়ে হেড করে জালে পাঠিয়ে দলকে আনন্দের উপলক্ষ এনে দেন ইংল্যান্ডের হ্যারি ম্যাগুইরে। লিচেস্টোর সিটিতে খেলা ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার অধিকারী এবং ২৫ বছর বয়সী এই ডিফেন্ডারের এটাই ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক গোল (দশম ম্যাচে)। এগিয়ে যায় ইংল্যান্ড (১-০)। বিরতির পর ইংল্যান্ড কয়েকটি গোল-প্রচেষ্টার ব্যর্থতার পর আবারও সফল হয়ে ব্যবধান দ্বিগুণ করে ৫৮ মিনিটে। মিডফিল্ডার জেসি লিনগার্ড উঁচু ক্রস ফেলেন সুইডেনের বক্সের বা প্রান্তের কোনায়। সেখানে অরক্ষিত দাঁড়িয়ে থাকা ডেলে আলী চমৎকারভাবে হেড করে পরাস্ত করেন সুইডিশ গোলরক্ষক রবিন ওলেসেনকে (২-০)। ইংলিশ ক্লাব মিল্টন কিনেস ডোন্সে খেলা ৬ ফুট ২ ইঞ্চির অধিকারী এবং ২২ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডারের এটি ছিল এই বিশ্বকাপে ব্যক্তিগত প্রথম গোল এবং ক্যারিয়ারের তৃতীয় গোল (২৮ ম্যাচে)। দুই গোল হজম করে মরিয়া সুইডেন একের পর এক আক্রমণ শাণায়। কিন্তু তাদের সব প্রচেষ্টাই মাঠে মারা যায়। শেষ পর্যন্ত ডাচ্ রেফারি বিয়ন কুইপার্স খেলা শেষের বাঁশি বাজালে সেমিফাইনালে যাবার অনাবিল চিত্তসুখ নিয়ে মাঠ ছাড়ে গ্যারেথ সাউথগেটের শিষ্যরা। পক্ষান্তরে ১৯৯৪ বিশ্বকাপের পর (সেবার তৃতীয় হয়েছিল তারা) আবারও সেমিতে যাবার সুযোগ হারিয়ে ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে জ্যান এ্যান্ডারসনের শিষ্যরা।
×